X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

গাছ কেটে জলবায়ু প্রকল্প!

শাহেদ শফিক
২০ ডিসেম্বর ২০২০, ১৩:০০আপডেট : ২০ ডিসেম্বর ২০২০, ২১:২৪

জলবায়ু প্রকল্প থ্রিএফ মডেলের একটি পুকুর। পুকুরে নেই পানি, পাড়ে নেই গাছ

জলবায়ুজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। ঝুঁকি কমাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনোটির। জলবায়ু তহবিলের প্রকল্পগুলোতেও চলছে অর্থের তছরুপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নানাদিক ও এই খাতের অনিয়ম নিয়ে শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে পঞ্চম পর্ব−

জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় যেখানে গাছ লাগানোকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে সরকার, সেখানে গাছ কেটেই জলবায়ুর প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় পুকুর নির্মাণ করে তাতে মাছ, শাক-সবজি ও ফলসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা লাগানোর কথা থাকলেও তার কোনও দেখা মেলেনি। উল্টো পুকুরগুলোতে মাছের পরিবর্তে কচুরিপানায় ভরপুর। এমনটাই দেখা গেছে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার বনবিভাগের দুটি রেঞ্জ অফিসের আওতাধীন সরকারের উপকূলীয় সংরক্ষিত বনাঞ্চলে। পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে উপজেলা মৎস্য অধিদফতরের বাস্তবায়নে এবং ইউএনডিপির সহযোগিতায় উপকূলীয় বনায়ন ও পুনঃবনায়ন কমিউনিটিভিত্তিক অভিযোজন (আইসিবিএ-এআর) শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়নে এমন অভিযোগ উঠেছে। 

জলবায়ু প্রকল্পের একটি পুকুর

প্রকল্পের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিল—জীবিকার বৈচিত্র্যায়নের মাধ্যমে জলবায়ুজনিত বিপদাপন্ন উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসন, অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও উপকূলীয় বনের ওপর নির্ভরতা কমানো হবে। প্রকল্পের আওতায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতরে পুকুর তৈরি করে সেখানে মাছ চাষ ও পুকুর পাড়ে শাক-সবজি চাষ করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে স্বাবলম্বী করে তোলা হবে। যা জলবায়ুজনিত বিপদাপন্ন উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য নিরসন করবে।

এ ছাড়া স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণে সহ-ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বনায়ন ও পুনঃবনায়নের মাধ্যমে প্রজাতির বৈচিত্র্য এনে জলবায়ু সহিষ্ণু জীবিকায়ন গড়ে তোলা হবে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে ১০ হাজার ৫০০ পরিবারের ৬০ হাজার জনকে বিকল্প জীবিকায়নের সহায়তা ও প্রশিক্ষণও প্রদান করা হবে।

এই প্রকল্পের একটি বিশেষ মডেল হলো ‘বনজ, ফলদ, মৎস্য (থ্রিএফ) মডেল’। প্রতিটি মডেল বা পুকুরের দৈর্ঘ্যে ২৫২ ফুট এবং প্রস্থে ৪৯ ফুট। পুকুর হবে ৮ ফুট গভীর ও পাড়ের উচ্চতা হবে ৮ ফুট। মডেলটি ম্যানগ্রোভ বনের মাঝখানে পরিত্যক্ত বনভূমিতে নির্মাণ করার কথা।

জলবায়ু প্রকল্পের একটি পুকুর  প্রকল্পে বলা হয়েছে, মডেলের আওতায় পুকুর খনন করে চারদিকে বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে এই মডেল থেকে স্বল্প, মাঝারি এবং দীর্ঘমেয়াদি পুনঃফসল উৎপাদনের মাধ্যমে উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি অনুযায়ী অভিযোজন প্রক্রিয়া গ্রহণ করে তাদের জীবনযাত্রার মানের পরিবর্তন করা সম্ভব।

বনবিভাগের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির অধীনে প্রতিজন সুবিধাভোগীকে ২০ বছরের জন্য একটি পুকুর এবং ৩টি ডাইকের বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৮-২০১৯ আর্থিক সালে প্রকল্পটি ২৮ হেক্টর পরিত্যক্ত বনভূমিতে ১৪০টি থ্রিএফ মডেল তৈরি করেছে। যার মধ্যে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় ২০ হেক্টর জমিতে ১০০টি এবং ভোলার তজমুদ্দীন উপজেলায় বাকি ৮ হেক্টর জমিতে ৪০টি মডেল তৈরি করা হয়। প্রতিটি মডেল একটি পরিবারের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে বরাদ্দপ্রাপ্তরা ভূমিহীন দরিদ্র পরিবার ও তারা উপকৃত হচ্ছে।

প্রকল্পের উদ্দেশ্যে আরও বলা হয়েছে, প্রতিটি মডেলে বনজ গাছ ও কমপক্ষে ২০টি জলবায়ু সহিষ্ণু গাছ লাগানো হবে। এ ছাড়া ২০টি জলবায়ু সহিষ্ণু ফলদগাছ লাগানো হবে। পাশাপাশি ৪০টি পেঁপে গাছ লাগানোর মাধ্যমে স্বল্প ও মাঝারি সময়ের মধ্যে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার উৎপাদন সম্ভব হবে।

হাতিয়া উপজেলায় সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গাছ কেটে থ্রিএফ মডেলের পুকুর নির্মাণ প্রকল্পের প্রতিটি পুকুরের গভীরতা হওয়ার কথা ছিল ২ মিটার। ধরা হয়েছিল এর মাধ্যমে ১৮০-২০০ কেজি মাছ উৎপাদন সম্ভব হবে। তাছাড়া এই পুকুরের মিঠা পানি দিয়ে পুকুর পাড়, ডাইক ও মাচায় সবজি চাষ করা হবে।

কিন্তু প্রকল্প এলাকা সরেজমিন ঘুরে এসবের কিছুই দেখা যায়নি। বরং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের মাঝ অংশেই গাছ কেটে পুকুর বানানো হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। পুকুরগুলোতে মাছ চাষের কথা থাকলেও সেগুলো জলজ লতাপাতায় ভরে গেছে। অধিকাংশ পুকুর কচুরিপানায় টইটম্বুর। পানিতেও ময়লা ও দুর্গন্ধ। পুকুর পাড়েও কোনও গাছপালা বা সবজির দেখা মেলেনি। কোনও কোনও পুকুরে পানিও শুকিয়ে গেছে।

স্থানীয় সাগুরিয়া ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা শামছুদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার বাবা শফিউল্যাহ স্থানীয় খোকন স্যারাং থেকে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে একটা পুকুর কেনেন। তিনি এই পুকুর বনবিভাগ ও ইউএনডিপি থেকে বরাদ্দ নেন। তখন বনবিভাগ আমাদের অনেক আশা দেখিয়েছিল। বলেছিল, ফল ও কাঠের গাছ, মাছের খামার, সবজির বাগান ও বীজ দেবে। এখন পর্যন্ত কিছুই পাইনি। আমাদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

পুকুরে মাছের পরিবর্তে কচুরিপানা স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল জলিল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি একটি পুকুর পেয়েছি। কিন্তু খনন করার জন্য আমাকে কোনও অর্থ দেওয়া হয়নি। সম্পূর্ণ পুকুর নিজের টাকায় খনন করেছি। আমার বাবাও একটি পুকুর কিনেছেন। দুটি পুকুরে মোট এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা খরচ করে মাছ চাষ করেছি। পেয়েছি মাত্র ১৬ হাজার টাকা। বনবিভাগ ও ইউএনডিপি যে স্বপ্ন দেখিয়েছে তার কিছুই পাইনি। পুকুরের জায়গা বুঝিয়ে দেওয়ার পর কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি।

স্থানীয় জেলে আকবর হোসেন জানান, পুকুরের মাঝে কেওড়া গাছের গোড়া দেখলেই তো বোঝা যায় এখানে গাছ ছিল। সেগুলো কেটেই পুকুর করা হয়েছে। আমরা শুনেছি পুকুরে মাছ থাকবে। পাড়ে সাক-সবজি হবে। এসবের কিছুই নেই।

জানতে চাইলে সদ্য বিদায়ী সাগুরিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা কোনও গাছ কেটে পুকুর নির্মাণ করছি না। জলবায়ুর প্রভাবের কারণে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের জন্য এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ থেকে মানুষ উপকৃত হচ্ছে।

নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায় থ্রিএফ মডেলের একটি পুকুরের বাস্তব অবস্থা স্থানীয় বনবিভাগের জাহাজমারা রেঞ্জ কর্মকর্তা এসএম সাইফুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, থ্রিএফ মডেল প্রকল্প সুন্দরভাবে বাস্তবায়ন হয়েছে। প্রকল্পটি তিনটি দফতর মিলে বাস্তবায়ন করছে। বনবিভাগ পুকুর খননের পর সেখানে গাছ লাগাবে। মৎস‌্য বিভাগ মাছ চাষ করবে আর কৃষি বিভাগ সবজিসহ অন্যান্য ফসল ফলানোর কাজ করবে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (নোয়াখালী) বিপুল কৃষ্ণ দাসকে প্রশ্ন পাঠালে তিনি কোনও উত্তর দেননি। তবে প্রকল্প উপদেষ্টা ও হাতিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুব মোরশেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে কিছু অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। সেগুলো খতিয়ে দেখছি।

জানতে চাইলে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ইউএনডিপি বাংলাদেশের আইসিবিএ-এআর প্রোগ্রামের কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েট মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটি একটি ভালো ও সফল প্রকল্প। প্রকল্পটি জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন জীবিকার স্থায়ীত্বশীল উন্নয়নের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৩ সালে আর্থ কেয়ার অ্যাওয়ার্ড ও ২০১৪ সালে পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন সেলের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার জাকির হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ১৯টি উপকূলীয় জেলার প্রায় সাড়ে তিন কোটি মানুষ জলবায়ু ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে এসব এলাকার ১০ থেকে ১৫ ভাগ ভূমি তলিয়ে যেতে পারে। জেলাগুলোর প্রায় আড়াই কোটি জলবায়ু শরণার্থী হতে পারে। এই আসন্ন বিপদ থেকে বাঁচতে যেখানে গাছ লাগানোর প্রয়োজন সেখানে গাছ লাগানোর টাকায় গাছ কেটে যদি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয় সেটি দুঃখজনক।

গাছ কেটে পুকুর নির্মাণ পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আগামী বৈঠকে সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে প্রকল্পটির বিস্তারিত জানতে চাইবো। প্রয়োজনে ওই এলাকায় কমিটি বৈঠক করা যায় কিনা সে বিষয়ে উদ্যোগ নেবো।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশের বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অনেক সময় প্রকল্পগুলো সচিবালয়ে বসেই করা হয়। ফলে মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন করতে যাওয়া হলে আর মিল পাওয়ার যায় না। এই প্রকল্পেও এমনটা হতে পারে। তারা হয়তো ভেবেছিল অনেক খালি জায়গা আছে। সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে। কিন্তু গিয়ে দেখেছে সেখানে ভরা বাগান। গাছ কেটে জলবায়ুর প্রকল্প বাস্তবায়ন কোনোভাবেই কাম্য নয়।

আরও পড়ুন:
জলবায়ুর টাকায় ফুট ওভারব্রিজ, ট্রাফিক বাতি!



বায়ুদূষণ কমাতে ৮০০ কোটি টাকা: বেতন-ভাতা, যন্ত্রপাতি আর বিদেশ ভ্রমণেই ফুরালো!

জলবায়ুর টাকা পুরোটাই গেছে জলে, ২৯৬ জনের বিদেশ সফর

৮ হাজার একর বন উজাড়, ক্ষতি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা!

/এফএ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা