‘সকাল পাঁচটা বাজে। আমি গেটেই বইসা রইছি। ড্রাইভার সিপাহী নিয়া দৌড়াইয়া আইছে। তখন আমার সামনে কেউ ছিল না। পুলিশ আইসা জিজ্ঞেস করছে, তুমি থাকো কই, কী করো? আমি বললাম—মাংসের দোকানে কাজ করি। এরপর পকেট থেকে খাতা বাইর করলো। কিছু লেইখা কইলো, সই দেও। আমি কইলাম, কিছু জানি না, শুনি নাই, কী সই দিমু? তখন পুলিশ বলে— তুমি সই দাও। তিন জন মানুষ ধরছি। এই ২০টা বাবা (ইয়াবা ট্যাবলেট) পাইছি ওদের কাছে। আমরা যেমনে বলব, তুমি তেমনে বলবা। কোনও সাংবাদিক যদি ফোন করে বা দেখা করতে চায়, তাহলে ফোন ধরবা না, কিছু বলবা না। জোর করেই আমাকে সাক্ষী বানিয়েছে পুলিশ।’
ডেইলি অবজারভারের ফটো সাংবাদিক আসিক মোহাম্মদের বিরুদ্ধে পুলিশের দেওয়া ইয়াবা উদ্ধারের মামলার এক নম্বর প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী মো. জহির মঙ্গলবার (১০ জুলাই) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এভাবেই সাংবাদিকদের সামনে সাক্ষী হওয়ার বর্ণনা দেন।
ঈদুল ফিতরের পরদিন গত ২৭ জুন দিবাগত রাতে শান্তিনগর বাজারের হোটেল বিসমিল্লাহর সামনে থেকে আসিক মোহাম্মদসহ তিনজনকে ২৫পিস ইয়াবাসহ আটক করে পুলিশ।
সাক্ষী জহির বলেন, ‘মাংস আসবে এজন্য বাজারের গেইটের পাশে বসে অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ দু’জন পুলিশ এসে নাম পরিচয় জানতে চায়। পরে জোর করে আমাকে সাক্ষী বানানো হয়।’ বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে প্রকাশ করে দেওয়ায় তিনি কোনও হয়রানির শিকার হবেন কিনা, এ বিষয়টিও সাংবাদিকদের কাছে জানতে চান জহির।
সাংবাদিকদের জহির বলেন, ‘পুলিশ যদি আমাকে হয়রানি করে তখন আপনারা আমার পাশে থাকবেন কিনা?’ জবাবে উপস্থিত সাংবাদিকরা বলেন, ‘অবশ্যই আমরা আপনার পাশে আছি।’
মামলার আরেক সাক্ষী পান সিগারেটের দোকানি আবদুল করিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি ফজরের নামাজ শেষে দোকান খুলি। প্রতিদিনের মতো ওইদিন ফজরের নামাজ শেষে দোকানের সামনে আসতেই পুলিশ আসে। নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করে। আমি সব বলার পর এগুলো তারা লিখে নেয়। এরপর আমাকে স্বাক্ষর দিতে বলেন। আর বলে আমি নাকি সাক্ষী।’
কী কারণে সাক্ষী করা হচ্ছে, জানতে চাইলে আবদুল করিমকে পুলিশ জানায়, তিনজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের কাছে ইয়াবা পাওয়া গেছে। ওই সময় করিম বলেন, “আমিতো কিছু জানি না, কাদের আটক করা হয়েছে, তাদের কাছে কী পাওয়া গেছে, তাও জানি না। আমি কেমনে সাক্ষী হব? তখন পুলিশ সদস্যরা বলেন, ‘কোনও সমস্যা হবে না’। তখন সাক্ষী হইছি। এর বেশি কিছু জানি না।”
এই ঘটনায় আব্দুল করিমকে যখন জোর করে সাক্ষী করা হয়, তখন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন শান্তিনগর বাজারের ব্রাদার্স পাওডার মিলের শ্রমিক মো. রুবেল। রুবেল বলেন, ‘উনার (করিম) কাছে যখন পুলিশ আসে তখন আমি পাশেই ছিলাম। পুলিশ আইসা উনার নাম ঠিকানা নিছে। সবকিছু নেওয়ার পর বলে, আপনাকে সাক্ষী হতে হবে। তিনজন আসামি আটক আছে। তাদের কাছে ইয়াবা পাওয়া গেছে, আপনি সাক্ষী। তখন উনি (করিম) জানতে চাইছে আটককৃতরা কই? পুলিশ বলছে, গাড়িতে আছে। কোনও সমস্যা হবে না।’
ইয়াবা উদ্ধার ঘটনায় যাদের সাক্ষী করা হয়েছে তারা বিষয়টির কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে মামলার বাদী ও ওইদিন টহলে থাকা পল্টন থানা এএসআই আশরাফ আলীর কাছে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি এসব কিছু জানি না। আমার কাছে এগুলো জানতে চাইবেন না।’
এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এস আই মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আটককৃতদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের উপস্থিতে ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে। এখন যদি তারা অস্বীকার করে তাহলে আদালত বুঝবেন। আমার কিছু বলার নেই।’
ঈদুল ফিতরের পরদিন গত ২৭ জুন দিবাগত রাতে শান্তিনগর বাজারের হোটেল বিসমিল্লাহর সামনে থেকে আসিক মোহাম্মদসহ তিনজনকে আটক করে পুলিশ। আটক অন্যরা হলেন— আল-আমিন ও আসিফ আলী। তাদের কাছ থেকে ২৫ পিস ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয় বলে পুলিশ জানায়। পরদিন ২৮ জুন সকালে পল্টন থানার এএসআই আশরাফ আলী বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে এ তিনজনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন।
গত ২৭ জুন দিবাগত রাতে ইস্টার্ন প্লাস মার্কেট ও তার আশ-পাশের এলাকায় টহলে ছিলেন পল্টন থানার এএসআই আশরাফ আলী। তিনি মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, রাত ৪টা ২০ মিনিটে আসিকসহ তিনজনকে ইয়াবাসহ আটক করা হয়। তখন সাক্ষী জহির ও করিমের উপস্থিতিতে তল্লাশি চালিয়ে আসিকের পকেট থেকে ১০টি ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়। এছাড়া অন্য দু’জনের মধ্যে একজনের পকেটে ১০টি ও অন্যজনের কাছ থেকে ৫টি ট্যাবলেট উদ্ধার করা হয়।
তবে আসিক মোহাম্মদের পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মীদের পক্ষ থেকে প্রথম থেকেই অভিযোগ করা হয়— আসিককে আটক করার পর তার মায়ের কাছে এক লাখ টাকা দাবি করে পুলিশ। কিন্তু সেই পরিমাণ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে ইয়াবা মামলা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে।
/জেইউ/এসএমএ/