যত্রতত্র পোস্টার লাগিয়ে শহরের সৌন্দর্য নষ্ট করলে ২১ ফেব্রুয়ারির পর কড়াকড়ি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। আল্টিমেটামের সময় শেষ হলেও বন্ধ হয়নি অযাচিত পোস্টার-ব্যানার লাগানো। বরং নির্দিষ্ট স্থানে পোস্টার লাগাতে ডিএনসিসি’র পক্ষ হতে বসানো বোর্ডগুলোও সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে না।
বুধবার (১ মার্চ) উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতাধীন বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এখনও দেয়ালে দেয়ালে ছেয়ে আছে পোস্টার, মোড়ে মোড়ে ঝুলছে ব্যানার। বিশেষ করে স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল এবং জনসমাগম হয় এমন সব স্থানে পোস্টার আর ব্যানারের ছড়াছড়ি। এসব পোস্টার আর ব্যানারের অধিকাংশই রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ওয়াজ মাহফিলের প্রচারণামূলক পোস্টার আর ব্যানারও লক্ষণীয়।
তবে ডিএনসিসি’র পক্ষ থেকে কিছু কিছু স্থানে পোস্টার ব্যানার অপসারণের অভিযান চালাতে দেখা যায়। এছাড়া সব ওয়ার্ডে পোস্টার লাগানোর নির্দিষ্ট স্থান নির্ধারণের জন্য কাউন্সিলরদের চিঠি দিয়েছে সংস্থাটি।
ইতোমধ্যে পাইলটিং প্রকল্প হিসেবে ৪ ও ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ‘পোস্টার লাগানোর নির্ধারিত স্থান’ লেখা সংবলিত ১৫টি ১৬/৬ ফিট সাইজের বোর্ড বসিয়েছে ডিএনসিসি। এছাড়াও রাজধানীর আরও কয়েকটি স্থানে পোস্টার বোর্ড দেখা গেছে। চলমান প্রকল্পে আরও বোর্ড বসানো হবে বলে জানানো হয় ডিএনসিসি’র পক্ষ থেকে। তবে বোর্ড বসানো হলেও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও নগর-পরিকল্পনাবিদরা।
তবে কোন কোন স্থানে পোস্টার লাগানোর বোর্ড বসানো হয়েছে, তা এখনও জানেন না স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রধান সড়কের পাশে বসানো দৃশ্যমান তিনটি বোর্ডও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে হকার ব্যবসায়ীদের দোকানের আড়ালে, কোথাও কেবল রাজনৈতিক পোস্টার লাগানো।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, প্রচার-প্রচারণার অভাবে ও আশপাশের দেয়ালে এলোমেলোভাবে লাগানো পোস্টারের ভিড়ে বোর্ডগুলো আলাদাভাবে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এছাড়া হকারদের দখলদারত্বে ফুটপাত দিয়ে জনসাধারণ চলাচল না করায় কিছু বোর্ড কোনও কাজেই আসছে না।
এ বিষয়ে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের মিরপুর ১০-এর স্থানীয় চা বিক্রেতা সবুর খান বলেন, ‘বোর্ডে পোস্টার লাগানোর ব্যবস্থাটা ভালো হইছে। কিন্তু এত এত পোস্টার কয়টা এখানে লাগানো যাইবো! যদি নিয়ম করা হয় যে এতটির (সংখ্যা নির্ধারণ করে) বাইরে পোস্টার লাগাইলে শাস্তি, তাইলে এই বোর্ড কাজে আসবো।’
পোস্টার লাগানোর নির্ধারিত বোর্ড ব্যবস্থাকে স্বাগত জানিয়ে ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. ফরিউদ্দিন বলেন, ‘বাসা ভাড়ার নোটিশসহ কারও কোনও কিছু প্রচার করার প্রয়োজন হলে এইখানে এসে বিজ্ঞপ্তি দেবে। কিন্তু পোস্টারে লাগানোতেও সঠিক নিয়ম রাখা উচিত। এখানে কোনও পোস্টারই যেন একটার বেশি না লাগানো হয় এটা দেখতে হবে।’
পোস্টার লাগানোর বোর্ড নষ্ট ও দখল হওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়ে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আরেক বাসিন্দা মিজান চৌধুরী বলেন, ‘দেখতেই পাচ্ছেন বোর্ডের সামনে গাড়ি রাখা, হকাররা বসে জায়গাটা ভিড় করে রাখছে। নির্ধারিত স্থানে পোস্টার লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ভালো কথা, পাশাপাশি এই বোর্ডের যেন কোনও ক্ষতি না হয়, আর এর সঠিক ব্যবহার হয়; স্থানীয় বাসিন্দা এবং সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সেটাও খেয়াল রাখতে হবে।’
সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী দ্বারা প্রতিনিয়তই এই বোর্ড পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দেন নগরের এই বাসিন্দা।
ডিএনসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মাকসুদ হাসেম বলেন, ‘ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের নির্ধারণ করে দেওয়া স্থানগুলো আমরা এর উপযোগিতা যাচাই করে পোস্টার লাগানোর বোর্ড বসানোর জন্য সম্মতি দেই। এরপর তা দেখা-শোনার দায়িত্ব থাকে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলদের।'
পাইলট প্রকল্প হিসেবে এখনও পর্যবেক্ষণের কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেহেতু বোর্ডগুলো পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হচ্ছে, তাই এখনও কোন কোন স্থানে বোর্ডগুলো কার্যকর ভূমিকা রাখছে বা রাখছে না এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, আগামীতে তা প্রয়োগ করা হবে।'
তবে পোস্টার লাগানোর জন্য অর্থ ব্যয় করে নির্দিষ্ট বোর্ড বসানো কার্যকর কোনও পদক্ষেপ বলে মনে করছেন না নগরবিদরা। তারা মনে করেন, রাজধানীতে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন মার্কেট ও পোস্টার লাগানোর অনুমতি পাওয়া যায়, এমন সব দেয়ালে একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার মাধ্যমে ব্যবহার করা হলে সিটি করপোরেশনের কাজ যেমন সহজ হবে, তেমনি সরকারি অর্থের ব্যয়ও রোধ হবে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, পাইলট প্রকল্পের মাধ্যমে যত্রতত্র পোস্টার লাগানোর সমস্যা কতটুকু দূর হবে, তা যাচাই করাটা কোনও কার্যকর পদক্ষেপ নয়। এতে সরকারি অর্থের ব্যয় বাড়বে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের এই বোর্ড স্থাপনে সময় ব্যয় করতে হবে। বরং শহরের যেসব দেয়াল ব্যবহার করা সম্ভব হবে, তা একটি নীতিমালার মাধ্যমে ব্যবহার করার উদ্যোগ নিলে আশা করা যায় পোস্টার সমস্যা নিরসনে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে যত্রতত্র পোস্টার লাগানো বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যেখানে-সেখানে পোস্টার লাগানো বন্ধে শাস্তি বা জরিমানার বিধান প্রয়োগ করতে হবে। অন্যথায় অর্থ খরচ করে বোর্ড বসিয়েও কোন লাভ হবে। তাই বোর্ড হোক কিংবা দেয়াল, নির্দিষ্ট স্থানের বাইরে পোস্টার লাগালে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।’