যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার লক্ষ্য হতে পারে বাংলাদেশ, শ্রম ইস্যুতে তাদের বাণিজ্য জরিমানা ও ভিসা বিধিনিষেধের মুখে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। পরিস্থিতি সেদিকে গড়ালে কী করবে সরকার? এ নিয়ে করণীয় নির্ধারণে নড়েচড়ে বসেছে সরকারের উচ্চ পর্যায়সহ সংশ্লিষ্টরা। সোমবার (৪ ডিসেম্বর) এ বিষয় নিয়ে বৈঠক ডেকেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এ বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রফতানি উইংয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাসহ শ্রম মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর দফতর, রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল (বেপজা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাসহ বিজিএমইএ, বিকেএমইএ নেতারা উপস্থিত থাকবেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের পক্ষ থেকে সম্প্রতি মার্কিন শ্রমনীতির বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি পাঠানো হয়েছে। এতে বলা হয়, বাইডেন সরকারের স্মারকে শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যেসব উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে, এর পেছনে রাজনীতি রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই এর ব্যবহার করতে পারে। শ্রম অধিকারের লঙ্ঘন হয়েছে মনে করলে ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সুযোগ রয়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক খাতের ওপর পড়তে পারে। সংশ্লিষ্ট সবাইকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়ার কথা বলা হয় ওই চিঠিতে।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার (বাণিজ্য) মো. সেলিম রেজার লেখা চিঠিটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিবের কাছে পাঠানো হয় গত ২০ নভেম্বর। বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের ক্ষমতায়ন, অধিকার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নেওয়া স্মারকের সংকলিত একটি প্রতিবেদনও চিঠির সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। এই চিঠিকে কেন্দ্র করেই শ্রম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধে পড়তে পারে বাংলাদেশ—এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ৪ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠেয় সভায় সভাপতিত্ব করবেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব বা তার মনোনীত একজন অতিরিক্ত সচিবকে এই সভায় উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে বলে জানা গেছে। বৈঠকটি অত্যন্ত গোপনে করার চিন্তাভাবনা চলছে। বৈঠকের বিষয়টি কোনোভাবেই গণমাধ্যমে যাতে প্রকাশ না পায় সেজন্য সংশ্লিষ্ট সকলেই অধিকতর সচেষ্ট রয়েছে বলেও জানা গেছে। এ কারণে বৈঠক সম্পর্কে কারও কোনও মন্তব্য জানা যায়নি।
সূত্র আরও জানিয়েছে, সরকার বা বাংলাদেশ কোনোভাবেই শ্রম ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের বিধিনিষেধে পড়তে চায় না। যেভাবেই হোক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাকের বাজার ধরে রাখতে চায়। এ জন্য যেসব করণীয় বাংলাদেশের জন্য সম্ভব, সেগুলো পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
একইসঙ্গে এ বিষয়ে মার্কিন সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে শ্রমনীতি নিয়ে বা শ্রমিকদের কল্যাণে বাংলাদেশ এযাবৎ যেসব কর্মকাণ্ড করেছে সেসব বিষয়ে লিখিতভাবে জানানোসহ বিশ্বের বিভিন্ন জার্নালে প্রতিবেদন করা যায় কিনা সেসব বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষে আগামীতে শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত করণীয় বিষয়গুলো জানানোর সিদ্ধান্তও নেওয়া হতে পারে। এসব বিষয়ে খুঁটিনাটি দিক পর্যালোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
এসবের আইনগত ভিত্তি বা দিকগুলো নিয়েও আলোচনা হবে বলে জানা গেছে। আগামী ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবসে যুক্তরাষ্ট্র হয়তো একটা বিবৃতি দেবে, সেদিকে নজর রাখা হবে। তবে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চায় সরকার। বাংলাদেশের কোথায় কী ধরনের দুর্বলতা আছে, তা শনাক্ত করে সেসব দুর্বলতা সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করবে সরকার।
এদিকে মার্কিন চিঠি সম্পর্কে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সচিব তপন কান্তি ঘোষ আগেই জানিয়েছেন, এ চিঠি কোনোভাবেই কোনও সতর্ক বার্তা নয়। এটি স্বাভাবিক যোগাযোগ বলে জানিয়েছেন তিনি। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কোনও পরিস্থিতি বাংলাদেশে নেই। নতুন মার্কিন শ্রমনীতি নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরে কেউ কোনও চাপ অনুভব করছে না বলেও জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে ইতোমধ্যে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহকে গুরুত্ব দিয়ে এরইমধ্যে দেশে শ্রমিকদের অনুকূলে গত ১০ বছরে তিনবার শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। ফিরেছে কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ। প্রণয়ন করা হয়েছে পোশাক শিল্পের ‘টেকসই কৌশলগত রূপকল্প ২০৩০’। বাড়ানো হয়েছে বেতনসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা। বিশ্বের রেকর্ড সংখ্যক গ্রিন কারখানা এখন বাংলাদেশে।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যেসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনন্য অর্জন হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম তৈরি পোশাক শিল্প খাত, যা দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। এ খাতটি শুধু জাতীয় অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করেনি, একইসঙ্গে নিশ্চিত করেছে অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান। প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস এই শিল্পের জিডিপিতে অবদান ১১ শতাংশ।
২০৩০ সালের মধ্যে রফতানি ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যে এ শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে এরইমধ্যে সরকারের সহায়তায় পণ্য বহুমুখীকরণ, বাজার বহুমুখীকরণ, ফাইবার বহুমুখীকরণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন, ইনোভেশন ও টেকনোলজি আপগ্রেডেশন এবং কস্ট-কম্পিটিটিভ হওয়ার মাধ্যমে ভ্যালু চেইনে এগিয়ে থাকার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা এসব নিয়ে কাজও করছেন।
চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) জুলাই মাসে যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় পোশাক রফতানি যথাক্রমে ৪৭৫ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন এবং ১২৮ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ২৯ দশমিক ৭৮ শতাংশ এবং ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। একই সময়ে অপ্রচলিত বাজারে পোশাক রফতানি ২৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। টাকার অঙ্কে এটি ৬৭৪ দশমিক ৮২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। প্রধান অপ্রচলিত বাজারগুলোর মধ্যে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ায় রফতানি যথাক্রমে ৪৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ, ৫৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ, ২ দশমিক ৬০ শতাংশ এবং ১৯ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়েছে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মডেল অনুসরণ করা হয়েছে। বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ পোশাকশিল্পের টেকসই কৌশলগত রূপকল্প ২০৩০ প্রণয়ন করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, আমেরিকা-ইউরোপ মিলে পোশাক রফতানি বন্ধে যে পাঁয়তারা করছে, তা বাস্তবায়ন হবে না। রাজনীতি ও ব্যবসা আলাদা জিনিস। ইউরোপ-আমেরিকা এমন কিছু করবে না, যার প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে পড়তে পারে। এ ব্যাপারে উদ্যোক্তাদের উদ্বিগ্ন না হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানান, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বড় বাজার। এই বাজার ধরে রাখতে যা করণীয় সবই করা হবে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের জন্য বেতনসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানো হয়েছে।
আরও পড়ুন- তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নে নানামুখী পদক্ষেপ সরকারের