X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

মেয়রের পদত্যাগের পর আইনের ফাঁদ

শাহেদ শফিক
২৯ জানুয়ারি ২০২০, ২১:৫৪আপডেট : ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ২২:৩৮

 

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯

সিটি করপোরেশনের মেয়র পদটি লাভজনক হওয়ায় কেউ পরের মেয়াদে নির্বাচন করতে চাইলে আইন অনুযায়ী তফসিল ঘোষণার পরপরই সেই মেয়রকে পদত্যাগ করতে হবে। আর তফসিল ঘোষণা হবে মেয়াদপূর্তির আগে ১৮০ দিনের ভেতরে। নির্বাচনটি যদি মেয়রের মেয়াদপূর্তির শেষদিকে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে তেমন কোনও সমস্যা নেই, কিন্তু বেশ আগে অনুষ্ঠিত হলেই দেখা দেয় মেয়রের অনুপস্থিতি ও অন্তর্বর্তী দায়িত্ব পালনকে ঘিরে অনেক প্রশ্ন। চলমান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) নির্বাচনের তফসিল অনেক আগে ঘোষণার পর স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) ২০০৯ আইনটির এমন বেশ কিছু অস্পষ্টতা ও ফোকর খুঁজে পেয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আইনটির দুর্বল দিক হচ্ছে, প্রথমত মেয়র পরের নির্বাচনে অংশ নিলে তার মেয়াদ তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়, ক্ষেত্রবিশেষে তা ৬ মাস আগেও শেষ হতে পারে। দ্বিতীয়ত, যিনি জয়ী হবেন তাকে চলমান বোর্ডের মেয়াদপূর্তির জন্য বসে থাকতে হবে লম্বা সময়–ক্ষেত্রবিশেষে সে সময়কাল পাঁচ মাস পর্যন্ত হতে পারে। চাইলেও আইনের বাধায় আগে তাকেসহ নতুন কাউন্সিলরদের নিয়োগও দেওয়া যাবে না। যেমন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের চলমান নির্বাচনের পর নির্বাচিতদের বসে থাকতে হবে সাড়ে তিন মাস। আইনের বাধা থাকায় চাইলেও এর আগে দায়িত্ব পাবেন না নবনির্বাচিতরা। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে নির্ধারিত মেয়াদপূর্তির আগেই কারও দায়িত্ব পালনের সুযোগ শেষ হয়ে যাওয়া মানে ওই মেয়র ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, পাশাপাশি জনগণকেও সেবা পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা। কারণ, মেয়র দায়িত্ব ছাড়ার পর প্যানেল মেয়র বা প্রশাসক– কারোরই আর্থিক বিষয়ে বড় কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকে না। ফলে নাগরিকদের সুবিধাও দিতে পারেন না অন্তর্বর্তী দায়িত্বরত ব্যক্তি।   

অন্যদিকে, মেয়র পদত্যাগ করলে দায়িত্ব পাওয়ার কথা একজন প্যানেল মেয়রের। প্রত্যেক সিটি করপোরেশনে ক্রমানুসারে তিন জন প্যানেল মেয়র থাকেন। তবে প্যানেল মেয়রদের হাতেও নির্বাচনকালীন দায়িত্ব না দেওয়ার নজির এবার ডিএনসিসিতে তৈরি করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্যানেল মেয়ররা অংশ নিচ্ছেন এই অজুহাতে তাদের বদলে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন অনুযায়ী এর সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে সরকার দ্বৈতনীতি অবলম্বন করেছে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় সেখানে এই সমস্যা তৈরি হয়নি।

স্থানীয় সরকার ( সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯-এর ৯ ধারার ২ উপধারার (ঙ) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘কোনও ব্যক্তি মেয়র বা কাউন্সিলর নির্বাচিত হইবার যোগ্য হইবেন না, যদি প্রজাতন্ত্রের বা সিটি করপোরেশনের বা কোনও সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের বা অন্য কোনও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কোন লাভজনক পদে সার্বক্ষণিক অধিষ্ঠিত থাকেন।’

এই আইনটির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গত ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের উপ-সচিব মো. আতিয়ার রহমানের সই করা এক বিশেষ পরিপত্রে বলা হয়েছে, ‘সিটি করপোরেশন একটি সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ বিধায় সিটি করপোরেশনের মেয়র পদটিকে হাইকোর্ট লাভজনক পদ হিসেবে ঘোষণা করেছে। কাজেই স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯ অনুযায়ী, মেয়র পদে অধিষ্ঠিত কোনও ব্যক্তি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণে অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। তবে ওই ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক হলে, তাকে পদত্যাগ করে প্রার্থী হতে হবে। কাউন্সিলর পদধারীরা লাভজনক পদে সার্বক্ষণিক অধিষ্ঠিত নয় বলে তাদের পদে থেকে প্রার্থী হওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোনও বাধা নেই।’

আবার এই আইনে যেহেতু নির্ধারিত মেয়াদ শেষের কমপক্ষে ১৮০ দিন আগে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তাই নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার পরপরই মেয়রকে পদত্যাগ করতে হয়। আর নির্বাচনও হয়ে থাকে মেয়াদপূর্তির কয়েক মাস আগে। ফলে একজন মেয়র আবারও নির্বাচন করতে চাইলে তাকে তফসিল ঘোষণামাত্র পদত্যাগ করতে হবে। সেটা চার থেকে পাঁচ মাস কিংবা ছয় মাস আগেও হতে পারে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইতোপূর্বে এই আইনের সংকটটি সেভাবে বোঝা যায়নি। কারণ, নারায়ণগঞ্জ বা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ক্ষেত্রে নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে মেয়রের মেয়াদ শেষ হওয়ার ঠিক আগে। অন্য সিটি করপোরেশনগুলোতেও মেয়াদ পূরণ হওয়ায় বা কাছাকাছি থাকায় বিষয়টি সেভাবে নজরে আসেনি। তবে এবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়রের পদ থেকে আতিকুল ইসলামকে পদত্যাগ করতে হয়েছে তার নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হওয়ার সাড়ে চার মাস আগে। ডিএনসিসি’র চলতি বোর্ডের মেয়াদ আগামী ১৪ মে শেষ হওয়ার কথা, কিন্তু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হওয়ায় প্রার্থিতার শর্ত অনুসারে গত ৩০ ডিসেম্বরই পদত্যাগ করতে হয়েছে তাকে। ফলে এই নির্বাচনে জয়-পরাজয় যাই ঘটুক না কেন, নির্ধারিত মেয়াদের প্রায় সাড়ে চার মাস হারিয়ে ফেলছেন আতিকুল। আসন্ন নির্বাচনে যদি জয়ী হন তাহলেও তাকে অপেক্ষা করতে হবে চলমান বোর্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার জন্য। কারণ, স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ অনুসারে আগের বোর্ড পূর্ণমেয়াদ দায়িত্ব পালন করবে এবং পদত্যাগ করায় তার পদ ফিরে পাওয়ার সুযোগ নেই। আবার আইনে বলা আছে, নতুন মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার এক মাসের মধ্যে তাকে বোর্ডসভা ও মেয়র প্যানেল নির্বাচন করতে হবে। ফলে কাউন্সিলরদের মেয়াদপূর্তির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোনও উপায় নেই তার। আবার, সদ্য সাবেক মেয়র ছাড়া অন্য কোনও প্রার্থী মেয়র পদে জয়ী হলে তাকেও দায়িত্ব পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে একই সময়। এই অপেক্ষার সময়টা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯

প্যানেল মেয়র দায়িত্ব পাননি, ডিএনসিসি চালাচ্ছেন প্রধান নির্বাহী

স্থানীয় সরকার আইনে দায়িত্ব ছেড়ে নির্বাচন করার বাধ্যবাধকতা থাকায় ডিএনসিসি’র মেয়র পদ ছেড়েছেন আতিকুল ইসলাম। আইন অনুযায়ী মেয়রের পদ শূন্য হলে দায়িত্ব নেবেন প্যানেল মেয়র। ডিএনসিসি’র তিন প্যানেল মেয়রের মধ্যে ওসমান গণি প্রয়াত, অপর দুজন জামাল মোস্তফা ও আলেয়া সারোয়ার ডেইজী আবারও নির্বাচনের মাঠে। আইন অনুযায়ী তাদের মধ্যে একজন ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু, দুজনের কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে এবং দায়িত্ব পালনে ইচ্ছুক কিনা তা জানতে না চেয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব দিয়েছে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হাইয়ের হাতে। তবে তার ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। তিনি নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনার বাইরে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল, উন্নয়ন কাজের বিল ছাড় ও প্রকল্পে সই করতে পারবেন না। 

জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল হাই বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মন্ত্রণালয় থেকে মেয়রের অবর্তমানে আমাকে কিছু দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। সেখানে আমি কী কী কাজ করতে পারবো সেটা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আমার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সীমাবদ্ধতাও বলে দেওয়া হয়েছে।’

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯-এর ২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘পদত্যাগ, অপসারণ অথবা মৃত্যুজনিত কারণে মেয়রের পদ শূন্য হলে শূন্যপদে নবনির্বাচিত মেয়র কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত জ্যেষ্ঠতার ক্রমানুসারে মেয়রের প্যানেলের কোনও সদস্য মেয়রের সকল দায়িত্ব পালন করিবেন।’ এই আইনে নির্বাচনে অংশ নিলে পরবর্তী সময়ে প্যানেল মেয়র তার দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, এমন কোনও শর্ত উল্লেখ করা নেই। ফলে আইনটি কেন মানা হলো না ডিএনসিসিতে সে আলোচনা যেমন আছে, তেমনই প্যানেল মেয়র দুজনের কেউ নির্বাচনের পর দায়িত্ব ফিরে পাবেন কিনা উচ্চারিত হচ্ছে সেই প্রশ্নও। তবে স্থানীয় মন্ত্রণালয় বলছে, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে নির্বাচন পর্যন্ত। এর পরে কী হবে তা জানেন না ডিএনসিসি’র কেউ।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিটি করপোরেশন বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শুধু নির্বাচনের সময়ের জন্য অত্যাবশ্যকীয় কিছু কাজ করার ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দিয়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি কিন্তু প্রশাসকের দায়িত্বে নন। তবে নির্বাচনের পরে তার সে দায়িত্ব কে পালন করবেন সে বিষয়ে এখনও কিছু জানি না।

এ অবস্থায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের এক মাস ও নির্বাচন পরবর্তী সাড়ে তিন মাস (১৪ মে পর্যন্ত) সিটি করপোরেশন অনির্বাচিত কর্মকর্তার দ্বারা খুঁড়িয়ে চলবে নাকি প্যানেল মেয়র দায়িত্ব পাবেন তা স্পষ্ট করা জরুরি হয়ে উঠেছে।

যা বললেন প্যানেল মেয়ররা

জানতে চাইলে ডিএনসিসির বর্তমান প্যানেল মেয়র আলেয়া সারোয়ার ডেইজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আতিক ভাই (মেয়র আতিকুল ইসলাম) পদত্যাগ করার পর তার অবর্তমানে তো আমরা প্যানেল মেয়ররাই দায়িত্ব পালন করার কথা। কিন্তু আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। বরং আমি যোগাযোগ করলে বলা হয়েছে, নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় আমরা সেই দায়িত্ব পালন করতে পারবো না। নির্বাচনের পরে তো মেয়াদ থাকা পর্যন্ত আমরা প্যানেল মেয়র। তখন তো আমাদের এই দায়িত্ব দেওয়ার কথা। যদি আইনগত কোনও বাধা না থাকে অবশ্যই আমরা বিষয়টি নিয়ে কথা বলবো।’

অপর প্যানেল মেয়র জামাল মোস্তফা বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। কিছুই জানানোও হয়নি। আমরা তো পদত্যাগ করিনি। তাহলে সেই মতে তো তখন আমাদেরই দায়িত্ব পালন করার কথা।’

দুই প্যানেল মেয়রই জানান, এর আগেও বিদায়ী মেয়র একাধিকবার দেশের বাইরে অবস্থান করার সময় বর্তমান প্যানেল মেয়রদের দায়িত্ব দিয়ে যাননি। এ কারণে তারা মেয়র প্যানেলে থেকেও দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।

স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর ব্যাখ্যা

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী তাজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ডিএনসিসির মেয়রের পদত্যাগের পর সেখানে যে দুই জন প্যানেল মেয়র ছিলেন তাদের দায়িত্ব দেওয়া যায়নি। কারণ, তারাও নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। আমরা আইন অনুযায়ী সেখানে একজনকে দায়িত্ব দিয়েছি। তার কিছু দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।’

আইনে আরও অস্পষ্টতা

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ বিশ্লেষণ করে আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়রের পদ শূন্য হওয়ার পর প্যানেল মেয়রদের দায়িত্ব পালনে আইনগত বাধা থাকলে বা তারা দায়িত্ব পালনে অনিচ্ছুক হলে সেখানে কে দায়িত্ব পালন করবে সে বিষয়ে আইনেও স্পষ্ট কিছু বলা নেই। এটা স্পষ্ট করা উচিত। এছাড়া প্যানেল মেয়ররা যদি নির্বাচনে অংশ নেন সেক্ষেত্রে সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে দায়িত্ব দেওয়ার বদলে পরবর্তী নির্বাচনে অংশ না নেওয়া কোনও কাউন্সিলরকেও দায়িত্ব দিতে পারতো কিনা তারও নির্দেশনা নেই আইনটিতে।  

অস্পষ্টতা দূর করতে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা যা বললেন

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯-এর আলোকে মেয়রের মেয়াদ ও প্যানেল মেয়রের দায়িত্ব পালনের বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, মেয়রকে নির্ধারিত মেয়াদ পূরণের সুযোগ দেওয়া উচিত। নির্বাচনটি এত আগে না করে মেয়রকে তার মেয়াদপূর্তির সুযোগ দেওয়াটা কাম্য। কারণ, জনগণের কাছে তার প্রতিশ্রুতি থাকে। এত আগে দায়িত্ব ছাড়তে হলে অনেক প্রতিশ্রুতিই পূরণ করার সময় পান না তিনি। বিষয়টা বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

আর প্যানেল মেয়র অথবা নির্বাহীদের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয় নিয়ে তার মন্তব্য, বর্তমান বোর্ডের যে মেয়াদ রয়েছে বর্তমান মেয়র প্যানেলদের সেই দায়িত্ব পালনে কোনও আইনগত বাধা নেই। কারণ, তারা নির্বাচিত এবং পূর্ণ মেয়াদের জন্যই প্যানেল মেয়র হিসেবে বোর্ডের বাকি সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত। ফলে যদি তাদের দায়িত্ব দেওয়া না হয় তাহলে তাদের অধিকার খর্ব করা হবে। এমন কিছু ঘটলে তারা যদি আইনগত ব্যবস্থা নেন সেক্ষেত্রে সরকার আটকে যাবে।

তিনি আরও বলেন, আগামী ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও বর্তমান বোর্ডের মেয়াদ ১৪ মে পর্যন্ত রয়েছে। তাই দায়িত্ব পালনকারীকে সেই সময় পর্যন্ত এভাবে ‘ক্ষমতাহীনভাবে’ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর তার যেহেতু আর্থিক লেনদেনে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সে কারণে অবশ্যই নাগরিক সেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। 

তিনি বলেন, প্যানেল মেয়রের বদলে অন্য কোনও কাউন্সিলরকে দায়িত্ব দেওয়া যেত কিনা এ বিষয়েও আইনে স্পষ্ট কোনও নির্দেশনা নেই। সবদিক বিবেচনায় নিয়ে স্থানীয় সরকার আইনের এদিকটি আরও স্পষ্ট এবং ধারাবাহিক করা দরকার বলে মত দিয়েছেন তিনি। তার মন্তব্য,  ‘আমাদের আইনে বিষয়টি স্পষ্ট নেই। এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তখন কোন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে তাও বলা নেই। এ জন্য আইন পরিবর্তন করে বিষয়টি স্পষ্ট করা উচিত।’

এদিকে, নির্বাচনি তফসিল অনুযায়ী পুনর্নির্বাচনে যাওয়া একজন মেয়র কেন তার নির্ধারিত মেয়াদ শেষ করতে পারবেন না সেটাও সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারগুলোর সঙ্গে কাজ করা একটি উন্নয়ন সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন আইন কর্মকর্তা বলেন, পুনর্নির্বাচনে অংশ নিলেও মেয়াদ শেষ করার সুযোগ থাকা উচিত একজন মেয়রের। সিটি করপোরেশনের মেয়র পদটি আদালতের আদেশ অনুযায়ী লাভজনক। তবে নির্বাচনের তফসিল আরও পরে ঘোষণা করলে তিনি মেয়াদকাল মোটামুটি শেষ করার সুযোগ পাবেন। এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া উচিত। পুনরায় ভোট করবেন এ কারণে একজন নির্বাচিত মেয়রের নির্ধারিত পাঁচ বছরের মেয়াদের চার থেকে ছয় মাস কাটা পড়বে এটা কাম্য হতে পারে না।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে যদি একজন কাউন্সিলর নির্বাচনে অংশ নিয়েও প্যানেল মেয়রের দায়িত্ব পালন করতে পারেন তাহলে ঢাকায় পারবেন না কেন? তাকে দায়িত্ব দেওয়া না দেওয়াটা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব সিদ্ধান্ত হওয়া উচিত নয়।

তবে এ আইনে বেশ কিছু অস্পষ্টতা আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আইনটি স্পষ্ট করা দরকার। আর আমাদের কমিশনকেও এমনভাবে নির্বাচনের আয়োজন করা উচিত, যাতে মেয়রকে অনেক আগে পদত্যাগ করতে এবং নির্বাচনের পর নবনির্বাচিতদের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে না হয়।

প্রায় একই ধরনের মন্তব্য নির্বাচন কমিশনের আইনজীবী ব্যারিস্টার ড. মুহাম্মদ ইয়াসীন খানের। তিনি বলেন, আইনটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন। এই আইনে অনেক কিছু স্পষ্ট নেই। সেজন্য আগে আমাদের উচিত হবে আইনগুলোকে স্পষ্ট করা। আর যেখানে কোনও আইনি সমস্যা দেখা দেয় সেখানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যে সিদ্ধান্ত দেয় সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়ে আসছে। আসলে এটাও ঠিক নয়।

তিনি আরও বলেন, নির্বাচন পরবর্তী বর্তমান করপোরেশন বোর্ডের যে মেয়াদ রয়েছে প্যানেল মেয়ররা সেই সময়ের জন্যও প্যানেল মেয়র। সুতরাং আইন অনুযায়ী তখন মেয়রের দায়িত্ব পালন করবেন প্যানেল মেয়র। এখন ডিএনসিসির প্যানেল মেয়ররা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় তাদের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে। আইনে এ বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। আসলে বিষয়টি নির্ভর করছে মন্ত্রণালয়ের ওপর। মন্ত্রণালয় চাইলে যেকোনও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারলেও বিষয়টি আইনগতভাবে হওয়া উচিত। আইনে এই জটিল সময়গুলো কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে সেটি স্পষ্ট করা উচিত।

তিনি আরও বলেন, আরও একটি বিষয় হচ্ছে করপোরেশন বোর্ডের মেয়াদপূর্তির ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার যে আইনি বাধ্যবাধকতা আছে সেই আইনটি এমনভাবে বাস্তবায়ন করা উচিত, যাতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে একটি সংস্থাকে অনেক দিন নির্বাচিত প্রতিনিধিশূন্য থাকতে না হয়।

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া সদ্য সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করলে নির্বাচনের আগে এ বিষয়ে মন্তব্য করবেন না বলে জানান তিনি।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডাক্তার সেলিনা হায়াৎ আইভী এ বিষয়ে বলেন, এই আইনটি কিছুটা সাংঘর্ষিক মনে হয়। কারণ, সংসদ সদস্যরা যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন তারা কিন্তু পদত্যাগপত্র জমা দেন না, কিন্তু মেয়রদের বেলায় নির্বাচনের আগে পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার আইনটি রয়েছে।

 

/টিএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনে নেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল
মাঠ প্রশাসনকে নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ ইসির
সর্বশেষ খবর
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
‘নীরব এলাকা’, তবু হর্নের শব্দে টেকা দায়
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা