সাজার হার বাড়াতে জোর দিচ্ছে পুলিশ। বিশেষ করে খুন ও মাদক মামলায় সাজার হার কম হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনা সভায় বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আদালতে বিচারাধীন মামলায় সাজা নিশ্চিত করতে হলে যথাযথ প্রক্রিয়ায় তদন্ত সম্পন্ন করে নির্ভুল চার্জশিট দিতে হবে। তদন্তে গাফিলতি ও চার্জশিটে ভুল থাকলে সেটির সুযোগ নেয় আসামি পক্ষ। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের কিছুই করার থাকে না। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পুলিশের সব ইউনিটকে সাজার হার বাড়াতে কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারে তদন্তাধীন মামলার মধ্যে ৯২ দশমিক ৪৪ শতাংশ মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বাকি ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ মামলায় চূড়ান্ত রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়ার হার বেশি থাকলেও সাজার হার মাত্র ২৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। এর মধ্যে মাদক মামলায় ৩৭ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ডাকাতি মামলায় সাজার হার ২৫ শতাংশ, খুনের মামলায় ৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ, অপহরণ মামলায় সাজার হার ৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ, ধর্ষণ মামলায় সাজার হার ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, নারী নির্যাতন মামলায় সাজার ৫ দশমিক ৭২ শতাংশ।
পুলিশ সদর দফতরের বৈঠকে বলা হয়েছে, সাজার হার অত্যন্ত হতাশাজনক। চার্জশিট দাখিল করা যেকোনও মামলায় সাজা নিশ্চিত করার জন্য তদন্তের গুণগত মান বাড়াতে হবে। তাহলে সাজার হারও বাড়বে। সাজার হার বাড়াতে হলে কোর্ট ইন্সপেক্টরদের সঙ্গে সমন্বয় করে সাক্ষীদের যথাসময়ে হাজির করতে হবে। একইসঙ্গে পুলিশের যেসব রেঞ্জ এলাকায় সাজার হার কম সেসব এলাকায় কোর্ট ইন্সপেক্টরদের সহযোগিতা করতে প্রয়োজনে একটি বিশেষ টিম গঠন করে দিতে হবে। বিচার চলাকালে সাক্ষীদের হাজিরের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। কোর্ট ভিজিটের মাধ্যমে পুলিশ-সাক্ষীদের (যেসব পুলিশ মামলায় সাক্ষ্য দিয়ে থাকেন) হাজির ও সাক্ষ্য প্রদান সংক্রান্ত বিষয় মনিটর, ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রতিবেদন প্রস্তুত করে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে পাঠাতে হবে। তাহলে সারা দেশের পুলিশ-সাক্ষীরা জানবেন যে ঠিকমতো সাক্ষ্য না দিলে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
পুলিশ সদর দফতরের ওই বৈঠকে অতিরিক্ত আইজিপি (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) বলেন, ‘একটা মানুষ খুন হলে তার ন্যায্যবিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। বিশেষায়িত ইউনিটগুলো অনেক পুরোনো খুনের মামলার রহস্য উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। খুনের মামলায় শতভাগ সাজা হওয়া উচিত।’
বৈঠকে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল বলেন, ‘মামলা যখন বিচারাধীন থাকে, তখন জিআরওদের কোনও কাজ থাকে না। সাক্ষীদের ব্রিফিং সঠিকভাবে হচ্ছে না। পিপি বা এপিপিদের ব্রিফ করার দায়িত্ব থাকলেও তারা ব্রিফ করছেন না। পেশকাররা সাক্ষীর সমন সময়মতো জারি না করার কারণে কোর্ট ইন্সপেক্টরের কাছে দেরি করে আসে। ফলে সাক্ষীদের যথাসময়ে হাজির করা যাচ্ছে না। এছাড়া বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণে পাবলিক-সাক্ষী ও বাদী আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তাকে পাবলিক-সাক্ষীর মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বলা হয়েছে।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (প্রসিকিউশন) আনিসুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সঠিক তদন্ত ও সাক্ষী হাজির কম হওয়ার কারণে সাজার হার কম হচ্ছে। সমঝোতার কারণেও অনেক মামলা খালাস হয়ে যাচ্ছে। সারা দেশে প্রায় ৩৮ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ মামলাই উদ্ধারজনিত। উদ্ধারজনিত মামলার বাদী পুলিশ। তদন্ত কর্মকর্তারা পাবলিক-সাক্ষীদের হাজির করতে পারেন না বা গাইড করতে পারেন না। আর যেসব পাবলিক-সাক্ষী হাজির হন, তারা সাক্ষ্য দেন যে পুলিশ সাদা কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছে। পিপি-এপিপিদের সঙ্গে কাজ করার জন্য জেলা পর্যায়ের কোর্টে একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার পদায়ন করা প্রয়োজন।’
পিবিআইর অতিরিক্ত আইজিপি বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘শুধু কোর্টের মাধ্যমে সাজার হার বৃদ্ধি করা যাবে না। তদন্তের মান বৃদ্ধি করতে হবে। পাবলিক-সাক্ষীর সংখ্যা হ্রাস করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় সাক্ষী নেওয়া যাবে না। কোর্টের সমন ইস্যু ডিজিটাল করতে পারলে এই সমস্যা কমে যাবে।’
পুলিশ সদর দফতরের বৈঠকে বলা হয়, সাধারণত অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সদস্যরা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আসতে চান না। এছাড়া সাক্ষীর হাজিরার জন্য সরকারের বরাদ্দ প্রয়োজন। একইসঙ্গে ডিজিটালি সাক্ষ্যগ্রহণ করা হলে পুলিশ-সাক্ষীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর কোয়ার্টারে (প্রান্তিকে) বিচার নিষ্পত্তিকৃত সর্বোচ্চ সাজা প্রদানকারী ইউনিট জয়পুরহাটে ৬৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ, বরিশাল মেট্রোপলিটন এলাকায় ৫৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ, খুলনায় ৫১ দশমিক ৬২ শতাংশ, রাঙামাটিতে ৫০ শতাংশ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৪৮ দশমিক ৪ শতাংশ সাজা হয়েছে। আর সর্বনিম্ন সাজা প্রদানকারী ইউনিট হলো—গাজীপুরে ৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ, গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকায় ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ, পিরোজপুরে ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ, কক্সবাজারে ৯ দশমিক ৫৭ শতাংশ ও রংপুরে ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ।