X
বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

চোরাচালান ঠেকাতে সক্রিয় দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী

রিয়াদ তালুকদার
১১ জুলাই ২০২২, ০৮:০০আপডেট : ১১ জুলাই ২০২২, ০৮:০০
স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক ফেনসিডিল গাঁজা ও মানবপাচারের ঘটনা সম্প্রতি ভাবিয়ে তুলেছে প্রতিবেশী দুই দেশ বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি এবং ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফকে। দুই দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণে দুই বাহিনী নিজেদের মত কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাবার পরও অপরাধীরা নানা ফাঁকফোকরে চোরাচালান চালিয়ে যাচ্ছে। সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া কিংবা পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা না থাকায় সীমান্তবর্তী এলাকার অপরাধীরা সময় সুযোগ বুঝে বিভিন্ন জিনিসপত্র পাচার করছে। বিশেষ করে স্বর্ণ এমনই একটি ছোট জিনিস যার পাচারের ক্ষেত্রে স্পেসিফিক তথ্য না থাকলে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। বহন করে পাচারে অধিক লাভ হয় সেজন্য তৎপর কারবারীরা। প্রতিবার স্বর্ণ পাচারে সফল হলে তাদের লাভ থাকে লাখ টাকা করে। আর এই স্বর্ণ পাচারের ক্ষেত্রে ক্যারিয়াররা (বহনকারী) অনেক লাভবান হয় যে কারণে সম্প্রতি সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরা চালানের সংখ্যা বেড়েছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি অভিযানে চলতি বছরের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত সীমান্ত এলাকা থেকে প্রায় ৫৬ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। ২০২১ সালে প্রায় ৫১ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়। ২০২০ সালে ৮৭ কেজি ৭৬৬ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করা হয়। এদিকে, চলতি বছরের শুরু থেকে জুন পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ এর সাউথ বেঙ্গল রিজিয়নে অভিযান পরিচালনা করে প্রায় ৩৬ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। যা গত বছর উদ্ধারের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩১ কেজি। ২০২০ সালে স্বর্ণ উদ্ধারের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩২ কেজি।

বিএসএফ বলছে, বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ ভারতে ঢুকছে। বাংলাদেশ ট্রানজিট রোড হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে সীমান্ত রক্ষা সহ সীমান্তের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে বাহিনীর সদস্যরা। যখনই মাদক কিংবা স্বর্ণ চোরাচালানকারীর তথ্য পাওয়া যাচ্ছে তখনই সীমান্ত এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে এবং নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে। এছাড়া বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বিজিবি-র সাথে চোরাচালানকারী চক্রের সদস্যদের তথ্য আদান প্রদান করা হচ্ছে। যা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

বিজিবি বলছে, সীমান্তের দায়িত্বরত প্রতিটি সদস্য তারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিষ্ঠার সাথে পালন করার জন্য সব সময় মনিটরিং রাখা হয়। সীমান্ত এলাকাগুলোতে বিশেষ করে চোরা চালান কিংবা অপরাধ প্রবণ এলাকাগুলো বিবেচনায় সেসব এলাকায় বিশেষ টহল জোরদার রাখা হচ্ছে। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট সিসিটিভির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে বিভিন্ন এলাকা। বিভিন্ন এলাকায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কর্মপরিধি অনেক বেড়েছে। বিওপি ও ব্যাটালিয়নের সংখ্যাও বেড়েছে। এক বিওপি থেকে আরেক বিওপির দূরত্ব কমিয়ে আনতে কাজ চলছে। ইতোমধ্যে বিওপিতে জনবল বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কোনও এলাকায় জনবল বেশি প্রয়োজন হলে অন্য এলাকা থেকে রিসোর্স বাড়ানো হয়। মোট কথা, সীমান্তে চোরাচালান কিংবা অবৈধ পাচার রোধে বিজিবি কঠোর অবস্থানে রয়েছে।

শুধু স্বর্ণ নয় মাদক বিশেষ করে গাজা এবং ফেনসিডিল বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছে। সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা রাজশাহী হিলি এসব এলাকা দিয়ে ফেনসিডিল এবং গাজা বাংলাদেশে ঢুকে। যার ফলশ্রুতিতে দেশের ভেতর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে এসব গাঁজা এবং ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়। এর সাথে জড়িত ক্যারিয়াররা ধরা পড়ে আর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় মূল মাদক ব্যবসায়ীরা।

এক তথ্যে জানা গেছে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় বাংলাদেশ এবং ভারত দুপাশে মাদক ও স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত তিন থেকে চারটি করে সিন্ডিকেট রয়েছে। যারা মাদক এবং স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত। এসব চক্রের সদস্যরা যদি কখনো দুই বাহিনীর কারো কাছে ধরা পড়ে আর তখন যদি তাদের কাছে থাকা স্বর্ণ কিংবা গাঁজা কিংবা ফেনসিডিল সে পরিমাণ উদ্ধার না হয় তাহলে পরবর্তীতে সিন্ডিকেটের সদস্যরা বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে বাহিনীর কাছে খবর পৌঁছায়। চালানের আরো কিছু অংশ রয়েছে। এতে করে সিন্ডিকেটের সদস্যরা কেউ কোন ধরনের দুই নাম্বারী করার সুযোগ পায় না। প্রতিবার প্রতি পাচারে লাভ থাকে প্রায় লাখ টাকা করে।

বিএসএফ সাউথ বেঙ্গল-এর ডিআইজি এস এস গুলেরিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সীমান্ত এলাকা দিয়ে বিভিন্ন ছদ্মবেশে মাদক চোরাকারবারীরা যেমন সক্রিয় ঠিক সেভাবে স্বর্ণ চোরাচালানকারী নিত্য নতুন কৌশল অবলম্বন করে পাচারের চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে আমরা যেকোনো তথ্য পেলে সে তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে সীমান্ত এলাকা থেকে চোরাচরণকারীদের যেমন গ্রেফতার করছি তেমনি উদ্ধার করা হচ্ছে স্বর্ণ এবং বিভিন্ন মাদক। এছাড়া মানব পাচারের ঘটনা ঘটছে সীমান্ত এলাকা দিয়ে এই মানব পাচারকারী চক্রের বিষয়ের অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। সীমান্তে দু দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে আন্তরিকতা রয়েছে। যে কোন সমস্যা সমাধানে পতাকা বৈঠক করে সমস্যা সমাধান করি।

দু'দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময় সীমান্ত এলাকায় প্রীতি ভলিবল এবং ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। যা সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষদের মধ্যে আর ও সম্পর্ক জোরদার এ কার্যকরী ভূমিকা রাখে। ঠিক তেমনি বিজিবি এবং বিএসএফের মধ্যে মৈত্রী ভলিবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় গত ২৮ জুন ভারতীয় সীমান্ত এলাকা গোজাডাঙ্গায়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিজিবি-র যশোর রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ওমর সাদী। তিনি বলেন, বিজিবি এবং বিএসএফের মধ্যে সোহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যেকোনো সমস্যা সমাধানে আমরা দুই বাহিনী অত্যন্ত আন্তরিক রয়েছি।

স্বর্ণ এবং মাদক চোরাচালান বিষয়ে বিজিবির বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালান এবং মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে আমরা সর্বাত্মক সজাগ রয়েছি। সম্প্রতি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনা বেড়েছে। সেই সাথে স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত অনেককেই গ্রেফতার করা হচ্ছে। আমরা সজাগ রয়েছি সীমান্তে যে কোন অপরাধ ঠেকাতে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে আমরা অপরাধীদের এবং পাচারকারীদের চোরাচরণকারীদের তথ্য শেয়ার করি যা বর্তমানে অনেক কার্যকর ভূমিকা রাখছে সীমান্তে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে।

সীমান্তে গত তিন বছরে বিজিবি ও বিএসএফের যত উদ্ধার

বিজিবি ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত গাঁজা উদ্ধার করেছে ১৪ হাজার ৪২৮ কেজি, ফেনসিডিল ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৪৩ বোতল এবং ইয়াবা ৮১ লাখ ৩৭ হাজার ৬১৩ পিস। এসময় চোরাচালানকারী আটক হয়েছে ১ হাজার ৫৫২ জন এবং অবৈধ অনুপ্রবেশে আটক হয়েছে ১ হাজার ২৬৯ জন। সেই সঙ্গে অস্ত্র জব্দ করা হয়েছে ৫৩টি।

২০২১ সালে বাহিনীটি গাঁজা উদ্ধার করেছে ১৯ হাজার ৪৯২ কেজি, ফেনসিডিল ৩ লাখ ৩১ হাজার ৭৮৫ বোতল এবং ইয়াবা ২ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার ৯ পিস। এই সময়ে চোরাচালানকারী আটক হয়েছে ৩ হাজার ৫৯৯ জন এবং অবৈধ অনুপ্রবেশে আটক হয়েছে ২ হাজার ৩৭৪ জন। আর অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে ১১৬টি, সঙ্গে জব্দ হয়েছে ৯১৯ কেজি বিস্ফোরক বা গান পাউডার।

এর আগের বছর (২০২০ সালে) গাঁজা উদ্ধার করা হয়েছে ১৩ হাজার ৮৫৭ কেজি। এই সময়ে ইয়াব ট্যাবলেট উদ্ধার হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ ৮৯ হাজার ৮৪৯ পিস এবং ফেনসিডিল ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৮৬৯ বোতল ফেনসিডিল। ওই বছর স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে ৮৭ কেজি ৭৬৬ গ্রাম। আর চোরাচালানকারী আটক হয়েছে ৩ হাজার ৫৯৪ জন এবং অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে আটক হয়েছে ১৮১ জন। ২০২০ সালে
১২৫টি অস্ত্র, ২ কেজি ২০০ গ্রাম গান পাউডার এবং ২০টি ককটেলও জব্দ করে বিজিবি।

অন্যদেক ২০২২ সালের মে মাস পর্যন্ত ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ১৪ হাজার ৭৩৭ কেজি গাঁজা উদ্ধার করেছে। সেই সঙ্গে ফেনসিডিল ২ লাখ ২৮ হাজার ৩৩৭ বোতল এবং ইয়াবা ৩ লাখ ৫০ হাজার ৬৮৩ পিস। এই সময়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটক হয়েছে ১৪৪ জন। আর অস্ত্র জব্দ হয়েছে ৯৮টি।

আর ২০২১ সালে গাঁজা জব্দ হয়েছে ১৯ হাজার ১১৭ কেজি, ফেনসিডিল ৩ লাখ ৬ হাজার ৩৮৪ বোতল, ইয়াবা ট্যাবলেট ৭ লাখ ৬৯ হাজার ৮৫১ পিস। এই সময়ে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে আটক হয়েছেন ৪১৩ জন। এসময় জব্দ হয়েছে ২১৪টি অস্ত্র।

২০২০ সালে গাঁজা জব্দ হয়েছে ১১ হাজার ৭৬৭ কেজি, ফেনসিডিল ৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯৯৮ বোতল এবং ইয়াবা ট্যাবলেট ৬ লাখ ৭৭ হাজার ৭৮২ পিস। ওই বছর অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে বাহিনীটি ৩৯০ জনকে আটক করেছে এবং অস্ত্র জব্দ হয়েছে ২৬৮টি।


 
 
 
 
/ইউএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাজশাহীতে গুটি আম পাড়া শুরু, কেজি ৪০ টাকা
রাজশাহীতে গুটি আম পাড়া শুরু, কেজি ৪০ টাকা
রাজস্থানের শীর্ষ দুইয়ে থাকা কঠিন করে দিলো পাঞ্জাব
রাজস্থানের শীর্ষ দুইয়ে থাকা কঠিন করে দিলো পাঞ্জাব
লন্ডনে অবৈধ অভিবাসীদের খোঁজে অভিযান, বাঙালিপাড়ায় উৎকণ্ঠা
লন্ডনে অবৈধ অভিবাসীদের খোঁজে অভিযান, বাঙালিপাড়ায় উৎকণ্ঠা
মাধ্যমিকে ছেলেরা কেন পিছিয়ে?
মাধ্যমিকে ছেলেরা কেন পিছিয়ে?
সর্বাধিক পঠিত
নিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
নিয়োগ বাণিজ্য করে কোটি টাকা আত্মসাৎনিজের বাসায় পরীক্ষা নিয়েছিলেন কর কর্মকর্তা!
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলির ফল প্রকাশ
১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের প্রিলির ফল প্রকাশ
ঢাকায় চলবে না ব্যাটারিচালিত রিকশা
ঢাকায় চলবে না ব্যাটারিচালিত রিকশা
যে কারণে রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল
যে কারণে রাজশাহীর তিন প্রতিষ্ঠানের শতভাগ শিক্ষার্থী ফেল
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খান এই ৫ খাবার
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে খান এই ৫ খাবার