X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

বিদেশি পর্যটকদের জন্য বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট ভিসা যেন সোনার হরিণ

চৌধুরী আকবর হোসেন
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯:২০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৯:৪৭

অর্থনৈতিক ধারা বদলাতে সারা বিশ্ব পর্যটনকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এ কারণে বিভিন্ন দেশ ভিসা পদ্ধতিও সহজ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে উল্টো, ট্যুরিস্ট ভিসা পাওয়া এখানে অনেকটা ‘সোনার হরিণ’ পাওয়ার মতো। কখনও কখনও সোনার হরিণের চেয়েও দুষ্প্রাপ্য। অনেক দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস, হাইকমিশনে ট্যুরিস্ট ভিসার জন্য ছুটেও লাভ নেই, প্রত্যাখ্যাত হতে হয় বিদেশি পর্যটকদের। বাংলাদেশের পর্যটন নিয়ে সরকারি উদ্যোগে বড় কোনও ব্রান্ডিং বা প্রচারণা নেই। বেসরকারি উদ্যোগে বিদেশি পর্যটকদের আনার চেষ্টাও হোঁচট খাচ্ছে ভিসা না দেওয়ার কারণে। বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ বাড়াতে সহজে ই-ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়া চালুর দাবি পর্যটন খাত সংশ্লিষ্টদের।

পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, বেসরকারি উদ্যোগে দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন দেশের পর্যটকদের বাংলাদেশ আসার জন্য উৎসাহী করছেন তারা। তবে শুরুতেই হোঁচট খেতে হয় বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস, হাইকমিশনে বিদেশিদের ট্যুরিস্ট ভিসা না দেওয়ার কারণে। কোনও কোনও ট্যুর অপারেটর ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে দূতাবাসে অনুরোধ করলেও ভিসা পেতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। কখনও কখনও একই গ্রুপের ১০ জনকে ভিসা দিলে ২ জনকে দেয় না, ফলে পুরো গ্রুপই বাংলাদেশে ট্যুর প্ল্যান বাতিল করে। অনেক সময় ট্যুর অপারেটররা বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডের সহায়তা চাইলেও সুফল মিলে না। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ডও অসহায়।

রোষানলে পড়ার আতঙ্কে অনেক ট্যুর অপারেটর ভিসা জটিলতা নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে চান না। পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভিসা না দেওয়ার কারণে বিদেশি পর্যটকরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। কোনও কোনও দেশে ভিসা পেতে ধরতে হয় দালাল, ব্যয় করতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। এসব কারণে বাংলাদেশে পর্যটনে বিদেশি পর্যটকদের আগ্রহ কম। বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশে না আসার ক্ষেত্রে ভিসা না দেওয়াকে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন এ খাতের সংশ্লিষ্টরা।

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটন নিয়ে আসছে ট্যুরস অ্যান্ড ট্রিপস নামে ট্যুর অপারেটর। অনেক সময় পর্যটকরা বাংলাদেশে আসার আগ্রহ প্রকাশ করলেও ভিসা না পাওয়ার কারণে তাদের ট্যুর বাতিল হয় বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী জুনায়েদ ইসলাম। তিনি বলেন, আগস্ট মাসে পোল্যান্ডে বাংলাদেশ কনস্যুলেটে ১৭ জন পোলিশ নাগরিক বাংলাদেশের ভিসার আবেদন নিয়ে গিয়েছিলেন। কনস্যুলেট থেকে তাদের বলা হয়েছে ভিসার আবেদন জমা নিবে না, বাংলাদেশে গিয়ে অন অ্যারাইভাল ভিসা নিতে। হোটেল বুকিং করে বিমান ভাড়া দিয়ে বাংলাদেশে আসার পর যদি তারা বিমানবন্দরে অন অ্যারাইভাল ভিসা না পান তখন পরিস্থিতি কী হবে? এসব কারণে অতিথিরা বাংলাদেশ আসার আগ্রহ আগের মতো দেখাচ্ছেন না।

জুনায়েদ ইসলাম বলেন, ভিসা জটিলতা দীর্ঘদিনের। এখন আমেরিকা, ইউরোপের ট্যুরিস্ট ভিসা পাওয়া যতটা সহজ, বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট ভিসা তার চেয়ে কঠিন। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত ফোর্বস ম্যাগাজিনের একজন সম্পাদক ও  ফটোগ্রাফার বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বাণিজ্যিক উন্নয়ন বিষয়ে তারা ডকুমেন্টারি করবেন। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের জন্য সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়। দূতাবাসেও আমাদের প্রতিষ্ঠানের সব তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয়। ফোর্বস ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক আর ফটোগ্রাফার ছিলেন কেনিয়ার নাগরিক। এত তথ্য-উপাত্ত দেওয়ার পরও দূতাবাস আমেরিকান নাগরিক দেখে সম্পাদককে ভিসা দিয়েছে, কেনিয়ার নাগরিক হওয়ায় ফটোগ্রাফারকে ভিসা দেয়নি। পরবর্তীতে তারা বাংলাদেশে ট্যুর বাতিল করে নেপালে চলে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাংলাদেশি অভিযোগ করে জানালেন, তার স্ত্রী ব্রিটিশ নাগরিক। তিনি স্ত্রীকে নিয়ে বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে চান। কয়েক দফা দূতাবাসে ঘোরাঘুরির পর ভিসার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছেন তার স্ত্রী। বাংলাদেশি নাগরিকের স্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে দূতাবাসের অনাগ্রহে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

বিদেশিদের জন্য ট্যুরস্টি ভিসা না পাওয়াকে বাংলাদেশের পর্যটনের অন্যতম বাধা হিসেবে দেখছেন প্যাসেফিক এশিয়া ট্রাভেল অ্যাসোসিয়েশনের (পাটা) বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের মহাসচিব তৌফিক রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পর্যটনের যতটা প্রচার-প্রসার ঘটেছে তার বড় অংশ হয়েছে বেসরকারি খাতের হাত ধরে। বিভিন্ন দেশে প্রচার-প্রচারণা চালানোর পর যখন একটা ট্যুর গ্রুপ পাওয়া যায় তখন ট্যুর অপারেটরের প্রচেষ্টা সফল হয়। কিন্তু যখন ভিসা দেওয়া হয় না, তখন সেই ট্যুর অপারেটর আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন, বাংলাদেশ ফরেন কারেন্সি থেকে বঞ্চিত হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিও আগ্রহ হারান পর্যটকরা।

তৌফিক রহমান বলেন, কল্পনা করা যায় না দূতাবাসগুলো কতটা নন-প্রফেশনাল আচরণ করে। দিনের পর দিনে দূতাবাসে ঘুরেও ভিসা পাওয়া যায় না। যেসব দেশের নাগরিকরা বাংলাদেশে অন-অ্যারাইভাল ভিসা পাবেন, তারা দূতাবাসে যোগাযোগ করলে বলা হয় অন-অ্যারাইভাল ভিসা তিনি পাবেন না। ঢাকায় বিমানবন্দরেও সহজে অন-অ্যারাইভাল ভিসা দেওয়া হয় না। একবার আমার ১৩ জনের একটা গ্রুপকে বিমানবন্দরে ভিসা নিতে সাড়ে ৩ ঘণ্টা বসে থাকতে হয়েছে। ফলে যতক্ষণ ভিসা সমস্যা সমাধান না হবে, বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক কীভাবে আসবে?

গেলো মে মাসে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কার ট্যুর অপারেটররা। তারাও অভিযোগ করেন, বাংলাদেশে ট্যুরিস্ট পাঠাতে গেলে ভিসা জটিলতায় পড়তে হয়। অনেক সময় এসব জটিলতার কারণে অনেকেই আর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে আসতে আগ্রহ দেখান না। সে সময় ভারত থেকে ৫২ জন ট্যুর অপারেটর বাংলাদেশ আসেন। পশ্চিমবঙ্গের একাধিক ট্যুর অপারেটর জানান, বাংলাদেশ হাইকমিশনে যদি সরাসরি ভিসার আবেদন জমা দেই, মাস পেরোলেও ভিসা হয় না। কিন্তু হাইকমিশনের আশপাশের কম্পিউটার দোকানগুলোতে কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে আবেদন করলে ২-৩ দিনে ভিসা হয়ে যায়, তখন এত কাগজপত্রও দেখাতে হয় না। যারা আমাদের মতো ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে আসেন, তাদের ক্ষেত্রে টাকা বেশি লাগলেও আমরা ভিসা করে দিতে পারি নানা কৌশলে। কিন্তু যারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে ভিসা আবেদন জমা দেন, হাইকমিশনে ঘুরতে ঘুরতে অনেকে বাংলাদেশে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।

ভিসা জটিলতার বিষয়গুলো অজানা নয় বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের। আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে আলোচনা আর আশ্বাসেই সান্ত্বনা পেতে হয় ট্যুরিজম বোর্ডকে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,  ই-ভিসার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। আমরা ই-ভিসা দ্রুত চালুর বিষয়ে প্রস্তাব করছি। অন্ততপক্ষে যেসব দেশের ক্ষেত্রে অন-অ্যারাইভাল ভিসা সুবিধা এখন দেওয়া আছে, সেসব দেশের ক্ষেত্রে দ্রুত ই-ভিসা চালু করার বিষয়ে বোর্ড থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া, ইউকে, সেনজেন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক কিংবা সেসব দেশের ভিসাধারীদেরও ই-ভিসা দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনার প্রস্তাব করেছি।

এ বিষয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ মাহবুব আলী বলেন, বিদেশি পর্যটকদের বাংলাদেশে আনার জন্য যা যা করার দরকার সব উদ্যোগই সরকার নিচ্ছে। ই-ভিসা প্রদানের বিষয়েও কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। ই-ভিসা চালু হলে পর্যটকদের ভিসা প্রাপ্তি সহজ হবে, অনেক বেশি মানুষ বাংলাদেশে আসবেন।    

/এমএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
প্রকৌশলীদের অবদানেই বিমানবন্দরগুলো আধুনিকতার নতুন স্তরে পৌঁছেছে: বেবিচক চেয়ারম্যান
বাংলাদেশিদের জন্য আমিরাতে ভিসা চালুর বিষয়ে অগ্রগতি
নানা কারণে স্থবির খাগড়াছড়ির পর্যটন, ক্ষতির মুখে হোটেল ও পরিবহন
সর্বশেষ খবর
মাদ্রাসাসহ সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি
মাদ্রাসাসহ সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি
ভারত-পাকিস্তান ড্রোন যুদ্ধ: দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতের নতুন অধ্যায়
ভারত-পাকিস্তান ড্রোন যুদ্ধ: দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতের নতুন অধ্যায়
মৌলভীবাজার সীমান্তে দুই দিনে আটক ৫৯ জনকে পুলিশে হস্তান্তর
মৌলভীবাজার সীমান্তে দুই দিনে আটক ৫৯ জনকে পুলিশে হস্তান্তর
লেভারকুসেনকে বিদায় বললেন জাবি, যাচ্ছেন রিয়ালে!
লেভারকুসেনকে বিদায় বললেন জাবি, যাচ্ছেন রিয়ালে!
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: কিশোরগঞ্জের এসপি প্রত্যাহার
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: কিশোরগঞ্জের এসপি প্রত্যাহার