X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিধবা হিন্দু রোহিঙ্গা নারীরা বললেন নির্যাতনের কথা

আমানুর রহমান রনি, টেকনাফ থেকে
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ০৩:০০আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৪৫

নৃশংস নির্যাতনের বর্ণনা দিলেন হিন্দু রোহিঙ্গা নারীরা মুসিলম রোহিঙ্গাদের মতো হিন্দু রোহিঙ্গাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যরাও মিয়ানমারের রাখাইনে হামলার শিকার হয়েছে। তাদের পাহাড়ের ওপরে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। রোহিঙ্গা গ্রামগুলোতে হত্যাকাণ্ড ও লুটতরাজের সময় হামলাকারীরা খুব কম সময় নিতো। তারা দ্রুত হামলা, হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লুট করে চলে যেত। হামলা থেকে রেহাই পায়নি নারী ও শিশুরাও।
উখিয়ার পশ্চিম কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা হিন্দু ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া বিধবা নারীরা এভাবেই জানান তাদের ওপর নির্যাতনের কথা। এই ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ১৩৩ রোহিঙ্গা হিন্দু নারীর মধ্যে সাত জনের স্বামীকে হত্যা করা হয়েছে। তারা বলছেন, হিন্দু বলে তারা কোনও ধরনের ছাড় পায়নি নির্যাতন থেকে।
রাখাইনে হিন্দু রোহিঙ্গাদের ওপর এমন নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে প্রমীলা শীলের (২৫) পরিবার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার স্বামীর নাম স্বপন শীল। তারা রাতে আমাদের বাড়িতে ঢোকে। সবার মুখে ছিল মুখোশ। তারা প্রথমেই আমাদের মোবাইল কেড়ে নেয়। নারী-পুরুষ আলাদা লাইনে বসায়। গরু-ছাগল লুট করার পর সবাইকে পাহাড়ে উঠতে বলে। নারীরা উঠতে না পারায় তাদের বেত দিয়ে পেটাতে থাকে।’
প্রমীলা শীল আরও বলেন, ‘পাহাড়ের ওপরে তুলে পুরুষদের হত্যা করা হয়। তারা অনেক ধারালো দা নিয়ে এসেছিল। মুহূর্তেই হত্যা ও লুট করে পালিয়ে যায় তারা।’ তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, জা ও জায়ের ছেলেকে হত্যা করে তারা। আমার জায়ের মেয়ে এখনও নিখোঁজ। শুনেছি সে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আছে। তবে তাকে এখনও খুঁজে পাইনি।’
স্বামী ফুবন ধরকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানালেন আরেক হিন্দু রোহিঙ্গা রিত্তা ধর। অন্তঃসত্ত্বা রিত্তা স্বামী-সংসার হারিয়ে এখন দিশেহারা।
স্বামী হারিয়ে বিধবা হয়েছেন এই হিন্দু রোহিঙ্গা নারীরাও নিজেদের ওপর নির্যাতনের ঘটনার বর্ণনা দেন আরেক হিন্দু নারী অনিকা ধর। মাত্র ১৬ বছর বয়সে মিলন শীলের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। মংডুর ফকিরা বাজার এলাকায় তাদের বাড়ি। সেখানে তার স্বামী সেলুনে কাজ করতেন।
অনিকা বলেন, ‘গত ২৭ আগস্ট সকাল ৮টায় আমাদের গ্রামে ঢোকে তারা। প্রথমে আমার স্বামীর কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নেয়। পরে স্বামীকে মারধর করে। হাত-পা বেঁধে ফেলে। তারা সবাই ছিল মুখোশ পড়া, তাদের শুধু চোখ দেখা যায়। সোনা-গয়না যা ছিল তা সব চেয়ে নিয়েছে।’ কারা হামলা চালিয়েছিল তা না বলতে পারলেও অনিকা জানান, তারা শুদ্ধভাষায় কথা বলছিল।
অনিকা ধর বলেন, ‘তারা এলাকাবাসী সবাইকে মারধর করে পাহাড়ে নিয়ে গেছে। এসময় বেত দিয়ে সবার পায়ের নিচে পিটিয়েছে, আর দা দিয়ে কুপিয়েছে। এভাবেই তারা সবাইকে মেরে ফেলে।’ তিনি বলেন, ‘আমি তাদের কথামতো চলায় প্রাণে বেঁচে গেছি। আমার সঙ্গে আরও সাত জন নারী বেঁচে গেছে। তারা সবাই বাংলাদেশে আসতে পেরেছে কিনা জানি না। কিন্তু আমি মুসলিম নারীদের সঙ্গে চলে এসেছি।’
পূজা মল্লিক (২১) নামে আরেক গৃহবধূ জানান, স্বামী আশিষ কুমার ও তিন বছর বয়সী সন্তান রাজাকে নিয়ে তারা থাকতেন রাখাইনের মংডুর রেইক্যা পাড়ার ফকিরা বাজার এলাকায়। সেখানে একটি সেলুন চালাতেন আশিষ। স্বামী-সন্তান নিয়ে ভালোই চলছিল পূজার সংসার। কিন্তু ২৭ আগস্ট সকালে হঠাৎ করে এলোমেলো হয়ে যায় সব।
হিন্দু রোহিঙ্গারা থাকছেন কুতুপালংয়ের এই এলাকায় পূজা বলেন, ‘গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে সবার। তারপর বাইরে বের হতেই দেখি ঘরবাড়ি পুড়ছে আগুনের শিখায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাড়ির সব পুরুষকে বেঁধে ফেলে কালো পোশাকধারীরা। একে একে হত্যা করা হয় আমার স্বামী আশিষ, শ্বশুর বলরাম, শাশুড়ি অনু বালা, দেবর খুশিস কুমার ও ননদ ঝুনু বালাকে। ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যাই আমি। এরপর প্রতিবেশী মুসলিম নারীদের সঙ্গে বোরকা পড়ে বাংলাদেশে চলে আসি।’
কক্সবাজারের আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ঘুরে দেখা গেছে, রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসা হিন্দু পরিবারগুলোকে রাখা হয়েছে পশ্চিম কুতুপালং ক্যাম্পে আগে থেকে অবস্থান করা ১৬টি হিন্দু পরিবারের সঙ্গে। একটি পরিত্যক্ত মুরগীর খামারেও থাকছে কয়েকটি পরিবার। সেখানেই রান্না করে খাওয়ানো হচ্ছে তাদের। এছাড়া ত্রাণও দেওয়া হচ্ছে।
হিন্দু পরিবারগুলোকে দেখাশোনার জন্য একটি কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রধান সুজন শর্মা। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিয়ানমার থেকে মোট মোট একশ ৬২ পরিবারের পাঁচশ ১৮ জন হিন্দু এসেছেন। এর মধ্যে নারী একশ ৩৩ জন। তাদের মধ্যে ১০ জন সন্তানসম্ভবা, সাত জন বিধবা। সোমবার একজনের সন্তান প্রসবের কথা রয়েছে। এক থেকে ১০ বছরের মেয়ে শিশু ৬৫টি, ছেলে শিশু ৯৫টি, বৃদ্ধ আট জন। বাকি একশ ২৮ জন পুরুষ।’
রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্য সেবা ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে থাকে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘মুক্তি’। এ প্রতিষ্ঠানের স্বাস্থ্যকর্মী সুমা শর্মা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেসব হিন্দু নারী সন্তানসম্ভবা, তাদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হচ্ছে। তাদের জন্য যতটাসম্ভব বাড়তি যত্নের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি আমরা।’
আরও পড়ুন-
জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় অনীহা রোহিঙ্গা নারীদের
এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের মুখে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বর্বরতার কথা

/টিআর/
সম্পর্কিত
অস্ত্র ও গুলিসহ ৫ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক
উখিয়া ক্যাম্পে রোহিঙ্গা যুবককে কুপিয়ে হত্যা
কক্সবাজার জেলার রোহিঙ্গা ভোটারদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ