X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

‘বাংলাদেশ নিয়ে আইএস-সহ অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর আগ্রহ আছে’

নুরুজ্জামান লাবু
২০ আগস্ট ২০১৯, ২৩:৪৭আপডেট : ২০ আগস্ট ২০১৯, ২৩:৫৪





জন টি গডফ্রে ‘বাংলাদেশের অবস্থান এমন একটা জায়গায়, যেখানে আইএস ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর ব্যাপক আগ্রহ আছে। তারা নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি কিংবা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এই হুমকি মোকাবিলায় আরও বেশি সতর্ক থাকা প্রয়োজন। প্রয়োজন নজরদারি বাড়ানো।’
যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ দমন ও সহিংস জঙ্গিবাদ মোকাবিলা বিষয়ক ব্যুরোর আঞ্চলিক ও বহুপাক্ষিক বিষয়ক উপ-সমন্বয়কারী জন টি গডফ্রে বাংলা ট্রিবিউনের কাছে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন।
সম্প্রতি গডফ্রে সংক্ষিপ্ত এক সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। সেসময় মার্কিন দূতাবাসে কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। সেসময় তিনি বলেন, ‘ওয়াশিংটন মনে করে বাংলাদেশকে দুর্ভাগ্যজনকভাবে জঙ্গি হামলার শিকার হতে হয়েছে। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া হলি আর্টিজান বেকারির হামলা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ ঘটনার পর সরকার তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বেশকিছু সফলতাও আছে। তাদের (জঙ্গিদের) নেটওয়ার্ক গুঁড়িয়ে দিয়েছে। যেসব সূত্র থেকে হুমকি ছিল সেসব হুমকি এখন হুমকি আর নেই।’
গডফ্রে বলেন, ‘কিন্তু আরেকটু বড় পরিসরে যদি বলা যায়, তাহলে বলতে হবে বাংলাদেশের অবস্থান এমন একটা জায়গায়, যেখানে আইএস ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠীর আগ্রহ আছে। জঙ্গিরা তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি কিংবা নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। এই হুমকি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে আরও বেশি সতর্ক থাকা ও নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে মত দেন তিনি।
গত কয়েক বছর ধরে আইএস-এর উত্থান-পতন হয়েছে, কিন্তু আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশের যে শাখা, তারা চুপচাপ রয়েছে। তারা বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে আতঙ্কের বিষয় হতে পারে কিনা জানতে চাইলে গডফ্রে বলেন, “হ্যাঁ, গত কয়েক বছর ধরেই পুরো বিশ্ব আইএস-এর দিকে বেশি নজর দিয়েছে। কারণ, তারা ইরাক-সিরিয়াসহ বিভিন্ন জায়গায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। কিন্তু আল কায়েদা হলো সুযোগসন্ধানী একটা সংগঠন। তারা চুপচাপ থেকে নিজেদের পুনর্গঠিত করেছে। তাদের নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি করেছে। আন্তঃদেশীয় সন্ত্রাসবাদের জন্য তারা ‘ভ্যানগার্ড’ হিসেবে কাজ করে। তারা আবার নিজেদের অবস্থান ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। এটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়।”
সাংবাদিকদের সঙ্গে গডফ্রের এই আলাপচারিতার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার। তারা দুজনই জানান, সন্ত্রাসবাদ দমনে ওয়াশিংটন বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সন্ত্রাস দমন ও কাউন্টার র্যা ডিক্যালাইজেশনের কাজ চলছে। এছাড়া নারী ও যুবকদের সম্পৃক্ত করেও বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে অংশিদারত্বের ভিত্তিতে এসব কর্মসূচি আরও বাড়ানো হবে হবে বলে জানান যুক্তরাষ্ট্রের এই দুই প্রতিনিধি।
উল্লেখ্য, গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে নতুন ধারার দুই জঙ্গি সংগঠন— আইএস অনুসারী নব্য জেএমবি এবং আল-কায়েদা অনুসারী আনসার আল ইসলাম সক্রিয় রয়েছে। তারা রাজধানীসহ সারাদেশে লেখক, ব্লগার, প্রকাশকসহ ভিন্ন মতালম্বী ও ধর্মালম্বী এবং বিদেশি নাগরিকদের টার্গেট করে হামলা চালিয়ে আসছিল। রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে জঙ্গিদের কোণঠাসা করেছে ঠিকই। তবে এখনও তাদের পুরোপুরি নির্মূল করা যায়নি।
ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল আর মিলার এবং জন টি গডফ্রে জঙ্গিবাদ দমনে হার্ড অ্যাপ্রোচ (অভিযান)-এর পাশাপাশি ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন বা কাউন্টার র‌্যাডিক্যালাইজেশন-এর জন্য বাংলাদেশ কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে জানতে চাইলে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ে অভিজ্ঞ এই মার্কিন কর্মকর্তা বলেন, “এই সমস্যা কঠিন, কিন্তু এর সহজ সমাধানও আছে। ‘হোমগ্রোন’ জঙ্গিদের ব্যাপারে সমাজের কিছু ভূমিকা রয়েছে। উগ্রবাদে যারা দীক্ষিত হয়েছে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন যেমন দরকার, তেমনি শুধু ব্যক্তি নয়, যে পরিবেশ তাকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করছে সেই পরিবেশেরও পরিবর্তন দরকার। অনেক সময় মানুষ তার জীবনে নাটকীয় কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। তারা নিজেদের পাশাপাশি অন্যদেরও ঝুঁকিতে ফেলে।’
উগ্রবাদে দীক্ষিত হওয়ার লক্ষণগুলো সম্পর্কে সবাইকে জানানোর পরাশর্ম দেন তিনি। বলেন, ‘কেউ দীক্ষিত হলে তার সমাধানের ব্যবস্থা সম্পর্কেও জানতে হবে। তাহলে মানুষ উপকৃত হতে পারে। এটার বাস্তবায়ন কিছুটা কঠিন, কিন্তু জরুরি।’
গডফ্রে বলেন, ‘যেখানে মানুষ নিজেদের নানা কারণে প্রান্তিক বলে মনে করে সেখানে এ ধরনের কর্মসূচির বাস্তবায়ন আরও কঠিন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখেছি, মানুষ যখন মত প্রকাশ করতে পারে না, তখন সে নিজেকে প্রান্তিক মনে করে, একঘরে হয়, হতাশ হয়। তরুণরা যদি নিজের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে না পারে, সেদিকে যদি কেউ নজর না দেয়, তাহলে তা র‌্যাডিকালাইজেশনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে।’
তিনি বলেন, “সরকারের বাইরে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও ধর্মীয় নেতাদের নিয়ে ‘হেলদি’ ডায়ালগ করতে হবে। যে কারণগুলো মানুষকে উগ্রবাদের পথে নিয়ে যায়, সেগুলো শনাক্ত করতে হবে। সংলাপে শুধু রোগ নির্ণয় হবে না, এসবের সমাধানের পথও দেখাবে। এছাড়া সবার কাছে বেশি বেশি করে কাউন্টার মেসেজ, ক্রেডিবল ভয়েস, ইসলামে কী আছে, এর সঠিক ভাষ্য কী, সেসব প্রচার করতে হবে।’
গডফ্রের মতে, এটা শুধু যে সরকারের দায়িত্ব, তা না; সবাইকে এ ধরনের কাজে এগিয়ে আসতে হবে।
বর্তমান বিশ্বে অনলাইন র‌্যাডিক্যালাইজেশন একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশেও এ হুমকির বাইরে নয়। অনলাইনের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো প্রপাগান্ডা প্রচার হচ্ছে। এগুলো দেখে বা শুনেও অনেকেই র‌্যাডিক্যালাইজড হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে করণীয় সম্পর্কে সন্ত্রাসবাদ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ গডফ্রে বলেন, ‘আমি এর সাধারণ উত্তর দিতে পারি। কিন্তু সত্যি কথা হলো এর কোনও একক উত্তর নেই। এটা একটা জটিল বিষয়। ওয়েবসাইট বা প্রপাগান্ডা প্রচারের পথগুলো বন্ধ করে র‌্যাডিকালাইজেশন বন্ধ করা যাবে না। মুভিং কনটেন্ট সরিয়ে নেওয়াটাই যথেষ্ট নয়।’
গডফ্রে বলেন, ‘কৌশলটা হলো, বিকল্প ভাষ্যটা খুব জরুরি। আইএস ও অন্যান্য জঙ্গিগোষ্ঠী যে প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে তার বিকল্প ভাষ্য প্রচার করা। হেট স্পিচের বিরুদ্ধে মোর স্পিচ প্রয়োজন। ইফেকটিভলি কাউন্টার করতে হবে।’
ইরাক-সিরিয়াতে আইএস তাদের কথিত খেলাফত হারানোর পর ফরেন টেরোরিস্ট ফাইটার বা এফটিএফ সদস্যরা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ থেকেও কয়েকজন আইএস-এ যোগ দিয়েছিল। যদিও বাংলাদেশ সরকার এফটিএফ বিষয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় কী হতে পারে—এ প্রশ্নের জবাবে গডফ্রে বলেন, ‘ইরাক ও সিরিয়ায় যারা গেছেন তারা অনেক বেশি উদ্বেগের কারণ। সবাই খুবই ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক। তারা তাদের হারানো নেটওয়ার্ক আবারও গড়ে তুলতে পারে। তারা আবারও শক্তি সঞ্চয় করতে পারে এবং হুমকি হয়ে উঠতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি আইএস-এর আগ্রহ রয়েছে। এটা খুবই উদ্বেগের। আমরা মনে করি, ইরাক ও সিরিয়ায় যেসব দেশের নাগরিক আইএস-এর হয়ে কাজ করছে, সেসব দেশগুলোর উচিত হবে তাদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের ব্যবস্থা করা, নজরদারির মধ্যে রাখা কিংবা ডি-র‌্যাডিকালাইজেশনের মাধ্যমে সমাজের মূল ধারায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।’
নিজের এ পরামর্শের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘তারা (জঙ্গিরা) হয়তো সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে কিছুদিন থাকবে। তারপর তারা নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। এতে করে শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের অন্য দেশগুলোর জন্যও ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।’

/এইচআই/
সম্পর্কিত
বাংলা ট্রিবিউনকে আমির খসরু মাহমুদ‘দুই নেতা ছিলেন উষ্ণ, বৈঠক ভবিষ্যৎ রাজনীতি গড়ে তোলার মাইলফলক’
একান্ত সাক্ষাৎকারে ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু৭২-এর সংবিধান মুক্তিযুদ্ধের, দেশের মানুষ ইতিহাসের বিকৃতি মানবে না
সাক্ষাৎকারএকাত্তর ইতিহাস নয়, রাজনৈতিক চর্চায় পরিণত হয়েছে: আফসান চৌধুরী
সর্বশেষ খবর
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনে ৮ কিলোমিটার যানবাহনের ধীরগতি
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনে ৮ কিলোমিটার যানবাহনের ধীরগতি
গোয়ালন্দে লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব, আতঙ্কিত কৃষক-খামারিরা
গোয়ালন্দে লাম্পি স্কিন রোগের প্রাদুর্ভাব, আতঙ্কিত কৃষক-খামারিরা
বেবিচকের নতুন চেয়ারম্যান মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক  
বেবিচকের নতুন চেয়ারম্যান মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক  
রিজার্ভ চুরি মামলার প্রতিবেদন ফের পিছিয়েছে
রিজার্ভ চুরি মামলার প্রতিবেদন ফের পিছিয়েছে
সর্বাধিক পঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
অবশেষে রিজার্ভে আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ হলো
অবশেষে রিজার্ভে আইএমএফের লক্ষ্য পূরণ হলো
ইলিশের দাম নির্ধারণের প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন
ইলিশের দাম নির্ধারণের প্রস্তাবে প্রধান উপদেষ্টার অনুমোদন
ক্যাম্পাসে নতুন সভাপতির প্রবেশ ঠেকাতে দুদিন পাঠদান বন্ধ!
ঢাকা সিটি কলেজক্যাম্পাসে নতুন সভাপতির প্রবেশ ঠেকাতে দুদিন পাঠদান বন্ধ!