X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

পয়োবর্জ্য এখন সম্পদ, তৈরি হচ্ছে নিরাপদ জৈব সার

আতিক হাসান শুভ
২১ মার্চ ২০২৩, ০৯:০০আপডেট : ২১ মার্চ ২০২৩, ১৬:৪০

‘পয়োবর্জ্য মানে আবর্জনা’– এ ধারণাই পাল্টে দিয়েছে নীলফামারীর সৈয়দপুর পৌরসভা। পয়োবর্জ্য এখন পরিণত হয়েছে সম্পদে। এ থেকে তৈরি হচ্ছে নিরাপদ জৈব সার। ওয়াটারএইড বাংলাদেশ ও সমাজ কল্যাণ সংস্থা (এসকেএস) ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সেখান থেকে দুর্গন্ধমুক্ত নিরাপদ জৈব সার উৎপাদন করে সারা দেশে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে সৈয়দপুর পৌরসভা।  

সরেজমিন দেখা যায়, সৈয়দপুর পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডের প্রতিটি পাড়া-মহল্লা থেকে গৃহস্থালি ও মানববর্জ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। পয়োবর্জ্য খালি করতে পৌরসভায় লিখিত আবেদন করলেই বাসার সামনে চলে যায় বিশাল ট্যাংকসহ গাড়ি। ৩৩ হাজার পরিবার এবং ছয়টি হাটবাজারের মানববর্জ্য গাড়িতে সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেগুলো নেওয়া হয় শহরের সুরকী মহল্লার শোধনাগারে। ১৭০ শতক জমির ওপর গড়ে ওঠা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টে পাঁচটি ধাপে পয়োবর্জ্যকে জৈব সারে রূপান্তরিত করা হয়। পয়োবর্জ্য এখন সম্পদ, তৈরি হচ্ছে নিরাপদ জৈব সার

সৈয়দপুর পৌরসভার বাসিন্দা মশিউর রহমান জানান, আগে মেথর দিয়ে পয়োবর্জ্য পরিষ্কার করাতেন। আগে বর্জ্য এখানে-সেখানে ফেলা হতো। দুর্গন্ধ বের হতো। কোথায় বর্জ্য ফেলবে, সেটা নিয়েও দুশ্চিন্তা ছিল। কিন্তু এখন আর সেই সমস্যা নেই। পৌরসভা থেকে পয়োবর্জ্য সংগ্রহ করা ট্রাক চালুর পর বছরে একবার নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে সেই ট্রাকের মাধ্যমে সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কার করিয়ে নিচ্ছেন।

তিনি বলেন, ‘গন্ধ ও ঝামেলা ছাড়াই ট্রাকে বর্জ্য অপসারণ করা যাচ্ছে। আবার সেই পয়োবর্জ্য থেকে সার উৎপাদন করা হচ্ছে। এমন উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়।’ পয়োবর্জ্য এখন সম্পদ, তৈরি হচ্ছে নিরাপদ জৈব সার

পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এ প্ল্যান্টের কার্যক্রমের ফলে পৌরসভার পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এখন খালগুলোতে পয়োবর্জ্য ফেলার প্রবণতা কমেছে। আগের মতো যেখানে-সেখানে ময়লা পড়ে থাকে না। ১ হাজার লিটার পয়োবর্জ্য পরিষ্কার করতে ১ হাজার টাকা এবং সাড়ে ৩ হাজার লিটার পরিষ্কার করতে আড়াই হাজার টাকা দিতে হয় সেবা গ্রহীতাকে। এজন্য পৌরসভায় আবেদন করতে হয়। আবেদনের কয়েকদিনের মাথায় বাড়িতেই পৌঁছে যায় পৌরসভার নিজস্ব পরিবহন ভেকু ট্রাক।’

পয়োবর্জ্য থেকে উৎপাদিত নিরাপদ এই সার এখন কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে। বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে জাতীয় পদক পাওয়া সৈয়দপুরের কৃষি উদ্যোক্তা আহসানুল হক তার ড্রাগন ফলের বাগানসহ অন্যান্য খামারে ব্যবহার করছেন এ সার। ফলনও পাচ্ছেন ভালো। তিনি এ পর্যন্ত আড়াই টন সার কিনেছেন। পয়োবর্জ্য এখন সম্পদ, তৈরি হচ্ছে নিরাপদ জৈব সার

ওয়াটারএইডের প্রোগ্রাম অফিসার প্রকৌশলী মো. শাখাওয়াত হোসাইন জানান, সৈয়দপুর পৌরবাসীর পয়োবর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শহরে একটি সমন্বিত উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তারা কাজ করছেন। সেই সঙ্গে সৈয়দপুর পৌরসভাকে তারা কারিগরি সহায়তা দিচ্ছেন, যাতে পৌরসভা অন্তর্ভুক্তিমূলক স্যানিটেশন ব্যবস্থাপনায় এগিয়ে যায়। সরকার এই মডেল সব পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে ব্যবহার করতে পারে।

এ সার ব্যবহারে মাঠপর্যায়ে সচেতনতামূলক কাজ করছে এসকেএস ফাউন্ডেশন। সংস্থার প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর নজরুল ইসলাম তপাদার বলেন, ‘এই সার সৈয়দপুরের ১৩২টি পারিবারিক পুষ্টিবাগানে এবং ৭৪ জন কৃষকের জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। বছরে এ প্ল্যান্ট থেকে ৩৭৯ টন সার উৎপাদন সম্ভব। এখন পর্যন্ত ৩৫ টন সার উৎপাদিত হয়েছে। এর মধ্যে প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে ২৯ টন।’ পয়োবর্জ্য এখন সম্পদ, তৈরি হচ্ছে নিরাপদ জৈব সার

সৈয়দপুর পৌরসভার মেয়র রাফিকা আক্তার জাহান বেবী বলেন, ‘২০১৬ সালে মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য এসকেএস ফাউন্ডেশন আমাদের এখানে কাজ করতে আসে। এরপর ওয়াটার এইড বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এখানে তারা প্লান্ট বানায়। সেই থেকে পয়োবর্জ্য দিয়ে এখানে সার উৎপাদন করা হচ্ছে।’

একইভাবে টাঙ্গাইলের সখীপুর পৌরসভায় কো-কম্পোস্ট প্লান্ট তৈরি করে মানববর্জ্য থেকে তৈরি করা হচ্ছে জৈব সার। ওয়াটারএইড বাংলাদেশের সহায়তায় ওই প্লান্ট থেকে বছরে উৎপাদন হচ্ছে ২৪ টন সার। এই সারের নাম দেওয়া হয়েছে ‘সখী কম্পোস্ট’। পৌরসভার ৫৮ শতাংশ মানববর্জ্য নিরাপদভাবে ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে।

সৈয়দপুরের বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানবীর মাহবুব বলেন, ‘আমাদের দেশ কৃষিনির্ভর। এখানে কৃষি কাজের অন্যতম হাতিয়ার জৈব সার। সরকার প্রতি বছর সারের জন্য হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে থাকেন। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে সারের জন্য ভর্তুকির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা। পয়োবর্জ্য থেকে যেহেতু নিরাপদ জৈব সার উৎপাদন করা যায়, তাই দেশব্যাপী এ উদ্যোগ নেওয়া দরকার। তাহলে সারে সরকারের কিছুটা কম ভর্তুকি দিতে হবে।’ পয়োবর্জ্য এখন সম্পদ, তৈরি হচ্ছে নিরাপদ জৈব সার

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) গবেষণায় জানানো হয়েছে, পয়োবর্জ্য থেকে উৎপাদিত এই জৈব সারে কোনও ধরনের ক্ষতিকারক জীবাণু নেই। এটি ব্যবহারে কৃষিজমিতে পুষ্টিগুণ বাড়ে। উৎপাদনও বেশ লাভজনক। পয়োবর্জ্য জমিতে ব্যবহার করলে মাটি বিষাক্ত হয় না, বরং মাটির গুণাগুণ বেড়ে যায়।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) মহাপরিচালক ড. মির্জা মোফাজ্জল ইসলাম বলেন, ‘বর্জ্য নিয়ে সভ্য দুনিয়ায় এখন দুটি কথা খুব চালু আছে। প্রথমটি—আজকের বর্জ্য আগামীকালের সম্পদ’। দ্বিতীয়টি—আবর্জনাই নগদ অর্থ। সৈয়দপুরে তৈরি সার সম্পূর্ণ প্যাথোজেনমুক্ত বলে তা পরিবেশের কোনও ক্ষতি করে না।’

/আরকে/ইউএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
আমন মৌসুমে ইউরিয়া সরবরাহ ব্যাহতের শঙ্কা!
মিয়ানমারে পাচারের সময় ৬০০ বস্তা সারসহ দশ জন আটক
গ্যাস-সংকটে উৎপাদন বন্ধ সিইউএফএলে
সর্বশেষ খবর
সীমান্তে গোলাবর্ষণের আতঙ্কে ফিরতে চান না বাস্তুচ্যুত গ্রামবাসী
ভারত-পাকিস্তান সংঘাতসীমান্তে গোলাবর্ষণের আতঙ্কে ফিরতে চান না বাস্তুচ্যুত গ্রামবাসী
আমিরাতে সিঙ্গাপুরের গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে তাহসিনের ড্র
আমিরাতে সিঙ্গাপুরের গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে তাহসিনের ড্র
ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতাকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ
ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতাকে মারধর করে পুলিশে সোপর্দ
কিশোরগঞ্জে বজ্রাঘাতে তিন কৃষকের মৃত্যু
কিশোরগঞ্জে বজ্রাঘাতে তিন কৃষকের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
আওয়ামী লীগ কচু পাতার পানি না: কাদের সিদ্দিকী
আওয়ামী লীগ কচু পাতার পানি না: কাদের সিদ্দিকী
ব্যাংকে টাকা আসছে নাকি বের হয়ে যাচ্ছে
ব্যাংকে টাকা আসছে নাকি বের হয়ে যাচ্ছে
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
মহাসড়কের পাশে দুই যুবকের লাশ, একজনের গলাকাটা অপরজনের চোখ উপড়ানো
মহাসড়কের পাশে দুই যুবকের লাশ, একজনের গলাকাটা অপরজনের চোখ উপড়ানো