‘আমরা আনন্দের সঙ্গে ভোটের লড়াইয়ে নামতে চাই। বহু বছর মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আমরা চাই আসলে নারীরাও যেন সরাসরি ভোটের লড়াই করে।’ বলছিলেন চট্টগ্রামের শিক্ষক ও রাজনীতিক সেলিনা আকতার। তৃণমূলের এই রাজনীতিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সংরক্ষিত আসনে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার বিষয়টি দেশের নারীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা।
বর্তমানে সংসদীয় ব্যবস্থায় ৩৫০টি আসনের মধ্যে ৩০০টি আসন থেকে সরাসরি ভোট ও ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রয়েছে—যা দলীয় মানদণ্ডে মহিলা সংসদ সদস্যের কোটায় নির্ধারিত হয়ে থাকে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে এসেছে ভিন্ন সুপারিশ।
কমিশনের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদকে উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি নিম্নকক্ষের আসন সংখ্যা সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ এবং নারী আসনে সরাসরি ভোটের প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বন্ধে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিধানের সুপারিশও করেছে কমিশন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীদের আসনকেন্দ্রিক বর্তমান পদ্ধতি থেকে বেরোতে দীর্ঘদিন ধরেই দেশের নারী সমাজের পক্ষ থেকে দাবি আসছিল। নির্বাচন সংস্কার কমিশনের কাছে বিভিন্ন নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে দাবি-দাওয়া দেওয়া হয়েছে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, নারী সংহতির সভাপতি শ্যামলী শীল মনে করেন, সংসদে নারীদের জন্য যেভাবে সংরক্ষিত আসন রাখা হয়েছে, সেটা অপমানজনক। আমরা সিলেকশন চাই না, আমরা চাই ইলেকশন। সত্যিকার অর্থে নারীর রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হলে সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার কোনও বিকল্প নাই।
বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে (২০ জানুয়ারি) এই শিক্ষক ও সংগঠক বলেন, ‘বিগত দিনে যেভাবে সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব হয়েছে সেটা ছিল অবমাননাকর। ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রশ্নে সাধারণ সংসদ সদস্যদের মতো সমতা নারীদের ছিল না।’
এই প্রশ্নে একমত পোষণ করেন নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদারও। তিনি বলেন, ‘সংসদে নারীদের সংরক্ষিত আসনের বিষয়টি কোনোদিনও গ্রহণযোগ্য ছিল না, ওইটা ছিল আলংকারিক। এখন আমরা কমিশনের পক্ষে থেকে সরাসরি নির্বাচনের প্রস্তাব করেছি। এতে সংসদ সদস্যদের মধ্যে সমদায়িত্ব, সমমর্যাদা ও সমসুযোগ তৈরি হবে।’
তিনি বলেন, ‘বিগত সংসদগুলোতে আমরা দেখেছি—কারও শ্যালিকা, কারও বউ, কারও ভাবিরা মনোনীত হয়েছে। তারা কেউ প্রার্থিতা করেনি।’
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান মনে করেন, নির্বাচন করতে হলে যোগ্যতার প্রশ্নটি আসে। ভবিষ্যতে এখানে আরও উন্নত অবস্থা তৈরি হবে। সরাসরি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই উন্নতির বিষয়টি উঠে আসবে।
এ ব্যাপারে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে (১৫ জানুয়ারি) ব্যারিস্টার শাকিলা ফারজানা বলেন, ‘নারীরা সব বিষয়ে এগিয়ে, রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন চলছে সমানতালে। সংরক্ষিত আসন মানে নারীদের অবমূল্যায়ন মনে করি। আমি চাই নারীরাও যেন সরাসরি নির্বাচিত হয়ে আসেন।’
সংসদে নারী আসন এবং নারী প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধানের কাছে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে দেশের বিভিন্ন নারী সংগঠন এবং বিভিন্ন সেক্টরের নারী নেতারা। গত ৩০ ডিসেম্বর নারীগ্রন্থ প্রবর্তনায় এক বৈঠকের মাধ্যমে সংসদে নারী আসন এবং নারী প্রতিনিধি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন নারী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিরা।
ওই বৈঠকের বিষয়ে শ্যামলী শীল জানান, ক্ষুব্ধ নারী সমাজ, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ নারী শ্রমিক কেন্দ্র, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা, নারী সংহতি, হিল উইমেনস ফেডারেশন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ, স্পেস ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ শ্রমজীবী নারী মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক নারী জোট, বাংলাদেশ লেখক সংঘ, নাগরিক নারী ঐক্য, নারী মুক্তি কেন্দ্র, বিপ্লবী নারী ফোরামের পক্ষ থেকে আমরা দাবি দিয়েছি। যা নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদারের কাছে পাঠানো হয়। তিনি এর প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন।
রবিবার (২০ জানুয়ারি) বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে শ্যামলী শীল বলেন, ‘আমরা বেশ কয়েকটি প্রস্তাব করেছি। নারীর জন্য সুনির্দিষ্ট ১০০ আসন ও সরাসরি নির্বাচনের সুযোগ, ১০০ আসন ৬৪ জেলার মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে ভাগ করা এবং কমপক্ষে প্রতিটি জেলায় ১টি নারী আসন থাকবে, যাতে সর্বমোট ১০০টি আসন নিশ্চিত হয়।’
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রস্তাবনা সরকারের কমিশনের কাছে দিয়েছি। এটি প্র্যাকটিক্যালি ভাবার দরকার আছে। আসন সুনির্দিষ্ট না করলে পুরুষ প্রার্থীও থাকে, তাহলে পুরুষও দাবি করতে পারে।’
প্রসঙ্গত, নারী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দেওয়া প্রস্তাবে আরও ছিল— এক জেলার মধ্যে যে আসনটি প্রথমবার সংরক্ষিত থাকবে পরবর্তী মেয়াদে সেটা সরাসরি আসন হিসেবে বিবেচিত হবে, এভাবে এক জেলার মধ্যে নারী আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে চলবে। ফলে নতুন নারী নেতৃত্ব তৈরি হবে।
পার্বত্য জেলাসহ (অন্তত দুটি জেলায় পাহাড়ি-আদিবাসী নারী) এবং অন্যান্য আদিবাসী অধ্যুষিত জেলাগুলোতে আদিবাসী নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার দাবিও জানিয়েছেন নারী নেতারা।
তাদের দাবি, রাজনৈতিক দলগুলো সব নির্বাচনে মনোনীত সদস্যদের মধ্যে অন্তত ৩৩ শতাংশ নারী মনোনয়ন দেবে।
কমিশনের প্রস্তাবে যা আছে
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেওয়া প্রস্তাবে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ১৬টি সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশগুলোর মধ্যে নারীদের বিষয়ে বিভিন্ন ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে। কমিশনের প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের বিষয়ে পৃথক সুপারিশ করেছে কমিশন।
৪ নম্বর সুপারিশে বলা হয়েছে, সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে ১০০ আসন নিয়ে সংসদের উচ্চকক্ষ সৃষ্টি করা। সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের হারের ভিত্তিতে (সংখ্যানুপাতিকভাবে) আসন বণ্টন করা। উচ্চকক্ষের নির্বাচনে প্রত্যেক দলের প্রাপ্ত আসনের ৫০ শতাংশ দলের সদস্যদের মধ্য থেকে এবং অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ আসন নির্দলীয় ভিত্তিতে নাগরিক সমাজ, শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী, মানবসেবা প্রদানকারী, শ্রমজীবীদের প্রতিনিধি, নারী উন্নয়নকর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ইত্যাদির মধ্য থেকে সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচিত করার বিধান করা। তবে দলীয় ও নির্দলীয় সদস্যদের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নারীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার শর্তও যুক্ত করেছে কমিশন।
সংসদ নির্বাচনে নারীর প্রতিনিধিত্ব শীর্ষক ৫ নম্বর সুপারিশে কমিশন উল্লেখ করেছে, সংসদের (নিম্নকক্ষ) আসন সংখ্যা ১০০ বাড়িয়ে মোট সংখ্যা ৪০০ করা। এই ৪০০ আসনের মধ্যে নারীদের জন্য নির্ধারিত ১০০ আসন ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নির্বাচনের বিধান করা, যাতে যোগ্যতার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট আসন থেকে নারীদের সরাসরি নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং দ্বৈত প্রতিনিধিত্বের সুযোগ বন্ধ হয়।
কমিশন প্রধান অধ্যাপক মজুমদার বলেন, ‘নারীদের প্রকৃত ক্ষমতায়নে তাদের জন্য সরাসরি নির্বাচনই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যাপার। তাদের জন্যও সংসদীয় এলাকা থাকা দরকার। এটাই উন্নত পদ্ধতি। সরাসরি সংসদীয় আসনে নারীরাও নির্বাচিত হবেন এবং দ্বৈত প্রতিনিধিত্ব বন্ধ হবে। যারা যোগ্য তারা নির্বাচিত হবেন।’ ‘তবে মনোনয়ন বাণিজ্যও হবে’, এমন আশঙ্কার কথাও জানিয়েছেন এই বিশিষ্টজন।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে ৯ নম্বর সুপারিশে কমিশন প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকারের সব পর্যায়ে ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে নারীর জন্য আসন সংরক্ষণের বিধান করার।
কমিশনের প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরাও সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন চাই। তবে কোন পদ্ধতিতে হবে, সেটি তো আমরা এখনও জানি না। সরকারের পক্ষ থেকে আলাপটা এলে আমরা দলীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারবো।’
আরও পড়ুন: