রাঘববোয়াল, ঋণখেলাপি ও অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে যৌথ অভিযান পরিচালনার দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য সালমা ইসলাম। তিনি বলেন, করোনাকালীন কঠিন সংকট প্রধানমন্ত্রী সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারলেও, এখন তাকে বেশি হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর জন্য দায়ী একশ্রেণির দুর্নীতিগ্রস্ত ও অর্থপাচারকারী, ব্যাংক লুটেরা।
তিনি আরও বলেন, তারা বিভিন্ন খাতে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশটাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। যদিও সরকার এখন এসব রাঘব-বোয়ালকে শক্ত হাতে ধরা শুরু করেছে।
বুধবার (১২ জুন) সংসদের বৈঠকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে বিকাল ৪টায় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়।
প্রভাবশালীরা কখনও খেলাপি হন না
সালমা ইসলাম বলেন, ঋণখেলাপি এবং নানাভাবে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারীদের বিরুদ্ধে এই মহান সংসদে এযাবৎ কম কথা হয়নি। বলতে বলতে সবাই ক্লান্ত হলেও খেলাপিরা ক্লান্ত হয়নি। মাঝেমধ্যে চুনোপুঁটিদের শাস্তি হলেও প্রভাবশালী খেলাপিরা আছেন বহাল তবিয়তে। বিশেষ করে প্রভাবশালীরা কখনও খেলাপি হন না। তারা প্রভাব খাটিয়ে দফায় দফায় ঋণ পুনর্গঠন করে নেন। ফলে খেলাপের খাতায় তাদের নাম আর ওঠে না।
নামে-বেনামে কারা মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে কীভাবে কোন পদ্ধতিতে বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন, তা অনেকেই না জানলেও কিছু লোক তো জানেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, কয়েকটি ব্যাংকের একশ্রেণির পরিচালকরা কীভাবে এসব ঋণের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, সেটিও তদন্তের দাবি রাখে। এ জন্য ব্যাংকখেকোদের যদি আগে শাস্তি দিতে না পারি, তাহলে দেশ আর ঠিক হবে না।
বেশির ভাগ ব্যাংকের অবস্থা খুবই ভয়াবহ
সালমা ইসলাম বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর দেশ হওয়ার কারণে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় ভিষণ বিপদে পড়ে গেছি। বাংলাদেশ এখন কঠিন এক সংকটকাল পার করছে। কিন্তু এ সংকট এক দিনে হয়নি। এর অন্যতম কারণ লাগামহীন দুর্নীতি ও অর্থপাচার। পরিস্থিতি এখন এমন জায়গায় চলে এসেছে যে সাধারণ মানুষ ছাড়াও ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বেশির ভাগ ব্যাংকের অবস্থা খুবই ভয়াবহ। প্রতিদিন তারা ধারদেনা করে দিন পার করছে। ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে গিয়ে ডলার কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। সামনের দিনগুলোর জন্য আরও খারাপ সংকেত দিচ্ছে।
বিদেশি ষড়যন্ত্র নিয়ে নিজের শঙ্কার কথা উল্লেখ করে সালমা ইসলাম বলেন, নানা কারণে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায় ক্ষমতাধর বিদেশি মোড়লরা যে যার স্বার্থে টুঁটি চেপে ধরার চেষ্টা করছে। যদিও এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী সাহস করে বেশ কিছু সত্য কথা জনসমক্ষে বলে দিয়েছেন। কিন্তু জাতি হিসেবে এখন বেশি শঙ্কিত হওয়ায় স্বার্থান্বেষী মহল যেখানে একবার হাতছানি দিয়েছে, তারা ছলেবলে সে দেশকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এ রকম অঘটনের শঙ্কা নিয়ে অনেকটা উদ্বেগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এখন ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যু সামনে এনে বঙ্গপোসাগরকে কেন্দ্র করে যে সামরিক শক্তির বলয় গড়ে তোলার অপচেষ্টা হচ্ছে, তাতে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কুকিচিনসহ বেশ কিছু সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কিছু কর্মকাণ্ড আমাদের আরও বেশি ভাবিয়ে তুলেছে।
বর্গিরা চারদিকে ফণা তুলছে
তিনি বলেন, সামনে তিস্তা প্রকল্প নিয়ে বেশ কঠিন পরীক্ষা দিতে হবে। অনেকের নজর এখন তিস্তার দিকে। কেউ চায় অস্ত্র বেঁচতে, কেউ চায় তিস্তা প্রকল্পের পুরো নিয়ন্ত্রণ, কেউ আবার বড় ঋণের ঝুলি নিয়ে বসে আছে। কিন্তু তারাও এবার নিজেদের স্বার্থ ষোলআনা উসুল না করে, ঋণ অনুমোদন করবে না। ওদিকে সবচেয়ে এখন বড় সমস্যা হলো ডলার সংকটের কারণে অনেকগুলো বিদেশি পাওনা বা দায়-দেনা পরিশোধ করা যাচ্ছে না। কারণ, দিতে গেলে ডলারের স্থিতি আরও নিচে নেমে আসবে। কিন্তু পাওনাদাররাও বসে নেই। ঘন ঘন তাগাদা দিচ্ছে। এর মধ্যে তারা পাওনা ডলারের জন্য চার্টার্ড বিমানে ঘুরেও গেছে। ফলে পরিস্থিতি ভালো মনে হচ্ছে না। বর্গিরা চারদিকে ফণা তুলে ঘোরাফেরা করছে।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য গোলাম কিবরিয়া বলেন, আর্থিক খাতে সংকট, অর্থপাচার, দুর্নীতি এসবের জন্য দায়ীদের বিরুদ্দে ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের প্রধান সমস্যা এখন দুর্নীতি। এর ব্যাপকতায় অনেক অফিসে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে উন্নয়নের ধারা ব্যাহত হবে। এখন আরেকটি সমস্যা কিশোর গ্যাং। এলাকায় এলাকায় তা মহামারির আকার ধারণ করেছে।
আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য দ্রৌপদী দেবী আগারওয়ালা বলেন, সংসদ সদস্যদের গাড়ি শুল্কমুক্ত ছিল। এবার শুল্ক ধরা হয়েছে। এটা যেন মওকুফ করা হয়। এটা সম্মানের জিনিস, প্রধানমন্ত্রী করে দিয়েছেন। করমুক্ত গাড়ি চাই।
এমপিদের গাড়ি প্রয়োজন, বিলাসিতা নয়
সংরক্ষিত নারী আসনের আরেক সদস্য ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, সংসদ সদস্যদের গাড়িতে শুল্ক বসানোর প্রস্তাব মহৎ উদ্দেশ্য থেকে করা হয়েছে। তবে জনপ্রতিনিধি উপজেলা চেয়ারম্যান, মেয়ররা সরকারিভাবে গাড়ি পেয়ে থাকেন। অনেক সংসদ সদস্যের গাড়ি কেনার সামর্থ্য নেই। কিন্তু তাদের এলাকায় ঘুরে বেড়াতে হয়। এটা তাদের প্রয়োজন, বিলাসিতা নয়। সরকার থেকে গাড়ি বরাদ্দ করা হলে গাড়ি আমদানির প্রয়োজন হয় না।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ বাজেটে অগ্রাধিকার পেয়েছে
তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা বাজেটে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। কোভিড-১৯ ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে মূল্যবৃ্দ্ধির কারণে পুরো বিশ্বে মূল্যস্ফীতির চরম অবস্থা তৈরি হয়। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য এক বছরের মধ্যে কমিয়ে আনার সব প্রচেষ্টার প্রতিফলন বাজেটে আছে। এবার সংকোচনমূলক বাজেট করা হয়েছে।
বাজেটকে জনবান্ধব বাজেট আখ্যা দিয়ে আরাফাত বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সাধারণ মানুষের জন্য বাজেট বৃদ্ধি ও শিক্ষায় বৃদ্ধি করা হয়েছে। সাধারণ মানুষ নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যাদের আয় যত বেশি, তাদের কর বেশি করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যাদের আয় কম, তাদের কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটটি নিম্ন আয়ের সাধারণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে করা হয়েছে।
বিরোধীদের সমালোচনার জবাবে তথ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, অনেকে সমালোচনা করেন। বলেন ঋণ করে ঘি খাওয়ার মতো অবস্থা। ঋণ করার প্রথা বিশ্বজুড়েই আছে। তবে তা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হয়। বাংলাদেশে সেটা জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে আছে। এটা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড।
তিনি বলেন, ২০০৮–২০০৯ সালে ঋণ ছিল ৩৮ বিলিয়ন ডলার, এখন হয়েছে ১৪৯ বিলিয়ন ডলার। এটা অর্ধেক সত্য। ২০০৮-০৯ সালে জিডিপির পরিমাণ ছিল ১১০ বিলিয়ন ডলার। আর এখন ৪২০ বিলিয়ন ডলার। শুধু ঋণ দিয়ে নয়, সম্পদ জিডিপি দিয়ে মাপতে হবে।
তিনি বলেন, বিরোধী দল বলছে খেলাপি ঋণ ২০০৬ সালে ছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। এখন সেটা ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, এটি ঠিক। কিন্তু ২০০৬ সালে যে পরিমাণ ঋণ দেওয়া হয়েছিল খেলাপি ছিল ১৩ শতাংশের বেশি। আর এখন তা ১১ শতাংশের নিচে সুতরাং খেলাপি ঋণ কমেছে।