জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান উপলক্ষে ‘গণঅভ্যুত্থান ২০২৪: জাতীয় ঐক্য ও গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। মঙ্গলবার (১ জুলাই) রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত এই সভায় বিএনপিসহ প্রায় ২১টি দলের নেতারা বক্তব্য দেন। তবে এসব বক্তব্যে সরাসরি সরকারবিরোধী কথা কিংবা কটাক্ষ করতে দেখা যায়নি কাউকে। বরং বক্তারা নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার ঘাটতি, ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা এবং জাতীয় রাজনীতির চলমান প্রেক্ষাপটে সংস্কারের বিষয়ে আত্মসমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন।
বক্তব্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে রাজনৈতিক দলগুলো চিন্তাভাবনা করেই প্রস্তাব দিচ্ছে এবং সবাই জনগণের কথা বিবেচনা করেই উত্তম প্রস্তাব উপস্থাপন করছে। তবে প্রতিটি প্রস্তাব বাংলাদেশের বাস্তবতায় কতটা উপযোগী, তা খতিয়ে দেখা দরকার।’
সংখ্যানুপাতি পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ছাড়া অন্য দলগুলোর একমত হওয়ার বিষয়টি বিএনপির জন্য ভাবনার বিষয় হয়ে উঠেছে তা তারেক রহমানের বক্তব্যে ফুটে ওঠে। তিনি আরও বলেন, ‘কোনও কোনও রাজনৈতিক দল সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনের পদ্ধতি চালুর প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশে এ পদ্ধতি থাকলেও বাংলাদেশের ভূগোল, রাজনীতি ও বাস্তবতায় এটি কতটা কার্যকর হবে তা ভেবে দেখা জরুরি।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বলা হচ্ছে—বিএনপি নাকি সংস্কার মানে না! অথচ আমরাই তো সংস্কারের কথা তুলেছি। বিএনপিকে একতরফাভাবে দোষারোপ করা জাতীয় ঐক্যের জন্য সহায়ক নয়।’
একই সুরে বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসও। তিনি বলেন, ‘বিএনপি বলছে না যে, তারা এখনই ক্ষমতায় যেতে চায়। আমাদের প্রতিপক্ষ ভেবে জাতিকে বিভক্ত করবেন না।’
অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘কেউ যদি ভাবেন ৫ আগস্টের মতো ঐক্যবদ্ধ থাকবো, আমি বলি—দ্বিমত থাকবে। তবে সেটা গণতান্ত্রিকভাবে সমাধান চাই, গুন্ডামি, জবরদখল, গুম-খুনের মতো পন্থায় নয়। এ ব্যাপারে আমরা কমবেশি সবাই একমত।’ এসময় বিএনপির কাছে জনগণের প্রত্যাশা বেশি বলেও দলটির নেতাকর্মীদের মনে করিয়ে দেন তিনি।
নিজেদের মধ্যে বিভেদ দূর করার বিষয়ে জোর দিয়ে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘একটি দেশের জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব শুধু বহিঃশক্তির সঙ্গে সম্পর্ক নির্ভর করে না। এটি দেশের জনগণ কীভাবে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত থাকে, তার ওপরও নির্ভর করে। যদি জনগণ নিজেরা বিরোধ মীমাংসা করতে না পারে, তাহলে তারা বহিঃশক্তির কাছে বাধ্য হয়ে পদানত হবে।’
এদিকে সবশেষ বক্তব্যে বিএনপির চেয়াপারসন বেগম খালেদা জিয়া সবাইকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আমাদের সামনে যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে—নতুন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার, তা আমাদের দ্রুত সম্পন্ন করতে হবে। এই রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রুধারা যেন বৃথা না যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। ঐক্য বজায় রাখতে হবে।’
গত বছর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার শপথ নেওয়ার শুরু থেকে কিছুদিন বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ দলই নিরঙ্কুশ সমর্থন জানায়। তবে পরে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সরকারের সঙ্গে মতানৈক্য তৈরি হয়। বিশেষ করে দেশের অন্যতম বড় দল বিএনপি এবং তাদের সমমনা দলগুলোর সঙ্গে সরকারের বিরোধ প্রকাশ্যেই দেখা যায়। দলটির নেতারা নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচিতে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড, বিশেষ কয়েকজন উপদেষ্টাকে নিয়ে প্রায়শই সমালোচনা করতেও দেখা যেতো। অবশ্য শেষ পর্যন্ত যুক্তরাজ্যে সরকার প্রধান অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ‘আন্তরিক বৈঠকের’ পর সেই বিরোধ অনেকটাই কমে আসে। বৈঠক থেকেই যৌথ প্রেস ব্রিফিংয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়সীমার বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে ঐকমত্যে আসে সরকার।
সেই বৈঠকের ফলেই কি এই আলোচনা সভায় বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোর নেতারা সরকারের সমালোচনা করলেন না— এমন প্রশ্নের উত্তর জানতে বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তারা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তাদের ভাষ্য, এই আয়োজনটি ছিল জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে। এখানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল সেই অভ্যুত্থানে যুক্ত থাকা দলগুলোর ভূমিকা, দায় এবং ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান বলেন, বিএনপি শুরু থেকেই সরকারকে সহযোগিতা করছে। গঠনমূলক সমালোচনা করা মানে সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নয়।
তিনি বলেন, বিশেষ করে সরকার প্রধান ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস স্যারের সঙ্গে বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বৈঠকের মধ্য দিয়ে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনের যে ইঙ্গিত দিয়েছেন, যেখানে দেশবাসী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনমুখী হয়েছেন; সেখানে সবার দায়িত্ব নির্বাচন বিষয়ে ইতিবাচক চিন্তা করা।
শায়রুল কবির উল্লেখ করেন, ‘প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির সবাই দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বক্তব্য দিয়েছেন।’
আলোচনায় আরও বক্তব্য দেন, জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের প্রধান মোস্তফা জামাল হায়দার, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ, এনপিপির চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, এলডিপির মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, এনসিপির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফুল ইসলাম আদিব, এনডিএম’র চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগরীর সভাপতি মাওলানা জোনায়েদ আল হাবিব, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিব মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দি, বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান, খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির আহমদ আলী কাসেমি, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ রাশেদ খান, জনতার অধিকার পার্টির ইসমাইল হোসেন সম্রাট, পিপলস পার্টির বিলকিস খন্দকার।