X
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪
৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

রানা প্লাজা ধস : ক্ষতিপূরণের নামে থোক বরাদ্দ!

উদিসা ইসলাম
২১ এপ্রিল ২০১৬, ১৮:৪২আপডেট : ২১ এপ্রিল ২০১৬, ২০:১৪

রানা প্লাজা ধসের তিন বছর পর এসেও ক্ষতিপূরণ পাননি সব শ্রমিক। কেন সব শ্রমিকের নাম তালিকায় নেই, সে বিষয়ে অবাক হলেও এর কারণ বলতে পারছে না ‘ক্ষতিপূরণ’দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া, দুর্ঘটনায় আহত-নিহত শ্রমিকদের জীবনের মূল্য বা ক্ষতিপূরণ কত হবে—তার সমাধান করা এখনও সম্ভব হয়নি। এদিকে, আহত-নিহতদের জন্য ক্ষতিপূরণে নামে মূলত থোক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। আর এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপ থাকায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ থোক বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন গবেষকরা।

 

রানা প্লাজা

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় আহত শ্রমিকদের একজন রাবেয়া খাতুন। ধসে পড়া ভবন থেকে উদ্ধার হওয়ার পর থেকে এখানে সেখানে চিকিৎসা নিয়ে ১৪মাস চিকিৎসা নিয়েছেন সিআরপিতে। শ্রমিক জীবন কাটাতে এসে এই ধসে পড়া ভবনের নিচে চাপা পড়ে কেটে ফেলতে হয়েছে বাম পা। এছাড়া, বুকের চারটে হাড়ও ভেঙে গেছে। তিনি ক্ষতিপূরণ বাবত কোনও অর্থই পাননি। কিভাবে চলছেন—এমন প্রশ্নের জবাবে রাবেয়া খাতুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আল্লায় চালান’।

তবে, এমন অনেকেই আছেন, যারা ক্ষতিপূরণের জায়গায় নামেমাত্র থোক বরাদ্দ পেয়েছেন। তবে তারা কেন, কত টাকা পেলেন, তাও জানেন না। এমনকি আহত-নিহত শ্রমিকদের কতজন অর্থ পাননি সে বিষয়েও সঠিক কোনও তথ্য নেই। যদিও ক্ষতিপূরণের যাবতীয় বিষয় সমন্বয়কারী ক্লেইমস কমিটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা শ্রমিকের ও তার গৃহস্থালী এসেসমেন্টের মধ্য দিয়ে অর্থ বরাদ্দ করেছেন, এটাকে ক্ষতিপূরণও বলছেন না তারা।

মোমেনা বেগম। রানা প্লাজার ৬ষ্ঠ তলার ইথার টেক্স এ কাজ শুরু করেছিলেন ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারির ২ তারিখে। ধসের সময় মোমেনা বেগম ছিলেন ৪ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ধ্বংসস্তূপের নিচে বিশ ঘণ্টা আটকে থাকায় হারিয়েছেন সন্তান। ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১০লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র পেয়েছেন। তবে তিনি মনে করেন না তার এই ‘অস্বাভাবিক’ জীবনে এই পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ হতে পারে। তিনি বলেন, এখনও পায়ের যন্ত্রণায় হাঁটতে পারি না। নিজেকে প্রতিবন্ধী ছাড়া কিছুই মনে হয় না। নিজের কাজ, নিজের সাজানো সংসার গুটিয়ে গ্রামে চলে আসতে হলো। এই ক্ষতি অপূরণীয়।

আহত শ্রমিক মোমেনার সংসার

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে আটতলা রানা প্লাজা ধসে পড়ে। এতে নিহত হন এক হাজার ১৩৫ জন, আহত হন আরও হাজারখানেক শ্রমিক, যারা ওই ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।

রানাপ্লাজা ধসের ঘটনায় নিহত কর্মী আনিসুর রহমানের ভবনের চার তলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলস কারখানার ফ্লোর ইন চার্জ হিসেবে কাজ করতেন। ঘটনার সতেরো দিন পর বের করে আনা হয় তার মৃতদেহ। ভাইয়ের বাসায় দুই শিশুসন্তান নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন স্ত্রী বীথি আক্তার। তিনি বলেন, এখনও ক্ষতিপূরণের সম্পূর্ণ অর্থ পাইনি। কত টাকা পাবেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, একেকজন একেক কথা বলেন। আমরা অনেকে ভয়ে কিছু টাকা পেলেও বলতে পারি না কত পেয়েছি। কিছু পেয়েছি শুনে যদি আর কোনও সহযোগিতা না দেয়। তিনি বলেন, ক্ষতিপূরণের কত টাকা পাওয়ার কথা, সেটা আমাদের জানালে আমরা উপকৃত হতাম।

বীথি আক্তার

সম্প্রতি অ্যাকশন এইড-এর করা ‘রানা প্লাজা ধসের তিন বছর: পোশাকশিল্পের অগ্রগতি’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সময় তাদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে। কোন প্রক্রিয়া ও কোন মানদণ্ড অনুসরণ করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে—তা এখনও শ্রমিকদের কাছে স্বচ্ছ নয়।’ একই বক্তব্য  মোমেনা বেগমেরও। তিনি জানেন না ঠিক কী কারণে তার সহকর্মী পেলেন ত্রিশ লাখ টাকা এবং একই পরিমাণ ক্ষতির শিকার হয়েও  তিনি পেলেন মাত্র দশ লাখ টাকা।

রানা প্লাজা ক্লেইমস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর নির্বাহী কমিশনার ড. মোজতোবা কাজাজি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শ্রমিকের বেতন, বয়স, নির্ভরশীল সদস্যের সংখ্যা, শারীরিক ক্ষতির পরিমাণসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় সবাইকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে সমান অঙ্কের অর্থ দেওয়া হয়নি।’ এটাকে ক্ষতিপূরণ বলা যাবে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রানাপ্লাজার ক্ষেত্রে পুরো বিষয়টি একেবারেই আলাদাভাবে করা হয়েছে। শ্রমিকরা যেন কিছুটা পুনর্বাসিত হতে পারেন, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

আরও পড়ুন:  সংসদীয় কমিটির বৈঠক আবারও রেলের ভাড়া বৃদ্ধির সুপারিশ সংসদীয় কমিটির

ক্ষতিপূরণের বাইরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনা কবলিতদের ৪৮ শতাংশ এখনও বেকার। আর প্রায় ৭৭ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্তই পোশাকশিল্পে আর কাজ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ৪৮ শতাংশ বেকার হওয়া মানুষের ক্ষতিপূরণ কী? এই হিসাব প্রতিটি ঘটনার পর পরিস্থিতি বুঝে নির্ধারণ করা হয়। সেটা শ্রমিকদের জন্য হতাশার।

এদিকে, ওই সময় প্রধানমন্ত্রীন ত্রাণ তহবিলে সংগৃহীত অর্থ নিয়ে টিআইবি প্রশ্ন তুললে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, বিভিন্ন সময় নানা রকম দুর্যোগ মোকাবিলাসহ দুস্থদের সাহায্যার্থে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে’ অর্থ অনুদান দিয়ে থাকেন। এ তহবিল থেকে দুস্থদের চিকিৎসা, লেখাপড়া, গৃহনির্মাণ, পরিবারের ভরণপোষণের জন্য নিয়মিত অর্থসাহায্য দেওয়া হয়। বিভিন্ন দুর্ঘটনায় যারা আয়-সক্ষমতা অথবা পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য হারিয়েছেন, তাদের ৫ লাখ টাকা থেকে শুরু করে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত পরিবার সঞ্চয়পত্র করে দেওয়া হয়েছে। ব্যাখ্যায় আরও বলা হয়, ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে অনুদান এসেছে। তবে রানা প্লাজা নামে কোনও তহবিল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে নেই। এই নামে কোনও অনুদানের চেকও আসেনি।

অ্যাকশন এইড-এর নির্বাহী ফারাহ কবীর বলেন, ‘তিন বছর পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের যা দেওয়া হয়েছে, তা ক্ষতিপূরণ নয়, এটি আর্থিক সহযোগিতা। যা তাদের পুনর্বাসিত হতে সহযোগিতা করেছে। ক্ষতিপূরণ বললেই শ্রমিকের মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক বিষয়গুলোকে নিয়ে কাজ করতে হবে। সেই কাজটি হয়নি।’

শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, যদি কোনও শ্রমিক কারখানায় মৃত্যুবরণ করেন, তবে তিনি ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১ লাখ টাকা ও কোনও শ্রমিক সম্পূর্ণ অক্ষম হন, তাহলে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাবেন। যদিও তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ডের পর নিহতদের স্বজনকে ৭ লাখ ও আহতদের ১ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়। তবে মালিক বা কর্তৃপক্ষের অবহেলায় শ্রমিকেরা নিহত হওয়ায় ক্ষতিপূরণের অর্থের পরিমাণ অনেক বেশি হওয়া প্রয়োজন বলেই মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির (বিসিডব্লিউএস) নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার বলেন, ‘আমরা শুরু থেকে নিহত ও আহত শ্রমিকদের হারানো আয়ের ক্ষতিপূরণ চেয়ে আসছি। যেটা কখনোই ২২ লাখ টাকার কম হবে না। আবার ক্ষতিপূরণ কে কত পাবেন, সেই এসেসমেন্ট করার ক্ষেত্রেও যতটা সংবেদনশীল হওয়া দরকার, ততটা হয়নি।’

ছবি: নাসিরুল ইসলাম

/এমএনএইচ/

আপ: এইচকে

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
তাইওয়ানকে হুমকি দেওয়া বন্ধ করুন: উইলিয়াম লাই
তাইওয়ানকে হুমকি দেওয়া বন্ধ করুন: উইলিয়াম লাই
২০ ঘণ্টা পর মুক্ত সৈয়দপুরের সেই উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী
২০ ঘণ্টা পর মুক্ত সৈয়দপুরের সেই উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কাজ করে চলেছে রকমারি ডট কম
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে কাজ করে চলেছে রকমারি ডট কম
বিছানায় পড়ে ছিল স্ত্রীর লাশ, ঘরের আড়ায় ঝুলছিলেন স্বামী
বিছানায় পড়ে ছিল স্ত্রীর লাশ, ঘরের আড়ায় ঝুলছিলেন স্বামী
সর্বাধিক পঠিত
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত
হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিহত
রাইসির বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ভিডিও প্রকাশ
রাইসির বিধ্বস্ত হেলিকপ্টারের ভিডিও প্রকাশ
ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, জানালেন ওবায়দুল কাদেরঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
এ আর রাহমানের মুখে লালন ফকির থেকে শেখ হাসিনা...
কান উৎসব ২০২৪এ আর রাহমানের মুখে লালন ফকির থেকে শেখ হাসিনা...
ইরানের প্রেসিডেন্ট নিহতের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া
ইরানের প্রেসিডেন্ট নিহতের ঘটনায় বিশ্বজুড়ে শোকের ছায়া