X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ডিবির জাল টাকার মামলাই জাল

আব্দুল হামিদ
১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৪৫আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ১৪:১৫

রাজধানীর পল্টনের আবাসিক ‘হোটেল বন্ধু’র ম্যানেজার হাসান মজুমদার। গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) দেওয়া জাল টাকার মামলায় জেল খেটেছেন প্রায় ছয় মাস। এরপর পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনেই বলা হয়েছে, ‘হাসান মজুমদারের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা পুলিশের এফআইআর-এর ঘটনাস্থল ও জাল টাকা জব্দ করার বিষয়ে কোনও সত্যতা পাওয়া যায়নি। তিনি নির্দোষ।’ তারপরও দীর্ঘ প্রায় ছয় বছর যাবত মামলার বোঝা টেনে চলছেন তিনি।

ডিবি পুলিশের মামলা থেকে রেহাই পেতে হাসান মজুমদার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি), প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিকার চেয়ে আবেদন করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ সদর দফতর থেকে ডিবির ৮ সদস্যের বিরুদ্ধে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তিন কমিটির তদন্তেই হাসান মজুমদারকে হয়রানি করার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। ‘তার বিরুদ্ধে দায়ের করা জাল টাকা মামলার সত্যতা পাননি’ বলেও উল্লেখ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। তদন্ত কমিটির এক কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেওয়ার শর্তে ভুক্তভোগী হাসান মজুমদার ও তার বাবুর্চি সোহেল রানা তাদের অভিযোগ প্রত্যাহার করে নিলেও চার্জশিট থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়নি। ফলে এখনও তারা মামলার ঘানি টেনে চলেছেন।

ডিবি সদস্যরা পল্টন বন্ধু হোটলের কাউন্টারে

বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর দুপুর ১২টা ২৭ মিনিটে পল্টন ‘বন্ধু হোটেল’র (আবাসিক) রিসিপশনের আসন  থেকে হাসান মজুমদার ও বাবুর্চি সোহেল রানাকে হ্যান্ডক্যাফ পড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় ফকিরাপুল থেকে জাল টাকাসহ তাদের আটক করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ঢাকা মহানগর পুলিশের গুলশান বিভাগের তখনকার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ সাহেদ মিয়া তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ‘ঘটনার সময়ের ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সদস্যরা প্রথমে বাবুর্চিকে আটক করে। এরপর কাউন্টারে গিয়ে হোটেলের কাউন্টার থেকে হাসান মজুমদারকে গ্রেফতার করেছে। কোনোরূপ জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা তল্লাশি না করে হাতে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেফতারের বিষয়টি ভিডিও ফুটেজে দৃশ্যমান। এছাড়া সিসি ক্যামেরা বন্ধে ডিবি পুলিশের তৎপরতা তাদের অসৎ উদ্দেশ্যের বিষয়টি পরিষ্কার করে।’

পুলিশের এই কর্মকর্তা তার তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করেন, ‘গোয়েন্দা পুলিশের দায়ের করা জাল টাকার মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। তবে মামলার এজাহারে উল্লিখিত অভিযোগকারীকে গ্রেফতার করার ঘটনাস্থলের সঙ্গে সিসিটিভি ফুটেজের তথ্যের কোনও মিল পাওয়া যায়নি। তাকে হোটেল কাউন্টার থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাকে তল্লাশি করে জাল টাকা উদ্ধারের কোনও দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়নি। হাসান মজুমদারের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া এফআইআরের ঘটনাস্থল ও জাল টাকা উদ্ধারের কোনও সত্যতাই পাওয়া যায়নি।’

হাতকড়া পরানো হচ্ছে হোটেলের ম্যানেজার ও বাবুর্চিকে

ভুক্তভোগী হাসান মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর গ্রেফতারের পর ২৫ লাখ জাল টাকার মিথ্যা মামলায় ৫ মাস ১৭ দিন জেল খেটেছি। বর্তমানে জামিনে থাকলেও প্রতিমাসে আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘‘কাউন্টার থেকে আমাদেরকে মিন্টু রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। দুপুর থেকে বসিয়ে রেখে ডিবি কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জুয়েল রানার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। বর্তমানে তিনি ডিবির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হিসেবে রমনা বিভাগের দায়িত্ব পালন করছেন। আমাদের বাইরে বসিয়ে রেখে তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। পরে ওই টিমের সদস্য তপন কুমার ঢালী নামে এক সদস্য বেরিয়ে এসে বলেন, ‘তিন লাখ টাকা দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে। না দিলে মামলা হবে।’ কী মামলা হবে জানতে চাইলে বলেন, ‘জাল টাকার মামলা হবে।’ এরপর টাকা না দেওয়ায় আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে।’’

অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বক্তব্য

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদী পুলিশ পরিদর্শক তপন কুমার ঢালী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এ বিষয়ে তো কিছু বলা যায় না। তবে আপনি ডিবি অফিসে খোঁজ নেন। ওই সময়ের যিনি কর্মকর্তা ছিলেন (জুয়েল রানা) তার কাছে। আমরা তো কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছাড়া কিছুই করতে পারি না। এছাড়া কর্তৃপক্ষ ছাড়া মিডিয়ায় বক্তব্য দেওয়া ঠিক না।’

তিনি বলেন, ‘মানুষের বিপদ-আপদ হয়। একজনকে ধরে আনার পরে কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই করে। সরকার বাদী মামলা, বুঝেন না! আমরা কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ফলো করতে বাধ্য।’

এই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক দেওয়ান উজ্জল হোসেন বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমি এখন ডিবিতে নাই। এই মামলা নিয়ে অনেক বার কথা বলা হয়েছে, আবার আলোচনা কিসের।’

অভিযোগের বিষয়ে এডিসি জুয়েল রানা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মামলাটি আদালতে বিচারাধীন আছে। এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

হাতকড়া পরানোর পর কথা বলছেন তারা

সাক্ষীদের ভাষ্য

পল্টনের ওই মার্কেটের ফাতেমা এন্টারপ্রাইজের মালিক রুবেল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর হাসান মজুমদারকে এখান (হোটেল) থেকে গোয়েন্দারা ধরে নিয়ে যায়। আমরা (দোকান মালিক) জানার চেষ্টা করছিলাম— কেন তাকে নিয়ে যাচ্ছে। পরের দিন জানতে পারলাম, পুলিশ নাকি ফকিরাপুল থেকে হাসানকে জাল টাকাসহ ধরছে।’ তিনি বলেন, ‘পুলিশ হয়রানিমূলকভাবে এটা করলো। পুলিশেরও বিচার হওয়া দরকার, তা না-হলে আমরা যাবো কোথায়। আমরা এই ঘটনার বিচার চাই।  হাসান নির্দোষ। জড়িত পুলিশদের শাস্তি দেওয়া হোক। আমার এই ঘটনার সাক্ষী দিতে ডিবি কার্যালয় গেছি, অনেক বার।’

বন্ধু সেলুনের কর্মী শ্রী হরিপদ বলেন, ‘সেদিন আমি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখি, চার-পাঁচ জন লোক হাসান ভাইকে হাতকড়া পরানো অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ফকিরাপুল থেকে জাল টাকাসহ আটক দেখিয়ে মামলা দেওয়া হয়েছে। এটা তো সাধারণ মানুষের সঙ্গে দুর্নীতি করা হচ্ছে। ডিবি পুলিশ যদি এভাবে কাজ করে, তাহলে তাদের থেকে আমাদের আর  আশা থাকে না।’

সৌদিয়া কমিউনিকেশনের মালিক হোসেন বলেন, ‘ওই ঘটনায় পুলিশ সদর দফতর, ডিবি কার্যালয়, কোর্টে গিয়ে অনেক বার সাক্ষ্য দিয়েছি। তারপরেও এই বিষয়ে কোনও সমাধান হচ্ছে না। কিন্তু নিরীহ ছেলেটাকে এখান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে জাল টাকার মামলায় ফাঁসানো হলো। আমরা চাই, হাসানকে এই মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হোক এবং তাকে  ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক।’  হাতকড়া পরানো অবস্থায় হোটেল থেকে নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে

তদন্ত কমিটির সদস্যদের বক্তব্য

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান ক্যান্টনমেন্ট জোনের এডিসি মোহাম্মদ সাহেদ মিয়া। তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন এরই মধ্যে ডিএমপি কমিশনার বরাবর জমা দিয়েছি। সেখানে আমি বিষয়টি তুলে ধরেছি।’ প্রতিবেদন অত্যন্ত গোপনীয় জানিয়ে তিনি এ বিষয়ে আর কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পুলিশ সদর দফতরের গঠিত অপর তদন্ত কমিটির প্রধান এএসপি ওমর ফারুক বলেন, ‘বিষয়টি ভুক্তভোগীর সঙ্গে সমঝোতা করে দেওয়া হয়েছে।’ অভিযোগ প্রত্যাহার করার পর শর্তানুযায়ী মামলার চার্জশিট থেকে তাদের (হাসান ও সোহেল) নাম বাদ দেওয়া হয়নি। মামলায় তাদের নিয়মিত হাজিরা দিতে হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এএসপি ওমর ফারুক কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি।

কেন টার্গেট করা হলো হাসান মজুমদারকে

হাসান মজুমদার বলেন, ‘পুলিশ হোটেলে প্রায়ই আসতো। বিভিন্ন বিশেষ দিবস ও বিশেষ অভিযানের সময় হোটেলে এসে খোঁজখবর নিতো। হোটেলে কারা আছেন, তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিতো। তবে আমাকে কেন টার্গেট করা হলো, সেটা আমি জানি না। এই ঘটনার আগে আমার নামে কোনও মামলা বা জিডি কিছুই ছিল না। পুলিশও কখনও আমার বিষয়ে অভিযোগ নিয়ে আসেনি। কিন্তু হঠাৎ করে কী কারণে ওই দিন পুলিশ আমাকে ও হোটেলের বাবুর্চিকে ধরে নিয়ে জাল টাকার মামলা দিলো, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে।’

/জেইউ/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
র‌্যাবের নতুন মুখপাত্র কমান্ডার আরাফাত
র‌্যাবের নতুন মুখপাত্র কমান্ডার আরাফাত
২০৪১ পর্যন্ত কর অব্যাহতি আদায় করতে চাই: মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম
বেসিস নির্বাচন২০৪১ পর্যন্ত কর অব্যাহতি আদায় করতে চাই: মোস্তাফা রফিকুল ইসলাম
মিয়ানমার থেকে দেশে ফিরছেন দেড় শতাধিক বাংলাদেশি
মিয়ানমার থেকে দেশে ফিরছেন দেড় শতাধিক বাংলাদেশি
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মসলা