X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

মৈত্রীর বন্ধনে কলকাতাজুড়ে কেবলই বঙ্গবন্ধু

উদিসা ইসলাম
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৩০আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১৩:০৯

মৈত্রীর বন্ধনে কলকাতাজুড়ে কেবলই বঙ্গবন্ধু

৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, এ দিনটি কলকাতাজুড়ে কেবলই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফর ও বিদেশ সফর। পরের দিনের পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বলছে, কলকাতার সব পথ সেদিন মিলেছিল প্যারেড গ্রাউন্ডে। বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন, সেই ভাষণ কেবল সেই নির্ধারিত ময়দানে নয়, সারা কলকাতা ও হাওড়ার ১০টি পার্কে লাখো মানুষ শুনছিল, কী বলবেন নেতা।

যা বললেন বঙ্গবন্ধু

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার বাংলা তিতুমীরের বাংলা, আমার বাংলা সূর্য সেনের বাংলা, আমার বাংলা সুভাষ বসুর বাংলা, আমার বাংলা সোহরাওয়ার্দীর বাংলা। এ বাংলার মাটি পলি দিয়ে গড়া, বড় নরম মাটি। বর্ষায় মাটি বড় নরম হয়ে যায়। কিন্তু চৈত্রের কাঠফাটা রোদে মাটি এমন কঠিন শিলায় পরিণত হয়, তখন তা দিয়ে যেকোনও ষড়যন্ত্র আর যেকোনও ষড়যন্ত্রকারীর মাথা ভাঙা যায়। আমার দেশের মানুষও এই মাটির মতো। তারা শান্ত, তারা শান্তিপ্রিয়, কিন্তু প্রয়োজনের মুহূর্তে তারা কঠিন।’

ভাষণ দেওয়ার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘বিশ্বের কোনও শক্তি পারবে না এই বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে।’ আজকের দিনে প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশাল জনসমুদ্রে গগনবিদারী করতালির মাঝে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করতে সাম্রাজ্যবাদের খেলা চলতে দেওয়া হবে না।’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘লাখো জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। বিশ্বের কোনও শক্তি এ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারবে না। বিশ্বের ইতিহাসে আমাদের মতো এত বড় মূল্য দিয়ে আর কেউ স্বাধীনতা অর্জন করেনি। বহু কষ্টে অর্জিত এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের শেষ মানুষটিও প্রাণপণ সংগ্রাম করবে।’

দমদম বিমানবন্দরে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু

মিত্র ইন্দিরা গান্ধী যা বলেছিলেন

ইন্দিরা গান্ধী আশা প্রকাশ করে বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব দিনের পর দিন উত্তরোত্তর জোরদার হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারত সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে, মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের কর্মপন্থার ন্যায্যতা যথেষ্টভাবে তা প্রমাণ করে।’ ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘বাংলাদেশ রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছে। তাকে এবার অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে হবে।’ তিনি আস্থা প্রকাশ করেন যে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনর্গঠনে বৈদেশিক সাহায্য গ্রহণ করলেও বাংলাদেশ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, ‘ভারতও প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও দুর্দিন আসলে আমরা তার মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।’

ভারতের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসভা

কলকাতা ও হাওড়ার ১০টি পার্কে একইসঙ্গে লাখো জনতা সেদিন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনেন। প্যারেড গ্রাউন্ডে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এসব পার্কে লাউড স্পিকার লাগানো হয়। রাজ্যের বিভিন্ন স্থান থেকে লোক এসেছে সেদিন বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখবে বলে। জনসভা শেষ হওয়ার পরেও প্যারেড গ্রাউন্ডের দিকে মানুষের ঢল থামেনি। এটিকে ভারতের ইতিহাসের বৃহত্তর জনসভা হিসেবে পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়।

আলোচনায় দক্ষিণ এশিয়া 

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দক্ষিণ এশিয়াকে শান্তির এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সহযোগিতায় বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে না।’ ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আয়োজিত সভায় ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এসব কথা বলেন। মহাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশীদের মধ্যে শত্রুতা জিইয়ে রাখার নীতি অনুসরণ এখানেই শেষ হোক। আমরা যেন কখনও আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয় না করি, যে সম্পদ আমাদের জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য।’ দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত থাকবো উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা পিছিয়ে থাকবো না, একথা আমি স্পষ্টভাবে বলতে পারি।’

গার্ড অব অনার

কবিতায় মনের কথা

শ্রীমতী গান্ধী ও ভারতের জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘পাকিস্তানি বাহিনী এক কোটি মানুষকে ভিটেমাটি থেকে বিতাড়িত করেছিল। এই মানুষকে আশ্রয় দিয়ে, অন্ন দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত সরকার।’ তাদের এই অবদান তাদের এই দান পরিশোধের সাধ্য নেই উল্লেখ করে কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি বলেন, ‘নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি/দেবার কিছু নাই/আছে শুধু ভালোবাসা/দিলাম আমি তাই।’ এরপর খুনি ইয়াহিয়ার হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে জেনেও নিক্সন সরকারের যে ভূমিকা তার সমালোচনা করেন বঙ্গবন্ধু । তিনি সমালোচনা করেন, পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করে ভারতকে সহায়তা বন্ধ করে দেওয়ার। পাকিস্তানি বাজার রক্ষা করার জন্যই মার্কিন সরকার এরকম করেছে উল্লেখ করে গগনবিদারী করতালির মধ্যে বঙ্গবন্ধু আবারও পাঠ করেন—‘নাগিনীরা দিকে দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস/শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস/যাবার বেলায় তাই ডাক দিয়ে যাই/দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে/প্রস্তুত হইতেছে ঘরে ঘরে।’

বন্ধুকে দেওয়া উপহার

ইন্দিরা গান্ধীর জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কিছু উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন। এরমধ্যে ছিল বাংলাদেশের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান ও গোলাম কিবরিয়ার আঁকা তিনটি চিত্রশিল্প, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি প্রতীক নৌকার একটি প্রতিকৃতি, ঢাকার জামদানি শাড়ি, সাতটি চিতা বাঘের চামড়া, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প কর্তৃক নির্মিত বর-কনের দুটো পুতুল। আলোচনায় যোগদানকারী পদস্থ ভারতীয় অফিসারদের জন্যও উপহার ছিল।

 

ভাষণ দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু

বিদ্রোহী কবির জন্য শুভেচ্ছা

বঙ্গবন্ধু অসুস্থ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের রোগমুক্তি কামনা করে তার কাছে ফুলেল শুভেচ্ছা পাঠান। কবির গান ‘চল চল চল’ সশস্ত্র বাহিনীর সংগীত হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। তার গান রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। এই গানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটে। এসময় কবিকে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশ থেকেই ভাতা দেওয়া হয়।

জয় যুগ আলোকময়

কেমন ছিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের সেদিনের চার পাশ? একপাশে সুউচ্চ মঞ্চের একশ’ গজ দূরে আরেকটু নিচু ৫০ ফুট লম্বা মঞ্চ। এই মঞ্চে গীত বিতানের শতাধিক ছেলেমেয়ে দেশাত্মবোধক গান পরিবেশন করেন। মেয়েরা সারি বেঁধে মঞ্চের ডানদিকে ছেলেরা বাঁদিকে দাঁড়ানো। মেয়েদের পরনে গাঢ় সবুজ শাড়ি লাল ব্লাউজ, বাংলাদেশের পতাকার রঙ। আর ছেলেরা সাদা পাজামার সঙ্গে বাসন্তী পাঞ্জাবি ও ধানী রঙের মুজিব কোট, ভারতীয় পতাকার রঙে। সরলা দেবীর রচিত ‘জয় যুগ আলোকময়’ গান দিয়ে শুরু হয়। এরপর একে একে অতুলপ্রসাদ, কাজী নজরুল, রবীন্দ্রনাথ ও সত্যের দত্তের রচিত গানগুলো পুরো গ্রাউন্ডকে আপ্লুত করে তোলে।

/এপিএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
ভূমিহীনমুক্ত হচ্ছে সাতক্ষীরার ৬ উপজেলা, প্রস্তুত ৩৬৪টি ঘর
‘প্রধানমন্ত্রীর উপহার বেঁচে থাকার সাহস জুগিয়েছে’
রাহমানের কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’, ভিডিও করলেন মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা