বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও শীর্ষ নেতা মির্জা আব্বাস ও যুগ্ম মহাসচিব মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৮টার দিকে শহীদবাগ মসজিদের গলির বাসা থেকে মির্জা আব্বাসকে এবং একই এলাকার আরেকটি বাসা থেকে ওই সময়ে মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে গ্রেফতার করা হয়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছেন, গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যা ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা-ভাঙচুরসহ প্রায় সব মামলায় আসামি করা হয়েছে মির্জা আব্বাস ও মোয়াজ্জেম হোসেন আলালকে।
এর আগে গত রবিবার সকালে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আগের দিন শনিবার প্রধান বিচারপতির বাসায় হামলার মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে রবিবার রাতে কারাগারে পাঠানো হয়।
উল্লেখ্য, গত ২৮ অক্টোবর নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে মহাসমাবেশের আয়োজন করে বিএনপি। এতে অংশগ্রহণ করতে ওই দিন সকাল থেকেই নয়া পল্টন এলাকায় বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত হন, যা ফকিরাপুল হতে বিজয়নগর পানির ট্যাংক ও কাকরাইল মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।
শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে চলবে—এই শর্তে বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে সমাবেশের অনুমতি দিয়েছিল ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। তবে ঘোষিত সমাবেশ শুরুর আগেই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে হঠাৎ হামলা শুরু করে বিএনপির কর্মীরা। বেলা ১টার দিকে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা করে তারা। এখান থেকে ধীরে ধীরে কাকরাইল, পল্টন, শান্তিনগর, আরামবাগ হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ।
দুপুর ১টার পর কাকরাইল মোড়ে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশ টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। টিয়ারশেল ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে মঞ্চের সামনে নেতাকর্মীরা দাঁড়িয়ে যান এবং মঞ্চের অপর পাশের রাস্তায় থাকা কর্মীরা সরে ফকিরাপুলের দিকে চলে যান। পরক্ষণেই আবার কিছু কর্মী লাঠি হাতে সংঘর্ষের স্থানের দিকে যেতে থাকেন। আর কিছু নেতাকর্মী অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য উদ্বিগ্ন অবস্থায় মঞ্চের সামনেই দাঁড়িয়ে থাকেন। এ অবস্থায় মঞ্চ থাকা নেতাকর্মীরা বক্তব্য বন্ধ করে দেন। পরে পুলিশ নিরাপত্তার কারণে পুরো এলাকা ঘিরে ফেলে।
পরে বিএনপির শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে ‘আওয়ামী লীগ ও পুলিশের যৌথ হামলা চালিয়েছে’ অভিযোগ এনে কর্মসূচি বন্ধ ঘোষণা করে দলটি। এ সময় পরদিন ২৯ অক্টোবর সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকে বিএনপি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মঞ্চ থেকে হ্যান্ডমাইকে হরতালের ঘোষণা দেন।
এদিকে কাকরাইল মোড়, হাইকোর্ট এলাকা ও প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে বিএনপির কর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনের সামনে গাছের ডাল ভেঙে ও হাতের লাঠি দিয়ে নামফলক ও গেট ভাঙচুর করে এবং বাসভবনের ভেতরে ইটপাটকেল ছোড়ে।
এর মধ্যে কাকরাইল ট্রাফিক পুলিশ বক্সে আগুন দেয় বিএনপির অনুসারীরা। পুলিশ বাধা দিতে গেলে বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এ সময় কাকরাইল মসজিদ মোড়ে গুলিস্তান পরিবহন গাড়িতে হামলা চালায় তারা।
দুপুর দেড়টার দিকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও পুলিশের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে এক কর্মীসহ চার জন আহত হন। আরামবাগে পুলিশের গুলিতে জামায়াতে ইসলামীর এক কর্মী আহত হন।
বিজয়নগর এলাকায় পুলিশ কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম পারভেজকে পিটিয়ে আহত করা হয়। পরে ওই দিন বিকাল ৪টার দিকে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সোয়া ৪টায় মৃত ঘোষণা করেন। তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে।
রক্তক্ষয়ী এই সংঘর্ষে যুবদলের ওয়ার্ড পর্যায়ের এক নেতা নিহত হয়েছেন। যদিও ডিএমপি জানিয়েছে, মহাসমাবেশ চলাকালে নিহত যুবক শামীম মিয়া যুবদল কর্মী নন বলে পুলিশকে জানিয়েছেন তার পিতা ইউসুফ মিয়া। যুবক শামীম মিয়া একজন চিকিৎসকের ড্রাইভার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশের ত্রিমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে ৪১ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। বাকিদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে রাজারবাগ পুলিশ হাসপাতালে ২২ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়া সাংবাদিক, পুলিশসহ শতাধিক আহত হয়েছেন।
রবিবার (২৯ অক্টোবর) সকালে বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে সংঘর্ষে পুলিশ কনস্টেবল আমিনুল পারভেজ নিহত হওয়ার ঘটনায় পল্টন মডেল থানায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করে।
অন্যদিকে রবিবার রাজধানীর শাহজাহানপুর থানার এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় এজহারনামীয় আসামি করা হয়েছে মির্জা আব্বাসসহ ৪৯ জনকে। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে আরও প্রায় ৮০০ জনকে।
মামলায় নয়া পল্টনে মহাসমাবেশ শেষে মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে শাহজাহানপুর থানাধীন কমলাপুর রেলওয়ে অফিসার্স কোয়ার্টারের সামনে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সরকারবিরোধী স্লোগান, জনমনে আতঙ্ক ও ভীতি সৃষ্টি করে নাশকতামূলক ও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা এবং হত্যার উদ্দেশ্যে ইটপাটকেল নিক্ষেপ, ককটেল বিস্ফোরণ, সরকারি কাজে বাধা, পুলিশের অস্ত্র ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
রবিবার সচিবালয়ের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছিলেন, ‘মামলা মাত্র শুরু হয়েছে। আরও মামলা হবে। যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা সবাই মামলা করবে।’
সোমবার (৩০ অক্টোবর) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) বিভিন্ন থানায় মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের ওপর হামলা, পুলিশ হত্যা, সরকারি স্থাপনায় হামলা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনাসহ বিভিন্ন অভিযোগে ৩৬টি মামলা করা হয়। মামলাগুলোয় নাম উল্লেখ করা আসামির সংখ্যা ১ হাজার ৫৪৪ জন। অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয় অনেককেই।
মামলা দায়েরের পর ২৮ অক্টোবর ৬৯৬ জন এবং ২৯ অক্টোবর ২৫৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়।