রাজধানীর মালিবাগ রেলক্রসিংয়ে বুধবার রাত ৯টার দিকে সোহাগ পরিবহনের একটি বাস রেললাইনে উঠে পড়ে। এ সময় কমলাপুর থেকে ছেড়ে আসা পঞ্চগড় এক্সপ্রেস ট্রেনটি বাসটিকে ঠেলে প্রায় ২০০ গজ দূরে নিয়ে যায়। বাসটিতে চালক ও তার সহকারী ছাড়া আর কোনও যাত্রী ছিলেন না। ট্রেনের ধাক্কায় বাসের সামনে ও পেছনের অংশ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলেও কেউ হতাহত হননি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে মূলত ওই রেলক্রসিংয়ের গেটকিপার বার (প্রতিবন্ধক দণ্ড) না ফেলায়। এ তথ্যের সঙ্গে একমত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ট্রেনটি যখন আসছিল, তখনও বাসের পেছনের অংশ রেললাইনের উপরেই ছিল। ট্রেনের চালক বাসটি দেখতে পেয়ে গতি কমিয়ে ফেলেছিলেন। এরফলে বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি।
বুধবার (২২ মার্চ) রাতে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, বাসটি ট্রেনের থাকায় রেলগেট থেকে মগবাজারের দিকে বেশ কিছু দূরে টেনে নিয়ে গেছে। এতে রেল লাইনেরও ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ের বারে বাসের ধাক্কা লাগা কোনও ক্ষয়ক্ষতির আলামত পাওয়া যায়নি।
রাত ১০টারও পরে মালিবাগ রেলগেটের পূর্ব পাশের উত্তরের গেট কিপিংয়ের দায়িত্ব পালন করছিলেন সালাম হোসেন নামে একজন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এখানে আমরা প্রতি সিফটে চার জন করে তিন সিফটে মোট ১২ জন ডিউটি করি। আজকে আমার রাত ১০টা থেকে ডিউটি ছিল। আমি এসে দেখি এই ঘটনা, আগে কী হয়েছে বলতে পারি না।’
একই গেটের দক্ষিণের গেটকিপার জুয়েল রানা বলেন, ‘পশ্চিম পাশের দক্ষিণ গেটে দুর্ঘটনা ঘটে। ওখানে ফারুক নামে একজন দায়িত্বে ছিলেন। তবে দুর্ঘটনার সময় ফারুক গেটে ছিল কিনা বলতে পারি না। আমি খিলগাঁও পুলিশ ফাঁড়ির সামনে থেকে হেঁটে এসেছি, রাস্তায় যানজট দেখে। এখানে এসে দেখি এই অবস্থা। তবে এসে ফারুকের দেখা পাইনি, সে আগেই চলে গেছে বলে জানতে পেরেছি।’
জুয়েল রানা বলেন, ‘দুর্ঘটনায় বিষয়টি স্যারেরা তদন্ত করে দেখবেন। বাসের চালকের দোষ নাকি গেটকিপারের দোষ। মালিবাগ চৌরাস্তায় পুলিশ বক্সের সামনে ফ্লাইওভারের একটি সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেখান থেকে ফুটেজ দেখলেই স্পষ্ট হওয়া যাবে, যে কার দোষ। রেলক্রসিংয়ের বার ফেলে দিলে ট্রাফিক সিগনালের আলো জ্বলে ওঠে। এবং সেটা ক্যামেরায় স্পষ্ট দেখা যায়।’
মালিবাগ রেলক্রসিংয়ের পশ্চিম পাশে গেটের পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা মো. সবুজ মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ট্রেন আসার সময় গেটম্যান রেললাইনে বার ফেলেননি। তাকে এখানে দেখাও যায়নি। সোহাগের বাসটি সোজা রাস্তা পার হতে গিয়ে আটকে যায়। বাসটির পেছনের অংশ রেললাইনের উপরেই ছিল। ট্রেনটি এসে ধাক্কা দেওয়ার কিছুক্ষণ পরে ট্রেনটিও থেমে যায়।’
সবুজ মিয়া বলেন, ‘বাসটি মালিবাগ কাঁচাবাজার ডিপোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। সামনে ট্রাফিক সিগন্যালে জ্যাম থাকায় বাসটি রেললাইন পার হতে পারেনি। সিগন্যাল না থাকলে আবার বাসটি পার হয়ে যেতো।’
শাহবুদ্দিন নামে আরেকজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘ট্রেন কাছে আসার পরও গেটম্যান বার না ফেলায় বাসটি রেললাইন পার হতে যায়। কিন্তু মোচড়েই ট্রাফিক সিগন্যালে যানজট থাকায় বাসটি আর পার হতে পারেনি। এছাড়া গাড়িটি অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার পরেই গেটম্যানরা সব চলে গেছে। এখন যারা আসছে এরা নতুন।’
মালিবাগ চৌরাস্তা মোচড়ে যানজট দেখলে আগেই বার ফেলিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান গেটকিপার ইব্রাহিম। তিনি বলেন, ‘গাড়ির চাপ থাকলে অনেক সময় হিমশিম খেতে হয় গেটম্যানদের। এমনকি ট্রাফিক সিগন্যাল থাকায় অনেক সময় রেললাইন থেকে গাড়ি রং সাইডেও পার করতে হয়।’
সোহাগ পরিবহনের মৌচাক কাউন্টারের ইনচার্জ রবিউল হাসান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুপুর ১টার দিকে বেনাপোল থেকে ছাড়া সোহাগ পরিবহনের স্ক্যানার (গাড়ি নম্বর- ১৪-৬৬৬৩) বাসটি সন্ধ্যা ৭টার দিকে মৌচাক কাউন্টারে পৌঁছায়। এখানে সব যাত্রীকে নামিয়ে বাসের চালক শাহীন আলম ও তার সহকারী সুজন মিয়া মালিবাগে ডিপোতে যাচ্ছিলেন। রেলক্রসিংয়ের গেটম্যানের ভুলে আমাদের এমন বড় একটা ক্ষতি হয়ে গেল। গেটকিপার বার ফেললে আমাদের বাস কোনোভাবেই রেলগেট পার হওয়ার চেষ্টা করতো না।’
মালিবাগ চৌরাস্তায় ট্রাফিকের দায়িত্বরত মতিঝিল বিভাগের সবুজবাগ জোনের সার্জেন্ট বদরুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মালিবাগ রেলগেট থেকে মোচরের দূরত্ব ৫০ গজের মতো। এখানে দায়িত্ব পালন করা ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের সবসময় ট্রেনের দিকে নজর রাখতে হয়।’
সার্জেন্ট বদরুল আলম আরও বলেন, ‘গেটম্যানেরদের সঙ্গে ট্রাফিক পুলিশের কোনও সমন্বয় নেই। কিন্তু যখনই ট্রেন আসে তখনই বেল বেজে ওঠে এবং গেটকিপাররা বার ফেলে দেন। কিন্তু আজকে দুর্ঘটনার সময় রেলগেটের বেলও বাজেনি, বারও পড়েনি। এতে করে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরাও বুঝতে পারেনি। এর ফলে এই পাশের গাড়িও সরাতে পারেনি।’
ট্রাফিক পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বার না ফেলায় সোহাগ পরিবহনের বাসটি পার হয়ে চলে আসছিল মালিবাগ কাঁচাবাজারের দিকে। এ সময় আস্তে আস্তে ট্রেনটা আসছিল বলে বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। বার না ফেলাতেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।’
রেলের সহকারী পরিবহন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আমিনুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এই ঘটনায় তার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখানে গেটকিপারের দায়িত্বে কোনও অবহেলা আছে কিনা, তা আমরা খতিয়ে দেখছি। এছাড়া বাসের সহকারী বার উঁচু করে বাসটি পার করার চেষ্টা করেছে কিনা সেটাও দেখা হচ্ছে।’
আরও পড়ুন:
২ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক
সড়কে তীব্র যানজট, ট্রেন চলাচল বন্ধ
রেললাইনে উঠে পড়া বাসটিকে ২০০ গজ টেনে নিয়ে গেলো ট্রেন