ঢাকার নবাব পরিবারের বংশধর সেজে সেই আলী হাসান আসকারী নবাব এস্টেটের সম্পত্তি দখলেরও পাঁয়তারা করেছিল। এজন্য আসকারী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের ভূমি অফিসে পাঁচটি মিস কেসও করে। তিন দিনের রিমান্ডের জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য স্বীকার করেছে আলী হাসান আসকারী। এদিকে প্রতারণার অভিযোগে হাসান আলী আসকারীর বিরুদ্ধে আরও দুটি মামলা দায়ের করেছেন দুই ভুক্তভোগী। রাজধানীর মিরপুর ও মতিঝিল থানায় শনিবার এই মামলা দুটি নথিভুক্ত হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রতিদিনই ভুয়া এই নবাবের প্রতারণার কথা বেরিয়ে আসছে। তবে এখনও নিজের আগের বা প্রকৃত নাম-পরিচয় সম্পর্কে কিছু জানায়নি এই প্রতারক।
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আলী হাসান আসকারী এক মহাপ্রতারক। প্রতিদিনই তার নতুন নতুন প্রতারণার কৌশল আমরা জানতে পারছি। তাকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে তার কয়েকজন সহযোগীকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
নবাব এস্টেটের সম্পত্তি দখলের পাঁয়তারা
পুলিশ জানিয়েছে, আলী হাসান আসকারী ঢাকার নবাব এস্টেটের সম্পত্তির মধ্যে শাহবাগের একটি অংশের মোতাওয়াল্লি হওয়ার জন্য ভূমি অফিসে দুটি মিসকেস (৭০৭/২০২০, ৮৯০/২০২০) করেন। এছাড়া নারায়ণগঞ্জেও নবাব এস্টেটের কিছু সম্পত্তির মোতাওয়াল্লি হওয়ার জন্য তিনটি মিসকেস (৬৬৬/২০২০, ৬৬৭/২০২০, ৬৬৮/২০২০) করেন। বর্তমানে এসব সম্পত্তি ভূমি সংস্কার বোর্ডের অধীনে কোর্ট অব ওয়ার্ডসের মাধ্যমে দেখভাল করা হয়। নবাব পরিবারের বংশধর না হওয়া সত্ত্বেও এসব মিসকেস করার কারণ জানতে চাইলে হাসান আলী আসকারী বলেছেন, অনেকেই ভুয়া বংশধর সেজে নওয়াব এস্টেটের বিভিন্ন সম্পত্তির মোতাওয়াল্লি হয়েছেন। তিনিও সেই উদ্দেশে এসব কেস করেন। কিন্তু এগুলোর কোনও কিছুতেই সফল হননি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলী আহসান নিজেকে নওয়াব সলিমুল্লাহর নাতি হিসেবে পরিচয় দিয়ে তার বাবা নিউ ইয়র্কে থাকেন বলে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছেন। এমনকি তার বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং দুবাইতে তাদের গোল্ড কারখানা রয়েছে বলে প্রচার করতেন। কিন্তু জিজ্ঞাসাবাদে আলী হাসান জানিয়েছেন, ২০০৫ সালে তার বাবা ঢাকার উত্তরায় বসবাসরত অবস্থায় মারা যায়। পুরান ঢাকার ইসলামবাগে তাদের কাপড়ের ব্যবসা ছিল। নিউ ইয়র্কে থাকা, ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের পরিচয় এবং দুবাইয়ে ব্যবসার কথা বলে তিনি মানুষের আস্থা অর্জন করে প্রতারণা করতেন।
নবাব নামে জাতীয় পরিচয়পত্র
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আলী হাসান আসকারী ২০১৪ সালে ঢাকার নিকুঞ্জ এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলের কাছে নিজের নামে নবাব খাজা আলী আহসান আসকারী নামে একটি জন্ম নিবন্ধন নিয়েছেন। সেই জন্ম নিবন্ধনের ভিত্তিতে তিনি নবাবের বংশধর হিসেবে পরিচয় দেওয়া শুরু করেন। ২০১৫ সালে তিনি ঢাকার আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস থেকে একটি পাসপোর্ট সংগ্রহ করেন। তার পাসপোর্টের নথিপত্র ঘেঁটে সেখানে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কোনও নথি পাওয়া যায়নি। স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে সেখানে উত্তরার মাসকট প্লাজা লেখা রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, কোনও অসাধু চক্রের মাধ্যমে তিনি পুলিশ ভেরিফিকেশন ছাড়াই পাসপোর্ট হাতে পান। জন্মনিবন্ধন ও পাসপোর্ট দিয়ে তিনি ২০১৭ সালে আবেদন করে নবাব খাজা আলী হাসান আসকারী নামে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, শুরুতেই জাতীয় পরিচয়পত্র না নিয়ে ২০১৭ সালে জাতীয় পরিচয়পত্র নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে আসকারী কোনও উত্তর দিতে পারেনি। এ কারণে ধারণা করা হচ্ছে আগে তার অন্য কোনও নাম ছিল। জন্মনিবন্ধনের সূত্র ধরে সে পরে নতুন করে নতুন নামে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছে।
এমপি পদে নির্বাচন
সূত্র জানায়, ওই জাতীয় পরিচয়পত্রের সূত্র ধরেই আসকারী চলতি বছর ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে বাংলাদেশ মুসলিম লীগের হয়ে সংসদ সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। নির্বাচনে ভোট পেয়েছিলেন মাত্র ১৫টি। নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা ও সম্পদ বিবরণীতে বাৎসরিক আয় দেখিয়েছেন ৬ লাখ টাকা। সম্পদ বিবরণীতে নিজেকে নবাব খাজা হাসান আসকারী জুটমিলস লিমিটেড এবং আঞ্জুমান আসকারী বেওয়ারিশ লাশ দাফন নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। জানা গেছে, আসকারী জুটমিলস নবাব এস্টেটের সম্পত্তি। সরকার এই মিল অধিগ্রহণ করেছিল। পরে তা পরিচালনার জন্য বেসরকারি খাতের শিকদার গ্রুপের কাছে দেওয়া হয়েছে। আলী হাসান আসকারী নিজেকে সেই জুটমিলের চেয়ারম্যান হিসেবে দাবি করে আসছেন। আর আঞ্জুমান আসকারী নামে প্রতিষ্ঠানটি নামসর্বস্ব। হলফনামায় নিজেকে মাস্টার্স পাস উল্লেখ করলেও জিজ্ঞাসাবাদে আসকারী এসএসসিও পাস করেনি বলে জানিয়েছে।
সাবেক আইজিপির নাম ভাঙিয়েও প্রতারণা
পুলিশ জানিয়েছে, পুলিশের এস আই পদে চাকরি দেওয়ার নামে ও সিঙ্গাপুরে পাঠানোর কথা বলে জামালপুরের মাহমুদুল হাসান মাহমুদ নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ৪৩ লাখ টাকা নিয়েছেন আসকারী। মাহমুদুল হাসান জানান, ২০১৭ সালের শেষের দিকে মাওলানা সিরাজী নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে আসকারীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। পুলিশের সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারীর সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে জানিয়ে আসকারী তাকে এস আই পদে প্রার্থী দিতে বলে। মাহমুদ জামালপুরের এক প্রার্থী জোগাড় করে বিশ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য চুক্তি করে। একইসঙ্গে মাহমুদসহ সাত জনকে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চাকরি দেয়ার কথা বলে ২৩ লাখ টাকা নেয়।
মাহমুদ জানান, পুলিশের সাবেক আইজিপি জাবেদ পাটোয়ারী নিজে ঘুষ খান না জানিয়ে তার স্ত্রীকে দিয়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আসকারী। এজন্য সাবেক আইজিপির স্ত্রীকে স্বর্ণালঙ্কার কিনে দিতে হবে বলে জানায়। তারা আমিন জুয়েলার্স থেকে দশ লাখ টাকার স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ দশ লাখ টাকা দেন আসকারীকে। মালিবাগের সিআইডি কার্যালয়ের সামনে থেকে এসব গয়না ও টাকা গ্রহণ করেন তিনি। এর বাইরে সিরাজীর মাধ্যমে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য কয়েক দফায় ২৩ লাখ টাকা দেন। মাহমুদ জানান, প্রতারিত হয়ে তিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। যাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসকারীকে দিয়েছিলেন তারা তাকে খুঁজছে। এজন্য তিনি ভয়ে দুই বছর ধরে নিজের গ্রামের বাড়িতেও যেতে পারেন না।
প্রতারণার অভিযোগে আরও ২ মামলা
সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে নার্স নিয়োগের নামে ফেনীর ৪০০ ব্যক্তির কাছ থেকে তিন কোটি ৩৪ লাখ টাকা নিয়েছিলেন প্রতারক আসকারী। প্রতারিত ব্যক্তিদের পক্ষে সালমান নামে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের দায়ের করা মামলায় গত বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে পাঁচ সহযোগীসহ আসকারীকে গ্রেফতার করা হয়। আসকারীর গ্রেফতারের খবর চাউর হওয়ার পর প্রতারিতদের অনেকেই ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটে যোগাযোগ শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার মানজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি মিরপুর থানায় আসকারীর বিরুদ্ধে ৪৮ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেছেন। আর গত শনিবার (৩১ অক্টোবর) তাজুল ইসলাম নামে আরেক ব্যক্তি মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চাকরি দেওয়ার নাম করে আসকারী তার কাছ থেকে ৪৩ লাখ টাকা নিয়েছে বলে তিনি মামলায় অভিযোগ করেছেন।
‘সামনে টিভি ক্যামেরা ছিল, তাই একটু বানিয়ে বলেছি’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কে গিয়ে তার বাবা আমানুল্লাহ আসকারীকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ করেছিলেন বলে নামসর্বস্ব একটি কথিত অনলাইন টিভির সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন প্রতারক আসকারী। ওই সাক্ষাৎকারে প্রতারক আসকারী বলেন, ‘আমার জন্ম হলো মক্কাতে, বড় হয়েছি নিউ ইয়র্কে, সেটেলড আমস্টারডাম নেদারল্যান্ড। যদিও আমার বিজনেস দুবাইতে। আমি আমার বাবার বিজনেস দেখি, আমার বাবা হলেন নবাব আমানুল্লাহ সাহেব, উনি ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, ওয়ার্ল্ডে যত গোল্ড সাপ্লাই হয়, সেটা আমাদের ফ্যাক্টরি থেকে হয়। আমাদের ফ্যাক্টরি প্রথমে ছিল নিউ ইয়র্কে। পরবর্তীতে এই ফ্যাক্টরি আমি নিয়ে আসি দুবাইতে। এখন আমাদের গোল্ডগুলো দুবাইতে রিফাইন হয় এবং পুরা ওয়ার্ল্ডে সাপ্লাই হয়।’
ওই সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও মিথ্যাচার করেন আসকারী। তিনি বলেন, ‘আজ থেকে দুই বছর আগে শেখ হাসিনা যখন নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলেন আমার বাবার কাছে এবং বলেছিলেন, ভাই আমি অনেক অসুবিধায় আছি, আপনি বাংলাদেশে আসেন, সুষ্ঠু একটা নির্বাচন দেন, যে নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান আপনি হবেন এবং সুন্দর একটা নির্বাচন আপনি উপহার দেন। তখন আব্বা বলেছিলেন, না আমার বয়স হয়ে গেছে, আমার পক্ষে হয়তো এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যাওয়া সম্ভব না, তবে আমার একমাত্র ছেলে আলী হাসান আসকারী বাংলাদেশে যাবে। দেন আমি বাংলাদেশে আসি।’
গ্রেফতারের পর এই প্রতিবেদকের কাছে আসকারী বলেন, ‘আমার বাবা নিউ ইয়র্কে থাকেন না। তিনি পনের বছর আগে ঢাকার উত্তরায় মারা গেছেন। আমিও নেদারল্যান্ডে থাকি না। এসব মিথ্যা বলেছি। সামনে টিভি ক্যামেরা ছিল, তাই একটু বানিয়ে বলেছি।’
আসল পরিচয় শনাক্তের চেষ্টা
তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা আলী হাসান আসকারীর আসল পরিচয় জানার চেষ্টা করছেন। জিজ্ঞাসাবাদে আলী হাসান আহসান উল্লাহ সড়কে তাদের দুই কাঠার ওপর একটি বাড়ি ছিল বলে জানিয়েছেন। কিন্তু তার বাবা বেঁচে থাকা অবস্থাতেই ওই বাড়িসহ ওই জমি পুরানো ঢাকার হাজি সেলিমের কাছে বাধ্য হয়ে বিক্রি করে দেন। তবে আহসান উল্লাহ রোডে ওই বাড়ির কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তারা জানতে পেরেছেন আলী হাসান আসকারী প্রায় একযুগ আগে চুয়াডাঙ্গার এক নারীকে বিয়ে করেন। সে সময় তার নাম কি ছিল তা জানার জন্য তাদের বিয়ের কাবিননামা সংগ্রহের চেষ্টা চলছে।