‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০১৩ (সংশোধিত) অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনাল ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করবেন। নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন, সেই সময়ে শেষ হয় না বেশিরভাগ মামলা। বছরের পর বছর কালক্ষেপণ শেষে ভিকটিম জানতে পারে ‘এমন কোনও ঘটনাই ঘটেনি’। যদিও উচ্চ আদালতের নির্দেশনা রয়েছে, ট্রাইব্যুনাল যদি ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার কারণ সংবলিত একটি প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করবেন। তবে এমন নজির খুব একটা নেই।
উচ্চ আদালতের তথ্য বলছে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বিচারাধীন মামলা এখন দেড় লাখ ছাড়িয়েছে। দেশের ৬৪ জেলায় ৯৯টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত মোট বিচারাধীন মামলা ১ লাখ ৬১ হাজার ২১৮টি। এরমধ্যে ২০ শতাংশের বেশি মামলা ৫ বছরের বেশি সময় ধরে বিচারাধীন।
২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিমকোর্ট পরিপত্র জারি করে। সেখানে বলা হয়, নির্ধারিত ১৮০ দিনে বিচার শেষ করতে না পারলে তার কারণ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে প্রতিবেদন দাখিলের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু এই বিধান যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে না। তাই আইনটি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর ও তদন্ত কর্মকর্তাদের (পুলিশ) প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়।
কেন মামলা ১৮০ দিনের মধ্যে শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না প্রশ্নে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘এখানে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। একেকজন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে এতো সংখ্যক মামলা থাকে যে, কোনও একটির পেছনে লেগে থেকে শেষ করার সুযোগ নেই। এছাড়া মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত কাগজপত্র পেতেও অনেক দেরি হয়। মেডিক্যাল সনদ পেতে সময় লাগে। সেটাকে ত্বরান্বিত করার ক্ষমতা আমার নেই, যদি আদালত কোনও মামলায় ডিএনএ প্রতিবেদন (ধর্ষণের মামলায় আবশ্যক) চায়, তবে সেটা কবে পাবো— সেটা আমি নিজেও জানি না। এরপর শুরু হয় একের পর এক তারিখ নেওয়া, বিবাদী পক্ষ তারিখ নেয়। একেকটা ট্রাইব্যুনালে কত মামলা— সেই হিসাব যদি করেন, তাহলে ১৮০ দিনের হিসাব চাইবেন না। এটা আসলে সম্ভব না।‘
নারী অধিকার আদায়ে কাজ করে ‘আমরাই পারি জোট’। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরেই নারী নির্যাতন মামলা দ্রুত নিস্পত্তিসহ বেশকিছু দাবি জানিয়ে আসছে। তারমধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা ১৮০ দিনের মধ্যেই নিষ্পত্তি করার দাবিও অন্যতম। তারা বলছে, উচ্চ আদালতে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে; বিচার চলাকালে নির্যাতনের শিকার নারী, শিশু ও পরিবারের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় সাক্ষী প্রদান প্রক্রিয়া যুগোপযোগী করতে হবে। তবেই ঠিক সময়ের মধ্যে মামলা নিস্পত্তি সম্ভব।
নারীনেত্রীরা বলছেন, নারীর প্রতি এই নৃশংসতা নারী সমাজের উন্নয়নের জন্য হুমকি, পাশাপাশি রাষ্ট্রের জন্যও হুমকি; যা বাংলাদেশের অগ্রসরমান ভাবমূর্তিকে ম্লান ও প্রশ্নবিদ্ধ করছে। আমরাই পারি জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, ‘বর্তমান সরকার নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও পরিস্থিতি বিশ্লেষণে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার দৃশ্যমান কোনও পরিবর্তন দেখা যায়নি। ক্রমবর্ধমান হারে নারী নিপীড়ন, ধর্ষণ ও নারী বিরোধী কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা উদ্বিগ্ন। ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করা গেলে ভুক্তভোগীরা ন্যয়বিচারে আস্থা পেতো।’
ভুক্তভোগীদের আস্থা প্রসঙ্গে নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আরেক সংগঠন নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা ও আহ্বায়ক শিরিন হক বলেন, ‘বিচারহীনতার প্রশ্নে ভিকটিমরা এমনকি অভিযোগ করতেও উদ্যোগী হয় না অনেক সময়। ‘কী লাভ’, ‘দেখার কেউ নাই’, ‘কতদিন আদালতে ঘুরবো’— এই কথাগুলো আমরা ভিকটিম পরিবারের কাছে প্রায়ই শুনতে পাই।’
তিনি বলেন, ‘বেশিরভাগ সময় মেডিক্যাল সনদ, ডিএনএ রিপোর্ট এসবে সময় লাগে। সবমিলিয়ে তদন্ত প্রতিবেদনের কাজ শেষ হলেও তারপর আদালতে যে সময়টা লাগে, সেটাও অনেক বেশি।’