X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১
আঙুলের অপারেশন করতে গিয়ে মৃত্যু

হাসপাতালে কী হয়েছিল মাইশার সঙ্গে?

আব্দুল হামিদ
০৪ ডিসেম্বর ২০২২, ০৭:১৩আপডেট : ০৬ ডিসেম্বর ২০২২, ২১:৫১

মারুফা জাহান মাইশা (৫)। ৯ মাস বয়সে চুলার আগুনে ডান হাতের আঙুল পুড়ে যায়। এতে তিনটি আঙুল স্বাভাবিকভাবে নাড়াতে পারতো না সে। কন্যার ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিকিৎসা করাতে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন বাবা-মা। সুস্থ-সবল ফুটফুটে সেই মাইশাকেই বাড়ি ফিরতে হলো লাশ হয়ে। লাশের গোসল করাতে গেলে দেখা যায়—নাভির নিচে এপাশ থেকে ওপাশ সেলাই করা লম্বা কাটার দাগ। আঙুলের অপারেশনের জন্য পেটে কেন এত বড় কাটা—সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে রোগীর পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন। সার্জারিতে অনেক সময় চামড়ার প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু এভাবে পেটের এপাশ-ওপাশ কেটে চামড়া নেওয়াকেও অস্বাভাবিক মনে করছেন খোদ চিকিৎসকরাই। আর মাইশার বাবা প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মেয়ের আঙুলের অপারেশন করতে নিয়ে গেলাম। কিন্তু পেট কাটা কেন?’

ঘটনাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে শনিবার (৩ ডিসেম্বর) সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অনুসন্ধান চালায় বাংলা ট্রিবিউন। এসময় হাসপাতাল পরিচালনার সরকার অনুমোদিত কোনও কাগজপত্র দেখাতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালের লাইসেন্স রিসিপশনেই ঝুলিয়ে রাখতে হয়, কিন্তু হাসপাতালটিতে সেটা নেই।

গত বুধবার (৩০ নভেম্বর) সকালে ঢাকার রূপনগরে আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে অস্ত্রোপচার হয় মাইশার। সেদিন সকালেই তাকে অপারেশন থিয়েটারে (ওটি) নেওয়া হয়। ঘণ্টা দেড়েক ওটিতে রাখার পর তারা জানায়, রোগীর অবস্থা খারাপ। তাকে এখনই আইসিইউ সাপোর্ট দিতে হবে। পরে হাসপাতাল থেকে একটি গাড়িতে করে মিরপুর-১ মাজার রোডের গ্লোবাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে নেওয়ার পর হাসপাতালটির মেডিক্যাল অফিসার ডা. তৌহিদুল মাইশাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালের একজন আয়া নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অপারেশনের সময়ই শিশুটি ওটিতেই মারা যায়। পরে তড়িঘড়ি কর্তৃপক্ষ হাসপাতালের একজন নার্সকে দিয়ে বাবাসহ শিশুটিকে আইসিইউর কথা বলে বের করে দেয়। এ সময় মাইশার মা ও নানি ওটির কাছেই বসা ছিলেন। তাদের বিভিন্নভাবে সান্ত্বনা দেওয়া চেষ্টা করা হয়। পরে লাশসহ মেয়ের বাবা সেখানে ফিরে এলে রাস্তা থেকেই তাদের একটি গাড়িতে উঠিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

রাজধানীর মিরপুরের রূপনগর আবাসিক মোড় এলাকার হাসপাতালটিতে শনিবার (৩ ডিসেম্বর) সকালে গিয়ে অপারেশনের সময় তোলা ছবি ও কাগজপত্র দেখে এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বললে বেরিয়ে আসে শিউরে ওঠার মতো তথ্য। হাসপাতালটিতে ওই শিশুর অপারেশন সংশ্লিষ্ট কোনও কাগজপত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।

প্রধান সড়কের পাশে নীল রঙের কাচে ঢাকা ৯ তলা ভবনটির ৫ থেকে ৯ তলা পর্যন্ত আলম মেমোরিয়াল হাসপাতাল।

হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, ৮ তলায় রিসিপশন। সেখানে দুই জন দায়িত্ব পালন করছেন। একই তলায় রয়েছে সাইফুল নাহার নাতাশাসহ আরও তিন ডাক্তারের চেম্বার এবং হাসপাতালের বিভিন্ন সেকশন। সামনে রোগীদের বসার ব্যবস্থা। এর ওপরে প্রশাসনিক ফ্লোর, কেবিন ফ্লোর, সাধারণ বেড ফ্লোর। হাসপাতালটির সবই নতুন, আসবাবসহ বেশিরভাগ জিনিসপত্র এখনও খোলা হয়নি। হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারটি অন্য ফ্লোরগুলোর নিচে অবস্থিত। ওই ফ্লোরে গিয়ে শুরুতেই তালা ঝুলতে দেখা যায়। পরে হাসপাতালের ইনচার্জের সহযোগিতায় ভিতরে প্রবেশ করে দেখা যায়—ডাক্তারদের বসার রুম, নার্স স্টেশন, ডান হাতে ওটি রুম। সাদামাটা রুমটি এখনও অপারেশনের জন্য প্রস্তুত মনে হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কথায়ও এর সত্যতা মেলে।

হাসপাতালে কী হয়েছিল মাইশার সঙ্গে?

তথ্যের ভিত্তিতে সেখান থেকে যাওয়া হয় মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে ডা. মো. আহসান হাবীবের খোঁজে। সেখানে গিয়ে জানা গেলো, তিনি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চেম্বার করেন। ২০১৫ সালের মার্চ থেকে প্রতিদিন তিনি রোগী দেখেন এখানে।

মোবাইল ফোনে ধারণ করা একটি ভিডিও ফুটেজ বাংলা ট্রিবিউনের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, নিহতের ডান হাতের আঙুল কাটা-ছেঁড়া। কাটা অংশে সেলাইয়ের সুতা ঝুলছে। আবার নাভির ওপরে পেটের পুরোটা অংশ কাটা, ভালোভাবে সেলাইও করা।

চিকিৎসকরা যা বললেন

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের প্রধান অধ্যাপক বিধান সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, অপারেশনের সময় অনেক ক্ষেত্রে শরীরের অন্য স্থান থেকে চামড়া কেটে আনার প্রয়োজন হয়। তবে সেটা আহামরি কিছু না।

ঢামেকে সহকারী অধ্যাপক শরিফুল ইসলাম নামে কেউ আছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই নামে আগে একজন ছিলেন, এখন নেই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেকজন ডাক্তার বলেন, ‘আমি মেয়েটির পেট কাটা অংশ দেখেছি। চামড়া নেওয়ার জন্য অনেক সময় কাটা হয়। কিন্তু এটা অস্বাভাবিক কাটা। এত বেশি কাটার কোনও প্রয়োজন পড়ে না। অপারেশন থিয়েটারে কী হয়েছে, তা সেখানে থাকা ডাক্তাররই ভালো বলতে পারবেন।’

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য

আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. সৈয়দ মাসুদ রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি অন্যায় কিছু করিনি, ক্ষতিও করিনি। এই হাসপাতাল ও ভবন আমারই। আমি অন্য কোথাও কিছু করি না। এখানেই চেম্বার করি।’

আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. সৈয়দ মাসুদ রহমান

ওই ঘটনার পরে ১ ডিসেম্বর হাসপাতালে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) দায়িত্ব নেন জিকরুল্লাহ স্বপন। তিনি বলেন, ‘তিন মাস আগে হাসপাতালটি চালু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ট্রেড লাইসেন্সও পায়নি হাসপাতালটি। গত মাসের ৪ নভেম্বর ট্রেড লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছে স্বপন। বর্জ্য অপসারণের লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিস অনুমোদন আছে এবং এপ্রিল মাসে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের অনাপত্তির জন্য আবেদন করা হয়েছে। এরমধ্যে ৩০ নভেম্বর এখানে একটি শিশু অপারেশনের সময় মারা যায়। এটা মর্মান্তিক, এতে আমরা শোকাহত। এছাড়া আমরা উপস্থিত ছিলাম না।’

অপারেশনের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডা. শরিফুল ইসলাম সম্পর্কে কিছুই জানি না, দেখিওনি। এই প্রথম ডা. শরিফুল ইসলাম এখানে এসেছেন, তিনি ডা. আহসান হাবীবের বন্ধু। অপারেশন শুরু হয় পৌনে ১১টায়। চার ঘণ্টার একটি অপারেশন। ২ ঘণ্টা পরে রোগী আর অ্যানেস্থেশিয়া গ্রহণ করছিল না। তখন রোগীকে বাঁচাতে আগে আইসিইউতে পাঠানো হয়। আমাদের তো আইসিইউ নেই। পরে গ্লোবাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন।’

টাকা ফেরত ও কাগজপত্র না দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে স্বপন বলেন, ‘ওই রোগী আমাদের এখানে ভর্তি হয়নি। এজন্য আমাদের কাছে তার কোনও কাগজ নেই। রোগীটি ডা. আহসান হাবীবের। তিনি জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক এবং মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে নিয়মিত চেম্বার করেন। যদি কোনও রোগী থাকে তিনি (হাবীব) আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসেন। নিজেই ফাইল তৈরি করেন। নিজের অধীনেই রাখেন। আমাদের শুধু সার্ভিস চার্জ দেন। কিন্তু ওই রোগীর কাছ থেকে আমরা কোনও সার্ভিস চার্জও পাইনি।’

তিনি বলেন, ‘অপারেশনের পরে কোনও রোগী থাকার দরকার হলে থাকেন, না হলে চলে যান। এখানে কেবিন বেড ভাড়া ১৫০০-২০০০ টাকা। আর সাধারণ বেড ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা নিয়ে থাকি। আমরা এখনও বড় করে শুরু করিনি। এখন ছোটখাটো অপারেশন করেন ওনারা। ডা. হাবীব এখন পর্যন্ত ৩-৪টা রোগীর অপারেশন করেছেন। এই হাসপাতালে ডা. হাবীব নিয়মিত চেম্বার করেন না। কোনও অপারেশনের রোগী পেলে নিয়ে আসেন।’

ঘুরে দেখা যায়—পুরো হাসপাতালে একটি রোগীও নেই। হাসপাতালের এই পরিবেশে কোনও রোগীকে অপারেশন করা যায় কিনা জানতে চাইলে জিকরুল্লাহ স্বপন বলেন, ‘হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু না হলেও অপারেশনের জন্য প্রস্তুত করা আছে।’ তাছাড়া আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে ডা. আহসান হাবীবের শেয়ার থাকার প্রচারণার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডা. হাবীবের এখানে শেয়ার থাকার কথাটি সঠিক নয়।’

আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালর অপারেশন থিয়েটার

হাসপাতালে গেলে প্রথমে কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী কথা বলতে রাজি হয়নি। তারা জানান, হাসপাতালটির সবাই ১ ডিসেম্বর এখানে যোগদান করেছেন। তারা কেউ ওই ঘটনা সম্পর্কে জানেন না। হাসপাতালটির মার্কেটিং ম্যানেজার বলে পরিচয় দেওয়া মুসা নামে একজন বলেন, ‘আগে এই হাসপাতালের মালিকের নাম ছিল মাসুদ। কিন্তু এখন মালিক জিকরুল্লাহ স্বপন।’ তবে এ বিষয়ে মাসুদ ও স্বপন উভয়েই জানান, এখানে মালিক পরিবর্তন হয়নি। তবে ১ ডিসেম্বর থেকে স্বপনকে নতুন দায়িত্ব দেওয়া হয়।

ডা. আহসান হাবীবের বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে সম্ভব না, এমন অপারেশন এখানে (ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে) করা হয় না। অনেক সময় ডাক্তাররা রোগীদের বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে অপারেশন করান। এখন যদি কোনও রোগী মারা যায়, তাহলে তার দায়ভার ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের না। ডা. হাবীব এখানে স্টাফ ডাক্তার না। তিনি এখানে শুধু চেম্বার করেন।’ এই ঘটনার পরে আপনারা তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেবেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।’

ঘটনা

কুড়িগ্রাম পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ভেলাকোপা ব্যাপারী পাড়ার মোজাফফর আলী ও বেলি আক্তার দম্পতির মেয়ে মাইশা। নানা ওসমান গণি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। ৯ মাস বয়সে মাইশার ডান হাতের আঙুল চুলার আগুনে পুড়ে যায়। সে সময় রংপুরে চিকিৎসা করে হাতের ক্ষত ভালো হলেও কুঁকড়ে যায় তিন আঙুল। মেয়ের হাত ভালো হবে— এমন আশা নিয়ে সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের ডাক্তার মো. আহসান হাবীবের শরণাপন্ন হন মাইশার বাবা মোজাফফর। পাঁচ বছর বয়সী মাইশার হাত দেখে চিকিৎসক বলেন, ‘অপারেশন করলে স্বাভাবিক হবে’।

সে অনুযায়ী গত ৩০ নভেম্বর সকালে ঢাকার রূপনগরে আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে হাতের অপারেশন হয় শিশুটির। অস্ত্রোপচারের ঘরে ঘণ্টা দেড়েক রাখার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, অবস্থা খারাপ। তাকে আইসিইউ সাপোর্ট দেওয়ার জন্য গ্লোবাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিতে হবে। হতবিহ্বল বাবা-মা মেয়েকে নিয়ে ছোটেন মিরপুর-১ মাজার রোডের সেই হাসপাতালে। সেখানে নেওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় মারা গেছে মাইশা।

ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অপারেশনের জন্য নেওয়া টাকা ফিরিয়ে দেয় শিশুটির বাবা-মাকে। লাশ বাড়িতে আনতে ঠিক করে দেয় অ্যাম্বুলেন্সও। বাড়ি ফিরে যখন মাইশাকে দাফনের জন্য গোসল করানো হবে, তখন গোসল করানো নারীরা দেখতে পান মাইশার নাভির নিচে পেটজুড়ে কেটে সেলাই করা। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শুরু হয় নানা গুঞ্জন।

স্বজনরা পুলিশে খবর দেন। কিন্তু ঢাকায় অপারেশন হওয়ায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলার পরামর্শ দিয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। পরে নিরুপায় স্বজনরা শিশুটিকে বাড়ির আঙিনায় দাফন করেন।

মাইশার মৃত্যুতে এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল

তবে মেয়ের ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যু কোনোভাবেই মানতে পারছেন না তার বাবা-মা, স্বজন ও প্রতিবেশীরা। মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে তদন্তের দাবি করেন তারা। ঘটনাটিকে হত্যা দাবি করে শনিবার কুড়িগ্রামে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন এলাকাবাসী। মিছিলকারীরা পৃথকভাবে জেলা প্রশাসক কার্যালয়, পুলিশ সুপার কার্যালয় ও সদর থানার সামনে অবস্থান নিয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসক আহসান হাবীবসহ সংশ্লিষ্টদের বিচার দাবি করেন।

নিহত মাইশার বাবা যা বলছেন

মিরপুর ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে আমার মেয়েকে দেখালে ডা. হাবীব পরীক্ষা করে বলেন, প্লাস্টিক সার্জারি করালে ঠিক হয়ে যাবে। এই হাসপাতালে অপারেশনে টাকা অনেক বেশি লাগবে। রূপনগরে আলম মেমোরিয়াল হাসপাতালে আমার শেয়ার আছে, সেখানে করালে কম টাকায় হয়ে যাবে। কত লাগবে জানতে চাইলে বলেন, যেহেতু আমার এলাকার মানুষ তুমি, ৬০ হাজার টাকা দিবা। সেখানে আমার বন্ধুকে নিয়ে তোমার মেয়ের অপারেশন করবো।

অপারেশনের দিন টানা চার ঘণ্টা অপারেশন করতে হবে বলে জানান ডা. হাবীব। ঘণ্টাখানেক পরে বের হয়ে বলেন, অপারেশন সুন্দর হয়েছে। এর কিছুক্ষণ পরে এসে আমাকে বলেন, বাচ্চাটার একটু সিরিয়াস অবস্থায়। তাড়াতাড়ি আইসিইউতে নিতে হবে। এখানে আইসিইউ নেই, অন্য হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু এটা ছিল নাটক!

পরে গ্লোবাল স্পেশালাইজড হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে জরুরি বিভাগের ডাক্তার আমার মেয়ের হাত ধরেই বলেন, বাচ্চা মারা গেছে।

পরে লাশ নিয়ে আবার রূপনগরে হাসপাতালের সামনে এলে আমার দেওয়া ৫০ হাজার টাকা ফেরত দেয় সেখানকার লোকজন। অপারেশনের আগ পর্যন্ত যেসব কাগজপত্র আমাদের দেওয়া হয়, সেগুলো ওই সময় ডা. হাবীব নিয়ে নেন।

মাইশার স্বজনদের আহাজারি

এছাড়া ডা. হাবীবসহ হাসপাতালের পক্ষ থেকে লাশ বাড়ি নিয়ে আসার জন্য একটি গাড়ি ভাড়া করে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই গাড়ি মাঝপথে এসে আমাদের নামিয়ে দেয়। পরে আমরা অন্য একটি গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি আসি।

অপারেশনের সময় আমার মেয়ের পেট কাটা হয়েছে জানতাম না। লাশ গোসল দেওয়ার সময় কাটার বিষয়ে জানা যায়। মেয়ে হত্যার বিচার দাবি করে তিনি বলেন, এ বিষয়ে থানায় মামলা করতে গেলে নেয়নি। ঘটনাস্থল ঢাকা উল্লেখ করে সেখানে মামলা করতে বলেছে।

যা বলছেন ডা. হাবীব

হাতের অপারেশন করতে গিয়ে মাইশার মৃত্যুর কারণ কী—এমন প্রশ্নে ডা. আহসান হাবীব বলেন, ‘আমি নিজেও অপারেশন থিয়েটারে প্রায় আধঘণ্টা ছিলাম। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল। পরে আমি বাসায় চলে যাই।’

শিশুটির মৃত্যুর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সম্ভবত অ্যানেস্থিসিয়ার কারণে শিশুটির মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে। আসলে বেশিক্ষণ অ্যানেস্থেটিক অবস্থায় থাকায় হয়তো সহ্য করতে পারেনি। এখানে অন্য আর কোনও কারণ নেই। তবে পুরো ঘটনায় আমি নিজেও মর্মাহত।’

তিনি আরও বলেন, ‘রোগীটা আমার এলাকার। কুড়িগ্রামের যেকোনও লোক এলে আমি সহায়তা করি। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এটা আসলে অ্যাকসিডেন্ট (দুর্ঘটনা)। তারপরও মেনে নেওয়া কঠিন। আমি নিজেও সেদিন স্তব্ধ হয়ে গেছি।’

যা বলছে পুলিশ

মামলা না নেওয়ার বিষয়ে কুড়িগ্রাম সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খান মো. শাহরিয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঘটনাস্থল ঢাকা হওয়ায় সেখানে মামলা করতে বলা হয়েছে।

কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রুহুল আমিন বলেন, নিহত শিশু মাইশার স্বজনদের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত শুনেছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

শিশুটির পরিবার কুড়িগ্রাম সদর থানায় গেলেও অভিযোগ না নেওয়ার বিষয়ে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) মো. মনজুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টা জানি না, জেনে দেখবো। পরে এ বিষয়ে বলতে পারবো।’

আরও পড়ুন:

আঙুলের অপারেশনে শিশুর মৃত্যু, গোসলের সময় দেখা গেলো পুরো পেটে সেলাই

শিশু মাইশাকে অপারেশনের নামে হত্যার অভিযোগ, এলাকাবাসীর বিক্ষোভ

/এমএস/ইউএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
গরমে হাসপাতালে বাড়ছে ডায়রিয়া রোগী
গরমে ডায়রিয়া রোগী আরও বাড়ার শঙ্কা
মৌসুমের আগেই চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু, পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে?
সর্বশেষ খবর
কণ্ঠের সুচিকিৎসা দেশেই সম্ভব: বিএসএমএমইউ ভিসি
কণ্ঠের সুচিকিৎসা দেশেই সম্ভব: বিএসএমএমইউ ভিসি
গরু অথবা মাংস আমদানির বিকল্প কী?
গরু অথবা মাংস আমদানির বিকল্প কী?
ক্রিমিয়ায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের দাবি ইউক্রেনের
ক্রিমিয়ায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের দাবি ইউক্রেনের
প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী
প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে বেসরকারি খাতকে উদ্যোক্তা হিসেবে দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
এএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
রেস্তোরাঁয় ‘মদ না পেয়ে’ হামলার অভিযোগএএসপি বললেন ‌‘মদ নয়, রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলাম’
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
মেট্রোরেল চলাচলে আসতে পারে নতুন সূচি
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত করতে নতুন উদ্যোগ রাজউকের
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
‘আমি এএসপির বউ, মদ না দিলে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেবো’ বলে হামলা, আহত ৫
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট
ফিলিস্তিনের পূর্ণ সদস্যপদ নিয়ে জাতিসংঘে ভোট