X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহারে লিঙ্গ বৈষম্যের হার সবচেয়ে বেশি: গবেষণা

বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট
০৯ মার্চ ২০২৪, ১৬:০০আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৪, ১৬:০৩

দেশে মোবাইলভিত্তিক আর্থিক সেবা (মোবাইল ব্যাংকিং) ব্যবহারে লিঙ্গ বৈষম্যের হার সবচেয়ে বেশি। আড়াই বছর ধরে চালানো এক গবেষণার প্রতিবেদন এ তথ্য জানিয়েছে। গবেষণার তথ্য বলছে, পুরুষদের মধ্যে ৮২ দশমিক ৫৮ শতাংশ মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবহার করেন। আর নারী ব্যবহার করেন ৪৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। এতে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যবধান ৩৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। এছাড়া ব্যাংকিং খাতেও ১৭ দশমিক ২৮ শতাংশ লিঙ্গ বৈষম্য (ব্যবধান) রয়েছে। অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৬১ দশমিক ৯৫ শতাংশ নারী অন্তর্ভুক্ত রয়েছেন, যেখানে পুরুষের অন্তর্ভুক্তি মাত্র ৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ।

শনিবার (৯ মার্চ) সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি: জেন্ডার পরিপ্রেক্ষিত’ বিষয়ক একটি দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশের গবেষণা সংস্থা ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিআরডি)’ এই সম্মেলনের আয়োজন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে ‘বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে জেন্ডার বৈষম্য’ শীর্ষক গবেষণাটি চালানো হয়।

সম্মেলনে গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন, সিআরডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. মো. মোখলেসুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়েমা হক বিদিশা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজের অধ্যাপক ড. আয়েশা বানু।

সম্মেলনের প্রথম ভাগে গবেষণা প্রকল্পের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। অধিবেশনটি সঞ্চালনায় ছিলেন ফাউন্ডেশনের ইনক্লুসিভ ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমস-এর বাংলাদেশ কান্ট্রি লিড স্নিগ্ধা আলী। গবেষণায় দেশব্যাপী ৫৬টি জেলার ২২০টি ক্লাস্টারের ভিত্তিতে ৩ হাজার ৩০০টি পরিবারের ৭ হাজার ৫৬০ জন ব্যক্তির উপর পরিচালিত জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। এর পাশাপাশি গুণগত গবেষণার অংশ হিসেবে ৬৪টি দলগত আলোচনা, ৪৯টি নিবিড় সাক্ষাৎকার এবং ৫৬টি বিশেষজ্ঞ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়েছে।

লিঙ্গ বৈষম্যের চিত্র (ছবি: বাংলা ট্রিবিউন)

জরিপের ফলাফল থেকে দেখা গেছে যে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে ৬ দশমিক ৯০ শতাংশ পয়েন্ট জেন্ডার গ্যাপ রয়েছে। যদিও বিশদ বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে, এই গ্যাপের ব্যাপ্তি ও গভীরতা আরও অনেক ব্যাপক।

গবেষণায় দেখা গেছে যে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা যে শুধু পিছিয়েই রয়েছে তাই নয়, ব্যাংকের মতো আনুষ্ঠানিক আর্থিক সেবার ক্ষেত্রেও তারা প্রান্তিক অবস্থানে রয়েছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারী-পুরুষের ব্যবধানের তিন চতুর্থাংশ (৭৬ শতাংশ) অর্থনৈতিক অবস্থান, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, খানা কাঠামো ও বৈবাহিক অবস্থা ইত্যাদি আর্থ-সামাজিক বিষয়গুলোর মাধ্যমে এই অবস্থান ব্যাখ্যা করা যায়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে নারী-পুরুষের ব্যবধানের বাকি ২৪ শতাংশ এ ধরনের দৃশ্যমান সূচকের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যায় না। এক্ষেত্রে সামগ্রিক বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন।

গবেষণাটিতে গুণগত বিশ্লেষণের মাধ্যমে জেন্ডার ব্যবধানের সূক্ষ্ম দিকগুলোকে খুঁজে বের করে জেন্ডার বৈষম্যের স্তর ও ব্যাপ্তি উন্মোচন করা হয়। জেন্ডার মতাদর্শ, সামাজিক রীতিনীতি ও বিধিনিষেধ নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধাগ্রস্ত করে বলে গবেষণায় উঠে আসে। নারীরা অবমাননাকর মন্তব্য এবং সামাজিক নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হয়, যা তাদের কাজ ও সক্রিয় ভূমিকাকে ঘরে ও বাইরে সীমাবদ্ধ করে দেয়। এই প্রথাগুলো আর্থিক সেবা প্রদানকারী ও গ্রহণকারীদের মানসিকতাকেও প্রভাবিত করে এবং আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পূর্বশর্ত যেমন সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগগুলোতে নারীদের অভিগম্যতাকেও বাধাগ্রস্ত করে। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও নীতি কাঠামোও এই প্রথাগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়। অনেক বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও, কিছু নারী আর্থিক অন্তর্ভুক্তির একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছেছেন, যা ইতিবাচক পরিবর্তন হিসাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বামী বা মূল উপার্জনকারীর মৃত্যু, অসুস্থতা ও চিকিৎসা ব্যয়ের মতো বিষয়সমূহ এ নারীদের ক্ষেত্রে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে।

গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে গবেষকগণ কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন, যেমন নারীদের তথ্য প্রাপ্তিতে এবং ডিজিটাল ডিভাইসে অভিগম্যতা নিশ্চিত করা, ব্যাংকের শাখাগুলোতে জেন্ডার-বান্ধব ব্যবসায়িক পরিবেশ এবং ঋণ ও অন্যান্য সেবার ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য কমানোর জন্য একটি বিশদ কর্ম পরিকল্পনা প্রণয়নসহ বিস্তৃত উদ্যোগ গ্রহণ, সেই সঙ্গে জেন্ডার ব্যবধান কমানোর ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা বাড়ানো এবং এর বাস্তবায়ন। আর্থিক এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার জন্য সচেতনতা এবং দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের উপর জোর দেওয়া, টেকসই প্রচারাভিযান এবং সচেতনতা বাড়াতে অ্যাডভোকেসি ইত্যাদি।

উপরোল্লিখিত সুপারিশ ছাড়াও, নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরিসর বৃদ্ধির জন্য গবেষণায় নারীদের কর্মসংস্থান ও আয়ের প্রতিও দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়, এছাড়াও সম্পত্তিতে নারীদের অধিকারহীনতা, মজুরিবিহীন সেবামূলক কাজের অবমূল্যায়ন, বাল্যবিবাহ এবং জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ইত্যাদি বিষয়গুলো সর্বোচ্চ স্তর থেকে মোকাবেলা করার জন্য সুপারিশ করা হয়।

সম্মেলনের উদ্বোধনী অংশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, নারীর ক্ষমতায়নের অভাব থাকলে যেকোনো সমাজের জন্য ব্যথিত হওয়ার মতো বিষয়। আমরা যদি নারীর ক্ষমতায়নকে প্রমোট করতে পারি দেশের উন্নয়নের ব্যাপ্তি আরও বেশি হবে এবং টেকসই হবে। আমি যখন গভর্নর ছিলাম, আমার মূল আদর্শ ছিল এই জায়গাতেই। আমরা বড় বড় ব্যাংকগুলোতে এই ক্ষেত্রে এক প্রকার চাপও দিয়েছিলাম। নারীর ক্ষমতায়নে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে  বাংলাদেশ বেশ সুপরিচিত। গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশ জেন্ডার বাজেট প্রণয়ন করছে এবং বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় এই জায়গায় বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়।

এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, ব্যাংকিং খাত লিঙ্গ বৈষম্য দূর করতে ভূমিকা রাখতে পারে। গত ১৫ বছরে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। সেই অনুসারে ঋণগ্রহীতার সংখ্যাও বেড়েছে। তারপরও এসএমই খাতে নারীদের অংশগ্রহণ ১০ শতাংশের আশেপাশে। সমীক্ষার তথ্য বলছে, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় লিঙ্গ বৈষম্য বিদ্যমান। বাংলাদেশ ব্যাংকের নানা উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও লিঙ্গ বৈষম্যে আর্থিক খাতে পুরুষের আধিপত্য বেশি। এছাড়া ক্ষুদ্র ঋণ উদ্যোক্তা কার্যক্রমে নারীদের অংশগ্রহণ ৪ শতাংশের আশপাশে। কিছু আর্থিক প্রতিষ্ঠান অতি ক্ষুদ্র ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে এফ কমার্সে নারীর অংশগ্রহণে ভূমিকা রাখছে। এর ফলে অনেক নতুন নতুন নারী উদ্যোক্তা বেরিয়ে আসছে। তা সত্ত্বেও যথাযথ ব্যবসা পরিকল্পনা, আর্থিক হিসাব পরিচালনায় অদক্ষতা, দক্ষতার অভাব, প্রযুক্তিগত অক্ষমতা, উদ্ভাবনী, ডাইভারসিফিকেশন, ডিজাইন, নেটওয়ার্কিংয়ের অভাব এখানে রয়েছে।

বাংলাদেশে ব্যাংক ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোক্তাদের ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম দিলেও তাদের সংখ্যা তেমন বাড়েনি বলেও মনে করেন ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘৭ হাজারেরও বেশি উদ্যোক্তার মধ্যে ৬০০-এর কিছু বেশি উদ্যোক্তাদের ক্রেডিট গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে, যাতে ব্যাংকগুলোর সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের সম্পর্ক আরও বৃদ্ধি পায়।’ তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের নানারকম চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।       

এসময় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর নুরুন নাহার, বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের ইনক্লুসিভ ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেমের ডেপুটি ডিরেক্টর হিলারি মিলার ওয়াইজ।

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডার, নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা এক্ষেত্রে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে জেন্ডার বৈষম্য দূর করার কৌশলগুলো সম্পর্কে মতামত প্রদান করেন। এ গবেষণার প্রধান চার জন গবেষক হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. আয়েশা বানু; বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ড. লীলা রশিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা এবং সিআরডির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. মোখলেছুর রহমান।

/এসও/ইউএস/ 
সম্পর্কিত
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
নারী উদ্যোক্তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহার বিষয়ক প্রকল্পের সমাপনী অনুষ্ঠিত
সর্বশেষ খবর
সবসময় কি টাকার পেছনে ছুটে সময় ব্যয় করবেন?
সবসময় কি টাকার পেছনে ছুটে সময় ব্যয় করবেন?
মানুষকে স্বস্তি দিতে বিনামূল্যে শরবত খাওয়াচ্ছে ছাত্রলীগ
মানুষকে স্বস্তি দিতে বিনামূল্যে শরবত খাওয়াচ্ছে ছাত্রলীগ
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের’ কার্যক্রমের তদন্ত চায় মানবাধিকার কমিশন
‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের’ কার্যক্রমের তদন্ত চায় মানবাধিকার কমিশন
বুন্দেসলিগায় গোলের রেকর্ডে চোখ কেইনের
বুন্দেসলিগায় গোলের রেকর্ডে চোখ কেইনের
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে