দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল বা খোলাবাজারে খাদ্যপণ্য বিক্রি) এর ট্রাকের সমানে লাইন আরও দীর্ঘ হয়েছে। নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য সরকার এই ব্যবস্থা চালু করলেও মধ্যম আয়ের অনেকে এই লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। অভিযোগ উঠেছে, সঠিকভাবে মিলছে না ওএমএস'র পণ্য। গায়ের জোরে ঠেলাঠেলি আর সুবিধাভোগীদের কারণে রেশন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বয়স্ক ও প্রকৃতরা। সমাধানে সিরিয়াল নম্বর দেওয়ার দাবি তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
বৃহস্পতিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বেশ কয়েকটি স্থানে ওএমএস ট্রাকসেল পয়েন্ট ঘুরে দেখা যায়, রেশনের জন্য চলছে হুড়োহুড়ি। লাইন না মেনেই ট্রাকের সামনে গিয়ে জমানো হচ্ছে ভিড়। ফলে সুষ্ঠুভাবে লাইনে দাঁড়ানো বয়স্ক ক্রেতারা বারবার পিছিয়েও পড়ছেন৷ কেউ এই বিশৃঙ্খলার বাধা দিতে গেলে ঘটনা জড়াচ্ছে হাতাহাতিতে। অথচ অধিকাংশ ট্রাকের আশপাশে নেই তদারকি দায়িত্বে থাকা খাদ্য পরিদর্শক।
ট্রাকের ওপরে থাকা ডিলারদের মাথাব্যাথা নেই নিচে দাঁড়ানো ভোক্তাদের এসব ঝামেলা নিয়ে। ট্রাকে থাকা পণ্য বিক্রি শেষ করে ফিরতে পারলেই বাঁচেন তারা।
মিরপুর বড় মসজিদ রোডে সকাল ৭ থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন নাজমা খাতুন। তিনি অভিযোগ করেন, ‘সিরিয়াল মতো দিলে আমার এত সময় কষ্ট করে লাইনে দাঁড়ানো লাগে না। অথচ বারবার কোথা থেকে কিছু মহিলা আসে, সিরিয়াল না মেনেই ধাক্কাধাক্কি করে সামনে চলে যায়। আমরা লাজলজ্জার জন্য কিছু বলতেও পারি না। ধাক্কাধাক্কিও করা সম্ভব না। দাঁড়িয়ে আফসোস করি।’
কয়েকজন বলেন, ধাক্কাধাক্কির অন্যতম কারণ পণ্যের অসমতা। প্রত্যেক ট্রাকেই ২০০০ কেজি চাল থাকে। তবে আটা থাকে ১০০০ কেজি। ফলে আগে আগে পণ্য না পেলে পরে কেবল চাল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই চিন্তা থাকে অনেকেই সিরিয়াল ভেঙে আগে আগে পণ্য নেওয়ার জন্য বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।
বেবি আক্তার নামে এক ভোক্তা বলেন, 'বাজারে এখন আটা ৭০ টাকা। এইখানে অর্ধেক দামে পাওয়া যায়। সেজন্য সবাই চায় আটাই নিতে। আটার সঙ্গে চালও নিতে হয় দেখে চাল নেয়। কিন্তু আটাই টার্গেট থাকে। সেই আটা যদি আগে আগে শেষ হয়ে যায় তাহলে কষ্ট করে লাইনে দাঁড়ায়া লাভ কোথায়।'
ভোক্তাদের অভিযোগ, ওএমএসের পণ্য কিনে বিক্রি করার জন্য অনেকে লাইনে দাঁড়ায়। অন্য এলাকার ভোক্তারা এসে দাঁড়ায়। একজনের সিরিয়ালে তিন জন এসে পণ্য নেয়। এসব কারণেও বঞ্চিত হচ্ছেন প্রকৃত ভোক্তারা।
এসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না কেন জিজ্ঞেস করলে ট্রাকে থাকা ডিলারের লোকেরা জানান, তাদের কাজ কেবল পণ্য বিক্রি করা। এতসব দেখতে গেলে বিক্রি করা সম্ভব হবে না। এসব দেখবে খাদ্য পরিদর্শক।
ট্রাকগুলোর আশপাশে তদারকির দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়নি কাউকে। কয়েক জায়গায় কেউ কেউ থাকলেও ক্রেতাদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা বা সিরিয়াল ঠিক করার কোনও আগ্রহ ছিল না। ঠিকমতো বিক্রি হচ্ছে কি না সেইটুকু তদারকি করাকেই দ্বায়িত্ব বলে মনে করেন অনেক পরিদর্শক।
এবিষয়ে মিরপুর ১২ ধ-ব্লক পানির পাম্প পয়েন্টের ট্রাক সেলের তদারকির দ্বায়িত্বে থাকা উপ খাদ্য পরিদর্শক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘ক্রেতাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফেরাতে গিয়ে আমিও বেশ কয়েকবার বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছি। তারা মাঝে মাঝে এতটাই ক্ষিপ্ত থাকে যে নিজেরা ঠেলাঠেলি করতে গিয়ে আমাকে পর্যন্ত মাটিতে ফেলে দিয়ে আহত করেছে। তবুও তাদের মাঝে শৃঙ্খলা আনতে পারি নাই। আর আমার দ্বায়িত্ব কেবল ঠিক মাপ মতো পণ্য বিক্রি হচ্ছে কিনা, দাম বেশি রাখছে কিনা এসব দেখভাল করা।’
মিরপুর প্যারিস রোড মাঠে ট্রাক সেল পয়েন্টের তদারকির দ্বায়িত্বে থাকা উপ খাদ্য পরিদর্শক মনিরা পারভীনকে উপস্থিত না পেয়ে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়ে তিনি ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য ঘণ্টাখানের জন্য বেরিয়েছেন। তিনি বলেন, ওএমসের পণ্য নেওয়ার জন্য আসা মানুষদের বেশিরভাগই নিম্ন আয়ের। তাদের মধ্যে শৃঙ্খলাবোধ তুলনামূলক কম। সিরিয়াল করে দাঁড় করালেও পরক্ষণেই সেই সিরিয়াল ভেঙে কেউ কেউ সামনে গিয়ে জট বাধায়। কেউ আবার পরে এসে গায়ের জোরে সামনে গিয়ে ভিড় করে। সেখানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাটা প্রায় অসম্ভব। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে সর্বোচ্চ কিছুক্ষণের জন্য পণ্য বিক্রি বন্ধ রাখা লাগে। কিন্তু সেটাও স্থায়ী সমাধান নয়।'
ওএমএস'র ট্রাক সেলে শৃঙ্খলা আনতে কোনও কোনও ক্রেতা দাবি করছেন তোদের সিরিয়াল নম্বর দেওয়ার জন্য৷ এই বিষয়ে আবদুল আজিজ নামে এক ভোক্তা বলেন, ‘ট্রাকে যে পরিমাণ চাল-আটা থাকে তাতে প্রত্যেকটি ৫ কেজি করে ৪০০ জনকে দেওয়া সম্ভব। নারী পুরুষ উভয়কে ২০০টা করে সিরিয়াল টোকেন দিয়ে ওই সিরিয়াল মতো ডেকে দিলেই এত ঝামেলা হয় না। তখন চাইলেও কেউ সিরিয়াল ভেঙে সামনে গিয়ে পণ্য নিতে পারবে না।’
তিনি বলেন, 'এতে হয়তো তাদের একটু সময় লাগবে। কিন্তু উভয় পক্ষের জন্য সহজ হবে বিষয়টা। বিকাল ৪টা পর্যন্ত বিক্রির কথা থাকলেও তারা তাড়াহুড়া করে ২টার মধ্যেই চলে যায়। এতে কে কী কীভাবে পেলো সেটা নিয়ে তাদের কিছু আসে যায় না।'