X
শনিবার, ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫
২৫ মাঘ ১৪৩১

বেদনায় নীল নিহতের পরিবার

কবির হোসেন
১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:০০আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২০:১৩

নিজেদের দৈনন্দিন হিসাবনিকাশের বাইরে পরিবারগুলো দেশ-রাজনীতি নিয়ে বিশেষ কিছু ভাবতো না। কিন্তু জুলাইয়ে পাল্টে যায় তাদের জীবন। একের পর এক শিক্ষার্থী-তরুণের গুলিবিদ্ধ হওয়া আর মৃত্যু দেখে রাস্তায় নেমে আসেন তারা। স্বজনদের হারিয়ে পাল্টে যায় অনেকের জীবন।

আন্দোলনকারীদের জন্য পানির বোতল হাতে রাস্তায় নেমে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধ। তার যমজ ভাই মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ। তিনি জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। রংপুরে জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে গিয়ে এক নিহতের ছোটবোনের সঙ্গে আলাপের বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেছেন তিনি। একটি ছবি শেয়ার করে স্নিগ্ধ লিখেছেন— ‘শ্রাবন-মেঘলা নামটা সুন্দর না? মেঘলা হলো শহীদ শ্রাবনের ছোট বোন। দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলতেছে— ভাইয়া, আমার ভাইটা আর নাই, আপনিই আমার ভাই। আপনাকে আমি আমার ভাইয়ামনি ডাকবো। কখন যে চোখে পানি চলে আসলো, টেরই পেলাম না। আল্লাহ সকল শহীদদের ভালো রাখুক এবং তাদের পরিবারকেও। আমাদের এই ভাই বোনদের জন্য সবসময় আমরা আছি।’

গত ১ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে টানা আন্দোলন শুরু হয়। এরপর ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশে নিহত হয়েছে শত শত প্রাণ, আহত কয়েক হাজার। যারা স্বজন হারিয়েছেন তারা বলছেন, এই দেশ ভালো থাকুক। যে চলে গেছে  তাকে আর ফিরে পাবো না। কিন্তু যদি দেশ তাদের আকাঙ্ক্ষার পথে না থাকে, তবে এই আত্মাগুলো শান্তি পাবে না।

১৫ বছরের ইফতি পরিবারের একমাত্র ছেলে। বৃদ্ধ বাবাকে সংসারের বোঝা থেকে রেহাই দিতে লেখাপড়া ছেড়ে অল্প বয়সে নিজেই গ্যারেজে কাজ নিয়েছিল। তবে বাবার বোঝা আরও বাড়লো! গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময়ে রাজধানীর রামপুরা থানার কাছে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় ইফতি। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বুকভরা কষ্টের ভারকে সঙ্গী করেই দিন গুণতে হচ্ছে ষাটোর্ধ্ব মো. ইউনুস সরদারকে।

জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবারকে সহায়তা করা হচ্ছে

ছেলের কথা বলতেই গিয়ে ইউনুস সরদার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার ছেলে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে ঠিকই। তবে ছেলেটা আমাকে অন্ধকারে রেখে গেছে। বেঁচে থাকলে হয়তো আমি আলোর মধ্যে থাকতাম। দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। তবে দেশ নতুন করে স্বাধীন হলেও আমার তো বেদনা বেড়েছে।। আমাকে এই বয়সে গাড়ি চালাতে হয়। আমার আর কষ্ট কমে না।’

তিনি বলেন, আমি দীর্ঘদিন ধরে ভৈরবে থাকি। ছেলের মারা যাওয়ার পর অনেকে যোগাযোগ করেছে, আশ্বাস দিয়েছে। এছাড়া আর কী! ভৈরবে একজন এক লাখ টাকা দিয়েছিলেন, এর বাইরে আশ্বাস ছাড়া এখনও কিছু পাননি ইফতির বাবা ইউসুফ সরদার।

১৮ জুলাই সহকর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনে গিয়ে মারা গেছেন ৩৮ বছর বয়সী ওয়াসিম শেখ। মাত্র তিন মাসের সন্তান তাসনিয়া বাবার স্পর্শ চিনে ওঠার আগেই চলে গেছেন তিনি। শহীদ ওয়াসিম শেখের বড় ভাই মো. জাহিদ হাসান জসিম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ওয়াসিম মারা যাওয়ার তিন মাস আগে আমাদের বাবা আওলাদ হোসেন শেখ মারা যান। ১১ সদস্যদের পরিবারের মধ্যে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি এখন আমি।

ওয়াসিমের বড় ভাই গর্ব নিয়ে সেদিনের ঘটনার বিবরণ দেন, শনির আখড়া এলাকায় আমার ভাই ব্যবসা করতো। ৮ থেকে ৯ জন সহকর্মী মিলে ওইদিন আন্দোলনে গিয়েছিল। সেখানে আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। এই হারানোর বেদনার কোনও ব্যাখ্যা হয় না।

তিনি জানান, ভাইয়ের মৃত্যুর পর অনেকের কথামতো কাগজপত্র জমা দেন। তবে সরকারিভাবে এখনও কোনও সাহায্য সহযোগিতা পাননি। শুধু জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে তাদের পরিবারকে।

আবেগজড়িত কণ্ঠে জাহিদ হাসান জসিম বলেন, ‘আমার ভাই রক্ত দিয়ে, শহীদ হয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। কিন্তু এখন ভোগ করছে অন্যরা। এত কিছু হলো, মিডিয়ায় কত দেখাচ্ছে। কোথায় আমাদের পরিবারের কথা এখনও তো কেউ বলেনি। আন্দোলনে যারা আমাদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা কী পাচ্ছে। আমাদের এখন একটাই চাওয়া— দেশ যেন সুন্দর ও শৃঙ্খলভাবে চলে।’

একই স্বরে কথা বলেন জুলাই-আগস্ট আন্দোলন নিহত সোহাগের ছোট ভাই শহীদুল ইসলাম। ২৬ বছর বয়সে আন্দোলনে যোগ দিয়ে মারা গেছেন সোহাগ। তিনি ছিলেন পরিবারের বড় ছেলে।

নিহত সোহাগ (কালো পাঞ্জাবি পরা) ও তার পরিবারের ছবি

শহীদুল ইসলাম জানান, তাদের বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার থানার বাণী ইউনিয়নের সূর্যপুর গ্রামে। সোহাগের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর তখন তাদের বাবা মোহাম্মদ আলী মারা যান। এবার বড় ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে তাদের মা জোসনা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

বাবা মারা যাওয়ার পর অভাব-অনটনের মধ্যে তারা দুই ভাই বড় হয়েছেন জানিয়ে শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবা মারা যাওয়ার পর ভাই অল্প বয়সেই কাজের উদ্দেশে ঢাকায় আসেন। রাজধানীর গোপীবাগ এলাকায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে অল্প বেতনে কাজ করতেন। ওইদিন আন্দোলনের ঝামেলা কারণে সারাদিন বাসা থেকে বের হননি ভাই। সন্ধ্যায় বাইরে বের হয়েছিলেন খাবার আনতে। তখন সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হন। পরে ওইদিন রাতেই ঢাকা মেডিক্যালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ভাই তো চলে গেছে, আমরা চাই আমাদের দেশের উন্নতি হোক, দেশ ভালো থাকুক। কিন্তু আমাদের দিকেও সহায়তার দৃষ্টি আসুক। যারা একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বজন হারিয়েছে, তাদের দুর্দশার বর্ণনা বলে বুঝানো যাবে না।’

কেবল ঢাকায় না, আন্দোলনে রাজধানীর বাইরে নিহত হয়েছেন যারা, তাদের একজন চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের সাহাদাত হোসেন (১৬)। ৫ আগস্ট থানার সামনে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় সে। সাহাদাত ছোটবেলা থেকে নানার বাড়িতে বড় হয়েছে। সাহাদাতের নানি মমতাজ বেগমের কান্না বাঁধ মানছে না এখনও।

সাহাদাতের মা শিরতাজ বেগম জানান, সন্তানের বাবা থেকেও নেই, সাহাদাতকে একাই বড় করছি।নানা বাড়িতে ভালো থাকবে ভেবে সাহাদাতকে তার নানির কাছে রেখে গিয়েছিলাম। কিন্তু ছেলেটা ফাঁকি দিয়ে চলেই গেলো। ছেলে হত্যার বিচার চান চেয়ে তিনি বলেন, ‘আর কিছুদিন পর ছেলে কাজে ঢুকলে তার কষ্টকর জীবনের অবসান হবে ভেবেছিলাম। সেটাতো হলো না। এখন ভাবছি, হয়তো সরকার আমাকে সহায়তা দেবে। আমি তো অসহায়।’

এই নারীর চোখের পানি আর রাজধানীতে ভাই হারানো শিপার জীবন-বিমুখ হয়ে ওঠার ঘটনা যেন একই সূতায় গাঁথা। গত ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজের পর রাজধানীর শাহাজাদপুর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন ওয়াসিম (২৫)। সিলেটের জাল্লাবাদ থানার মোল্লাগাঁও এলাকায় ওয়াসিমের গ্রামের বাড়ি। রাজধানীর শাহজাদপুর এলাকায় একটি মুরগির দোকানে কাজ করতেন তিনি। ওয়াসিমের বাবা-মা কেউ নেই। ওয়াসিমের যখন চার বছর বয়স, তখন তার মা মারা যান। একমাত্র বড় বোনই তাকে লালনপালন করেছেন।

ওয়াসিমকে (নীল গেঞ্জি) হারিয়ে পাগলপ্রায় বড় বোন

কথা হয় ওয়াসিমের ভগ্নিপতি রায়হান আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার শাশুড়ি মারা যাওয়ার পর আমরাই তাকে দেখাশোনা করেছি। ওইদিন জুমার নামাজের আগে সে দোকানে ছিল। নামাজের সময় হলে মালিকের কাছ থেকে ছুটি নেয় এবং কিছু টাকাও নেয়। সেই টাকা দিয়ে বিস্কুট কিনে আন্দোলনকারীদের বিলিয়ে দিচ্ছিল সে। আর তখনই মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়। তার বোন শিপা যিনি তাকে কোলেপিঠে মানুষ করেছেন, ভাই হারানোর বেদনা ভুলতে না পেরে অসুস্থ হয়ে বাসায় পড়ে আছেন।

রায়হান জানান, ‘ওয়াসিম মানুষের বিপদে এগিয়ে যেত। সে অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা ছিল। কোনও অন্যায় সহ্য করতো না। যে চলে যাওয়ার সে তো  ফিরবে না। আমরা চাই ওয়াসিমদের আদর্শকে সামনে রেখে দেশটা গড়ে উঠুক।’

/ইউআই/এপিএইচ/এফএস/
সম্পর্কিত
নতুন দল গঠনের চেয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার চান তরুণরা!
কোটা নিয়ে নতুন করে আন্দোলন কেন?
মেডিক্যাল ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা: প্রতিবাদে ঢাবিতে বিক্ষোভ
সর্বশেষ খবর
‘উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধের জন্য, দরকষাকষির জন্য নয়’
‘উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র যুদ্ধের জন্য, দরকষাকষির জন্য নয়’
এবার গৌরীর প্রেমে আমির খান?
এবার গৌরীর প্রেমে আমির খান?
অন্তর্বর্তী সরকার কঠিন সময়ে উপনীত হয়েছে: মান্না
অন্তর্বর্তী সরকার কঠিন সময়ে উপনীত হয়েছে: মান্না
গাজীপুরসহ সারা দেশে যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’
গাজীপুরসহ সারা দেশে যৌথবাহিনীর ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’
সর্বাধিক পঠিত
গাজীপুরে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পিটুনি, ফেসবুকে যা লিখলেন সারজিস আলম
গাজীপুরে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পিটুনি, ফেসবুকে যা লিখলেন সারজিস আলম
৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙার ঘটনায় নিন্দা ও বিচার দাবি ২৬ বিশিষ্ট নাগরিকের
৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙার ঘটনায় নিন্দা ও বিচার দাবি ২৬ বিশিষ্ট নাগরিকের
চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা চালিয়ে প্রকাশ্যে তরুণীকে গুলি করে হত্যা
চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা চালিয়ে প্রকাশ্যে তরুণীকে গুলি করে হত্যা
সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে ভাঙচুরের সময় ১৫ জনকে পিটিয়ে আহত
মসজিদের মাইকে ডাকাতির ঘোষণাসাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে ভাঙচুরের সময় ১৫ জনকে পিটিয়ে আহত
এভাবে আর কতদিন, সমস্যা সমাধান করতে হবে: জনপ্রশাসন সচিব
এভাবে আর কতদিন, সমস্যা সমাধান করতে হবে: জনপ্রশাসন সচিব