X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ আছে, মালিকানায় পিছিয়ে

শফিকুল ইসলাম
০৮ মার্চ ২০২৪, ১৬:৪৬আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৪, ২০:০২

পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার কলার দোয়ানিয়া গ্রামের বাসিন্দা খাদিজা বেগম। তিনি পুরোপুরি গৃহিণী। স্বামী আসলাম উদ্দিন হাটে ছোট মুদি ব্যবসা পরিচালনা করেন। দুই সন্তানের সংসারে অভাব যেন পিছু ছাড়ছিল না। আসলাম ও খাদিজার সংসারের সেই অভাব এখন আর নেই। বাবার বাড়ি থেকে পাওয়া একটি গাভি লালনপালন করে সংসার দাঁড় করিয়েছেন খাদিজা। প্রতিদিন সকালে গাভির দুধ বিক্রি করেন। এই টাকা দিয়ে বাজার ও গাভির খাবার খরচ মেটান। আসলামের ব্যবসার আয় খরচ হয় না বলে এখন তিনি সঞ্চয় করতে পারছেন। ব্যাংকে টাকা জমাচ্ছেন।

গত বছর কোরবানিতে খাদিজা একটা বড় বাছুর বিক্রি করেছেন ২২ হাজার টাকায়। সেই টাকাও আসলামের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রেখেছেন। এই টাকার মালিক আসলাম, খাদিজা নয়। দুজনার সংসারে গাভিটি লালনপালনকারী খাদিজা হলেও টাকার মালিক আসলাম। এতে সহজেই বোঝা যায়, প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ আছে কিন্তু মালিকানা নেই। শুধু নাজিরপুরের খাদিজাই নয়, সারা দেশেই মেলে এমন চিত্র।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানা গেছে, প্রাণি খাতের মাধ্যমে বর্তমানে শতকরা ২০ ভাগ প্রত্যক্ষ এবং ৫০ ভাগ পরোক্ষভাবে মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে, যার অধিকাংশই নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে বর্তমানে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১ দশমিক ৯০ শতাংশ এবং প্রবৃদ্ধি তিন দশমিক ১০ শতাংশ। কৃষিক্ষেত্রে প্রাণিসম্পদের অবদান ১৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, যা জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ মানুষকে প্রত্যক্ষ এবং ৫০ শতাংশ মানুষকে পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত করে। এ সব কারণেই গবাদি পশুর খামার দ্রুত বর্ধনশীল ও সম্ভাবনাময় একটি খাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

এদিকে, দেশের প্রাণিসম্পদ খাতের প্রধান চালিকাশক্তি এখন নারী। বিশেষ করে গ্রামীণ নারীদের শ্রমে ভর করে এগোচ্ছে দেশের গবাদিপশু ও পোলট্রির সম্প্রসারণ কার্যক্রম। প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও এতে মালিকানায় তারা পিছিয়ে রয়েছেন। বাংলাদেশ ইন্টিগ্রেটেড হাউজহোল্ড সার্ভে ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশের বড় আকারের গবাদিপশুর (গরু-মহিষ) ৭২ দশমিক ৪ শতাংশ মালিকানাই রয়েছে পুরুষের হাতে আর নারীর মালিকানায় রয়েছে ২৫ দশমিক ৬ শতাংশ। আবার ছাগল-ভেড়ার ক্ষেত্রে পুরুষের মালিকানায় আছে ৫৩ দশমিক ৮ শতাংশ আর নারীর মালিকানায় আছে ৪৪ দশমিক ৩ শতাংশ। এখানেও নারীর মালিকানা পুরুষের তুলনায় কম।

যত বেশি উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের সম্পৃক্ত করা যায় তত বেশি তারা স্বাবলম্বী হবেন  (ছবি: সংগৃহীত)

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনের তথ্যমতে, প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ ৮৮ দশমিক ২ এবং পুরুষের মাত্র ১১ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রতিবেদনটিতে শ্রমশক্তি জরিপ ২০১৬-১৭-এর তথ্যে দেখা গেছে, দেশের মোট কর্মসংস্থানের প্রায় ১৪ দশমিক ৫ শতাংশই প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। আর কৃষি খাতের কর্মসংস্থানের মধ্যে প্রাণিসম্পদ খাতের অংশ ৩৫ শতাংশ। এছাড়া দেশের মোট পুরুষ কর্মসংস্থানের মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে কাজ করছে আর নারীদের মোট কর্মসংস্থানের ৪১ শতাংশই প্রাণিসম্পদ সংশ্লিষ্ট খাতে।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রাণিসম্পদ খাতে নারীদের অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও তারা শ্রমমূল্য পাচ্ছেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়ির কাজ দেখাশোনার পাশাপাশি তারা গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন করেন। এ জন্য তাদের শ্রমমূল্য আলাদাভাবে পরিশোধ করা হয় না। কোথাও চাকরি হিসেবে কাজ করলেও শ্রমমূল্য থাকে পুরুষের তুলনায় অনেক কম।

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর মনে করে, প্রাণিসম্পদ কার্যক্রমে নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা গেলে নিজ উদ্যোগে আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মস্থান তৈরি হবে। উন্নত ও টেকসই প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ উৎপাদন কাজের জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। নারীরা বিভিন্ন কারিগরি বিষয় ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজের, পরিবারের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনাতামূলক জ্ঞান, দক্ষতা ও আচরণগত পরিবর্তন করবে। নারী উদ্যোক্তা হিসেবে একটি নতুন কর্মকৌশল আয়ত্ব করবে, আয় বৃদ্ধি করবে ও স্বাবলম্বী হবে। নিজেদের অধিকার সম্পর্কে জানবে এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। পরিবারে অর্থনৈতিক অবদান রাখবে ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। পরিবারে ও সমাজে মার্যাদা বৃদ্ধি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা অর্জন করবে। আত্মবিশ্বাস ও মনোজগতের শক্তি বৃদ্ধি এবং নিজের পছন্দকে মূল্যায়ন ও কমিউনিটিকে নেতৃত্ব দেবে। সামাজিকভাবে প্রাণিসম্পদ উন্নয়নে নারী উদ্যোক্তা হিসেবে কাজের স্বীকৃতি এবং জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ও নিজেদের জীবনের মানোন্নয়ন করবে।

দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) দেওয়া তথ্য মতে, নারীরা পারিবারিকভাবে গবাদিপশু দেখাশোনা করেন। বাড়ির কাজ যেমন অবৈতনিক তেমনই পারিবারিক গবাদিপশু লালনপালনও অবৈতনিক। এটা তাদের সম্পূর্ণ কর্মসংস্থান নয়। বৃহত্তর পারিবারিক কাজের অংশ হিসেবেই তারা এটা করেন। স্বাবলম্বী করতে হলে নারীদের মালিকানা দিতে হবে। কিন্তু পারিবারিকভাবে দেখাশোনা করলে নারীরা মালিকানা পান না। যত বেশি উদ্যোক্তা হিসেবে নারীদের সম্পৃক্ত করা যায়, তত বেশি তারা স্বাবলম্বী হবেন। অর্থাৎ নিজের টাকায় গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি কিনতে হবে।

নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে  (ছবি: সংগৃহীত)

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্পের (এলডিডিপি) চিফ টেকনিক্যাল কো-অর্ডিনেটর ড. মো. গোলাম রব্বানী বলেন, সামাজিকভাবে আমাদের দেশে পরিবারগুলোর কর্তা পুরুষ। সে কারণে প্রাণিসম্পদ খাতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি থাকলেও পুরুষরাই বেশি মালিকানায় রয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মালিকানার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশীদারত্ব বাড়ানো। সেটাকে প্রাধান্য দিতে হবে এবং তার জন্য নারীদের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী করতে বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে চাহিদা অনুসারে ২ থেকে সোয়া ২ কোটি গবাদিপশু বিশেষ করে গরুর চাহিদা কোনও না কোনোভাবে থাকেই। ঈদের সময় ৫০, ২৫ বা ৩০ ভাগ নেমে গেলেও সেটা আবার সারা বছর পর্যায়ক্রমে উৎপাদন হচ্ছে। প্রাণিসম্পদ খাত এখন সম্পদে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ চাইলে উৎকৃষ্টমানের মাংসের উৎপাদন করতে পারে বলে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাতে মাংসের দামও অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। গরুর চামড়া মূল্যবান একটি উপাদান। দেশে যদি গরুর উৎপাদন বাড়ে, মাংসের চাহিদা বাড়ে বা মাংস রফতানি হয় তাহলে চামড়ার কথা আসবেই। আর চাহিদার তুলনায় বেশি চামড়া উৎপাদন করলে আন্তর্জাতিক বাজারেও মূল্য পাওয়া যাবে। কারণ গ্লোবাল মার্কেটে এই চামড়ার ভালো চাহিদা রয়েছে। গবাদিপশুর চাহিদা বিশ্বজুড়ে। সে অনুযায়ী ইতোমধ্যে দেশের দুই একটা প্রতিষ্ঠান গবাদিপশুর মাংস রফতানি করছে। বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে হালাল মাংসের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রেও এই মাংসের চাহিদা আছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদিজা বেগম বলেন, স্বামীর সংসারে বসবাস করছি। এ সংসার তো আমারও। এখানে আবার সম্পদের মালিকানা কী? সংসারের কাজ তো আমারই কাজ। এতে আবার পারিশ্রমিক লাগে নাকি? আর টাকা পয়সার হিসাব বুঝি না।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান বলেন, দেশের সর্বত্র এখন গবাদিপশুর খামার গড়ে উঠেছে। এসব খামারের অধিকাংশই নারীরা দেখাশোনা করেন। তারা নিজেরা এসব খামারের উদ্যোক্তাও হচ্ছেন। এসব খামোরের উদ্যোক্তা নিজে হলেও পরিবারের পুরুষ সদস্যের এক ধরনের ক্ষমতা থাকে। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নাই। পরিসংখ্যান যাই বলুক, এ খাতে নারীর অবদান কিন্তু উল্লেখ করার মতো। বিষয়টি নিয়ে সবারই কাজ করা সময় এসেছে।

/আরআইজে/
সম্পর্কিত
রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক হবে না: সালেহউদ্দিন আহমেদ
গবেষণার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের আহ্বান প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর
সরকারের ১০০ দিনে নানা চ্যালেঞ্জ
সর্বশেষ খবর
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
তীব্র গরমে নির্বাচনি প্রচারণায় আ.লীগ নেতার মৃত্যু
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
দেশে আগ্রাসী শাসন চলছে: দিলারা চৌধুরী
বিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
উপন্যাসবিকল্প অর্থনীতি ও গ্রাম্য কায়কারবার
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু