যতই দিন যাচ্ছে, বহুতল ভবনের সংখ্যা ততই বাড়ছে রাজধানী ঢাকায়। কয়েক বছর আগেও ২০ তলার ওপরে ভবন ছিল হাতে গোণা। তবে বর্তমানে রাজধানীর বেশ কয়েকটি ভবন ৩০ তলা ছাড়িয়ে গেছে। তবে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের যতটুকু সক্ষমতা আছে তা দিয়ে ২৪ তলার ওপরে আগুন নেভানো সম্ভব না। যদি কোনও ভবনের ২৪ তলার ওপরে আগুন লাগে বা বিস্ফোরণের মতো ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে কীভাবে আগুন নেভানো হবে তৈরি হয়েছে সেই প্রশ্ন।
রাজধানীতে সুউচ্চ ভবনগুলোর মধ্যে রয়েছে—সিটি সেন্টার ৩৭ তলা, সিটি ব্যাংক টাওয়ার ৩৪ তলা, বাংলাদেশ ব্যাংক ৩১ তলা, গুলশান টাওয়ার ৩০ তলা, ইস্টার্ন ফেডারেল ক্রেডিট ইউনিয়ন বীমা ভবন ২৭ তলা।
সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বেশ কয়েকটি বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ভবনের আগুন নির্বাপণের জন্য লেগেছে দীর্ঘ সময়। ফায়ার সার্ভিস বলছে, বাংলাদেশে অগ্নি নির্বাপণের জন্য যে লেডার ব্যবহার করা হয় তা দিয়ে ২৪ তলা পর্যন্ত পানি পৌঁছে দেওয়া সম্ভব। ২৪ তলার ওপরে পানি ছিটানোর মতো কোনও ব্যবস্থা সংস্থাটির কাছে নেই। এর ওপরে আগুন চলে গেলে ভবন মালিকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় তা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেখানে সংস্থাটি সহযোগী হিসেবে কাজ করবে।
এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের কর্মকর্তা (মিডিয়া) শাজাহান শিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ন্যাশনাল ভবন কোডে বলা হয়েছে, নিজস্ব ফায়ার সিকিউরিটি ফোর্স থাকতে হবে। অগ্নি নির্বাপণের ব্যবস্থা রাখতে হবে। অর্থাৎ ভবন মালিক নিজেই অগ্নি নির্বাপণের সব ব্যবস্থা করে রাখবেন।
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে পানির পাম্পে যে লেডারটি ব্যবহার করা হয় সেটি কত তলা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে তারও একটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। লেডারটি নির্দিষ্ট তলা পর্যন্ত যেতে পারে। তারপর আর যাওয়ার সুযোগ নেই। লেডারগুলো সাধারণত হালকা হয়। এগুলো যত ওপরে উঠবে তত ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। নির্দিষ্ট উচ্চতায় ওঠার পর চাইলেও বাইরে থেকে লেডার দিয়ে আগুন নেভানো আরও সম্ভব হয় না। তবে বর্তমানে লেডার দিয়ে ৬৮ মিটার ওপর পর্যন্ত যাওয়ার সক্ষমতা রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের। যেটি দ্বারা ২৪ তলা পর্যন্ত না পৌঁছাতে পারলেও ২৪ তলায় পানি ছোঁড়া সম্ভব হয়।
তিনি আরও বলেন, আগুন থেকে বাঁচতে বহুতল ভবনের জন্য পৃথিবীর সব জায়গায় একই পদ্ধতি। নির্দিষ্ট উচ্চতার পর ভবন মালিকের ফায়ার সিকিউরিটির দায়িত্ব নিতে হয়। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ৫০ তলা বা ১০০ তলা উঠতে পারবে। সেটি নির্ভর করবে ওই ভবনের ফায়ার সিকিউরিটি ওপর। ভবনটিতে কী রকম অগ্নি প্রতিরোধের ব্যবস্থা রেখেছে সেটির ওপর।
এই কর্মকর্তা বলেন, বাইরের দেশে বহুতল ভবনে জরুরি বহির্গমন পথ থাকে। সেখানে আলাদা লিফটও থাকে। অগ্নিকাণ্ডের সময় পুরো ভবনে বিদ্যুৎ না থাকলেও ওই লিফটা চালু থাকে। জরুরি এই লিফট তখন চলবে বিশেষ ব্যবস্থায়। জরুরি বহির্গমন পথ এই রকম থাকবে যে শুধু নামতে পারবে। কেউ চাইলেও ওপরে উঠতে পারবে না। ওপরে উঠতে গেলে বাধাগ্রস্ত হবে। অগ্নিকাণ্ডের সময় তাড়াহুড়ো করে লোকজন বের হওয়ার সময় অনেকে ভুল করে রেড জোনে চলে যায়। ওই পথ থাকলে সেটা হবে না। ওই পথ দিয়ে লোকজন শুধু নিরাপদ জায়গার দিকে যাবে।
বাংলাদেশের বহুতল ভবন মালিকরা এ বিষয়ে এখনও সেভাবে সচেতন হননি। তবে দেশের গার্মেন্ট সেক্টরে কয়েকটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর গার্মেন্ট মালিকরা এ বিষয়ে ভাবছেন। বিশেষ করে যারা সরাসরি বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা করছেন, এসব গার্মেন্টস মালিকদের বর্তমানে শতভাগ ফায়ার সিকিউরিটি কার্যকর করতে দেখা গেছে বলে যোগ করেন শাজাহান শিকাদার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অগ্নি নির্বাপণের জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের নিজস্ব কোনও হেলিকপ্টার নেই। প্রয়োজনে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। যেগুলো ব্যবহার করা হয় সেগুলো ফায়ার সার্ভিসের জন্য কোনও বিশেষ হেলিকপ্টার নয়। ফায়ার রেসকিউ হেলিকপ্টারও নয়।
এ বিষয়ে শাজাহান শিকদার বলেন, অগ্নি নির্বাপণ করার জন্য যে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয় সেগুলো অগ্নি নির্বাপণ কোনও বিশেষ হেলিকপ্টার নয়। সাধারণত বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে অগ্নি নির্বাপণের যে হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয় সেটির বাতাস ওপরের দিকে ওঠে। আর বর্তমানে ফায়ার সার্ভিস যে হেলিকপ্টার ব্যবহার করে সেটির বাতাস নিচের দিকে চলে যায়। বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ড ঘটনা ঘটলে কোনও ভবনের ছাদে লোকজন আটকে যায়। উদ্ধারের কাজে হেলিকপ্টারের সাহায্য প্রয়োজন হয়। এছাড়া বঙ্গবাজারের মতো খোলা জায়গায় অগ্নিকাণ্ড হলে তখন পানি দেওয়ার কাজেও হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়।
এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বাহিনীর সাবেক পরিচালক ও অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ মেজর (অব.) শাকিল নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বহুতল ভবনে আগুন নেভানোর সময় পানিবাহী গাড়ি থেকে ওপরে পানি ছিটানোর জন্য যে লেডার ব্যবহার করা হয়, সেটি অনেক কারণে মাঝেমধ্যে ঠিকভাবে ব্যবহার করা যায় না। দেখা গেছে, অগ্নিকাণ্ডের শিকার ভবনের একেবারে সামনে ওপরে জটলা বেঁধে আছে বিদ্যুতের তার। লেডার ওপরে উঠাতে যা বাধা দেয়।
তিনি বলেন, নিয়ম মেনে বহুতল ভবন নির্মাণ করতে হলে যেটুকু জায়গা নিয়ে ভবন নির্মাণ করা হবে, একই পরিমাণ জায়গা ভবনের সামনে খালি রাখতে হবে। বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম, এ সংক্রান্ত সব বিষয় নিশ্চিত করেই করতে হবে।
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে, মেনটেইনেন্সের অভাব রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কিছু গাড়ি আছে সরঞ্জাম আছে সেগুলো ঠিকঠাক মেনটেইনেন্সের অভাবে মাসের পর মাস পড়ে থাকে। ব্যবহার করা হয় না। এগুলো দূর করতে হবে।