X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

পায়রা বন্দরকে ঘিরে তৎপর দালালগোষ্ঠী, ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী

শফিকুল ইসলাম, পায়রা বন্দর, (কলাপাড়া) থেকে ফিরে
২৩ আগস্ট ২০১৬, ০৭:৫২আপডেট : ২৩ আগস্ট ২০১৬, ১৯:১৭
image

পায়রা বন্দর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নে নির্মাণাধীন পায়রা বন্দরে শ্রমিকের কাজ নিতে হলে এখনই নাম নিবন্ধন করতে হবে। এর জন্য দিতে হবে টাকা। টাকা দিলেই মিলবে কার্ড। টাকা না দিলে নাম নিবন্ধন হবে না। কার্ডও পাওয়া যাবে না। আর নাম নিবন্ধন না হলে, কার্ড না পেলে বন্দরে শ্রমিকের কাজও পাওয়া যাবে না, এমন অজুহাতে অসহায় গরিব মানুষদের কাছ থেকে প্রতিদিন টাকা আদায় করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
লাইটারেজ জাহাজ মালিক সমিতি, লাইটারেজ জাহাজ শ্রমিক সমিতি, পায়রা বন্দর শ্রমিক কল্যাণ সমিতিসহ নতুন নতুন শ্রমিক সংগঠনের নামে তোলা হচ্ছে এই টাকা। অসহায়, নিরক্ষর শ্রমিকরা কিছু বুঝে বা না বুঝেও আগামী দিনগুলোয় এই বন্দরে শ্রমিকের কাজ পেতে টাকা তুলে দিচ্ছেন ওই সব শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের হাতে। এ ক্ষেত্রে টাকার কোনও নির্দিষ্ট হার নেই; যার কাছ থেকে যা পারছেন, তাই হাতিয়ে নিচ্ছেন তারা। কেউ পাঁচশ, কেউ এক হাজার, যে যা পারছেন তাই দিয়ে শ্রমিকের কাজ পেতে কার্ড সংগ্রহ করছেন।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় কিছু ক্ষমতাসীন দলের পাতি পর্যায়ের নেতাদের এই কাজে ইন্ধন রয়েছে। প্রকাশ্যে এ সব সংগঠনের কোনো নেতার খোঁজ মেলেনি। এরা আড়ালে, আবডালে, লোকচক্ষুর অন্তরালে গিয়ে এ কাজগুলো করছেন। এ কারণেই প্রশাসনের কর্মকর্তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন।
দেশের তৃতীয় সমুদ্র পায়রা বন্দর নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের কাজ চলছে। একদিকে সরকার নৌঘাঁটি, চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র, চার লেনের সড়ক, অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মূল বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ করছে। এই সুযোগে দেশের বেসরকারি শিল্প মালিকরাও তাদের শিল্প-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সরকারি অধিগ্রহণকৃত জমির আশেপাশে বাড়িঘর, গ্রামের রাস্তা, ধানের জমি কিনে নিচ্ছেন। সরকার যে দামে জমি কিনছে, এ সব ব্যবসায়ীরাও সেই একই দামে জমি তাদেরকে দেওয়ার জন্য এলাকাবাসীর ওপর বলপ্রয়োগ করছেন। চাপ দিচ্ছেন। জমি দিতে রাজি না হলে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

জমি দেওয়ার পরেও মুক্তি নেই। জমির মূল্য পেতে এলাকাবাসীকে ধর্ণা দিতে হচ্ছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। জমির মালিকেরা, ওই সব ব্যবসায়ীদের নিয়োজিত স্থানীয় এজেন্টরা এলাকাবাসীকে হয়রানি করছেন নানাভাবে।  

পায়রা বন্দর সরেজমিন দেখা গেছে, যেখানে বর্তমানে নৌ-জেটি করা হয়েছে, তার পাশেই দেশের একটি বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ বিস্তর জমি কিনে তা পায়রা বন্দরের নৌচ্যানেল (রামনাবাদ চ্যানেল) এলোপাথাড়িভাবে খনন করে বালু তুলে সেই জমি ভরাট করেছে। এতে চ্যানেলটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সাবেক পানি সম্পদমন্ত্রী ও পটুয়াখালী- ৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান। ওই ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিক সরকারদলীয় একজন সংসদ সদস্য, যিনি ঢাকা থেকে নির্বাচিত।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কলাপাড়া উপজেলার বালিয়াতলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. হুমায়ুন মিয়া বলেছেন, জমির দাম এত কম ধরা হয়েছে তাতে মনে হয়, দেশে শায়েস্তা খানের রাজত্ব চলছে। যে জমিতে সারাবছর ধান জন্মে, সেই জমির শতাংশ কী করে ১৪ হাজার টাকা হয়? পৃথিবীর কোথায় এত কম দামে জমি পাওয়া যায়! এ ছাড়া এই টাকা পেতেও চলছে ডিসি অফিসের ঘুষ বাণিজ্য। বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীকেও ভিডিও কনফারেন্সে জানিয়েছি। তিনি বিষয়টি দেখার জন্য জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক শামীমুল হক সিদ্দিকী বলেছেন, কোথাও কোনো অনিয়ম হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  

বন্দর সূত্রে জানা গেছে, কলাপাড়া উপজেলায় লালুয়া ইউনিয়নে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হবে। এ বিষয়টিও এলাকাবাসীকে ক্ষুব্ধ করেছে। এত ছোট জায়গায় চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের কোনও প্রয়োজন নেই। এখানে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই যথেষ্ট। এই চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মণেও চলছে জমি অধিগ্রহণ। কারও সঙ্গে কোনও কথা না বলে দালালরা পছন্দের জমিতে গিয়ে অধিগ্রহণের এই সাইনবোর্ড লাগাচ্ছেন।

এ প্রসঙ্গে এলাকার সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান বলেন, কোনও কারণ নেই, কোনও যুক্তি নেই, এখানে চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের। একটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই যথেষ্ট। তিনি বলেন, এলাকাবাসীর বাড়িঘর, কবরস্থান, শ্মশানঘাট বিলুপ্ত করে চারটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জমি দেওয়া সম্ভব নয়। সরকার প্রয়োজন মতো জমি অধিগ্রহণ করবে সেখানে কারও কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু বেসরকারিখাতের লোকজন তাদের ব্যবসা প্রসারের জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবেন, আর এলাকাবাসীকে জমির দাম দেবেন না, এটা রীতিমতো অন্যায়!‍ এটা জুলুম! এটা হতে দেওয়া যায় না।

মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, বিষয়টি আমি নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান ও নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নিজামউদ্দিন আহমেদকেও বলেছি। অধিগ্রহণকৃত জমি মাটি ভরাটের জন্য কারও সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে চ্যানেল থেকে বালু তুলে চ্যানেলটির ক্ষতি সাধন করা হয়েছে।        

উল্লেখ্য, গত ১৩ আগস্ট পায়রা বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফরেন্সের মাধ্যমে চীন থেকে নির্মিতব্য পদ্মা সেতুর জন্য পাথর নিয়ে আসা এমভি ফরচুন বার্ড জাহাজ থেকে পণ্য খালাসের মধ্য দিয়ে এ বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। তবে মূল বন্দরসহ এর অবকাঠামো নির্মাণ কাজও চলছে।

পায়রা বন্দর এদিকে, বন্দর নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ ও বন্দরকে কেন্দ্র করে নানান ধরনের দালাল গোষ্ঠীর কর্মতৎপরতা এলাকাবাসীকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এছাড়া অধিগ্রহণকৃত জমির দাম ধরা হয়েছে খুবই কম। অপরদিকে, সেই জমির মূল্যবাবদ টাকা পেতে ধরতে হচ্ছে দালাল। এই দালালরা জেলা প্রশাসক (ডিসি) অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ হারে ঘুষ রেখে প্রকৃত মালিকদের হাতে তুলে দিচ্ছেন জমির বাকি টাকা। বিষয়টিতে এলাকাবাসী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ঘটনাটি এলাকার জনপ্রতিনিধিরাও সরকারের ওপর মহলকে অবহিত করেছেন। তারপরেও এর শেষ রক্ষা হচ্ছে না। থেমে নেই পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে নানামুখী প্রতারণা।
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার লালুয়া ইউনিয়নের প্রায় পুরোটাই যাচ্ছে পায়রা বন্দর নির্মাণে। দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর পটুয়াখালীর পায়রা বন্দরের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর প্রক্কালে পায়রা সমুদ্র বন্দর কর্তৃপক্ষের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন এম. সাইদুর রহমান (ট্যাজ) বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, তিন স্তরের পরিকল্পনায় পায়রা বন্দরকে কেন্দ্র করে এখানে নির্মিত হচ্ছে- কনটেইনার, বাল্ক, সাধারণ কার্গো, এলএনজি টার্মিনাল, পেট্রোলিয়াম ও যাত্রী টার্মিনাল। সে সঙ্গে অর্থনৈতিক অঞ্চল,  তৈরি পোশাক শিল্প, ওষুধশিল্প, সিমেন্ট শিল্প, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল, সার কারখানা, তেল শোধনাগার, বিমান বন্দর ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পসহ আরও অনেক শিল্পকারখানা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এলএনজি টার্মিনাল নির্মিত হলে গ্যাসের মাধ্যমে এখানেই সার কারখানা চালু করা সম্ভব হবে। ইপিজেড, এসইজেড, জাহাজ নির্মাণ এবং মেরামতখাতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন, এক সময় গভীর সমুদ্র বন্দরে পরিণত হবে পায়রা বন্দর।
২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় লালুয়া ইউনিয়নের পাশে রামনাবাদ চ্যানেলের পশ্চিম তীরে দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হিসেবে পায়রা বন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ওই বছরের ৫ নভেম্বর জাতীয় সংসদে পায়রা বন্দর আইন পাস হয়। এর পরপরই পায়রা সমুদ্র বন্দরের জন্য ১৬ একর জায়গায় সীমিত আকারে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়। একহাজার ১২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে টার্মিনাল, পন্টুন, নিরাপত্তা ভবন এবং অভ্যন্তরীণ কিছু সড়ক নির্মাণ ও জমি ভরাট করা হয়েছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, উদ্বোধনের পর থেকে এ বন্দরকে পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে তোলার জন্য তিনটি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রথম লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, এখানে হবে বন্দরের বহির্নোঙরে ক্লিঙ্কার, সার ও অন্যান্য বাল্ক পণ্যবাহী জাহাজ আনয়ন ও লাইটার জাহাজের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরে পরিবহন করে স্বল্প পরিসরে কার্যক্রম শুরু করা।

দ্বিতীয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, আগামী ২০১৮ সালের মধ্যে পায়রা বন্দরে অন্তত একটি কনটেইনার টার্মিনাল ও একটি বাল্ক টার্মিনাল প্রস্তুত করা এবং তৃতীয় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পরবর্তী পাঁচ বছরের মধ্যে (২০২৩ সাল) ধাপে ধাপে বন্দরের অন্যান্য আনুষঙ্গিক পূর্ণাঙ্গ সুবিধা গড়ে তোলা। এ অপারেশনাল কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে প্রথম ধাপের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে।

/এসআই/এবি/

আপ- /এসএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘বারবার নিষেধের পরেও চালক বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছিলেন বাসটি’
‘বারবার নিষেধের পরেও চালক বেপরোয়া গতিতে চালাচ্ছিলেন বাসটি’
পোশাকশ্রমিকদের ৯ দাবি
পোশাকশ্রমিকদের ৯ দাবি
প্রতিদিন ১০ হাজার কদম হাঁটলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
প্রতিদিন ১০ হাজার কদম হাঁটলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
ইসরায়েলকে নিষিদ্ধের দাবিতে আইনি পরামর্শ চায় ফিফা
ইসরায়েলকে নিষিদ্ধের দাবিতে আইনি পরামর্শ চায় ফিফা
সর্বাধিক পঠিত
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বিতর্ক
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বিতর্ক