X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক হচ্ছে মিরপুর, কিন্তু ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা কেমন?

জুবায়ের আহমেদ
২৬ মার্চ ২০২৪, ১০:০০আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৪, ১০:০০

মেট্রোরেলসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে রাজধানীর মিরপুর এখন অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ভবন  গড়ে উঠছে। আবার এই এলাকার পুরনো বিল্ডিংগুলোকেও সংস্কার করে নতুন চেহারা দেওয়া হচ্ছে।   বেশ কয়েকটি পুরাতন পরিচিত ভবন এই এলাকায়, মেট্রোরেল চালুর পর সেগুলোতে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে। বিশেষ দিনগুলোতে এসব ভবনে অবস্থিত মার্কেট ও রেস্টুরেন্টে  মানুষের ভিড় চোখে পড়ার মতো। তবে এত কিছুর মাঝেও যে বিষয়টি দুশ্চিন্তার, তা হলো অগ্নিঝুঁকি।

সম্প্রতি বেইলি রোডে বাণিজ্যিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর আবারও সামনে এসেছে ঢাকার বহুতল ভবনগুলোর অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো। সম্প্রতি মিরপুর ১, ১০, ১১ ও ১২ নম্বরের বিভিন্ন বাণিজ্যিক ভবন ঘুরে দেখা যায়, অধিকাংশ পুরনো ভবনে নেই কোনও অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র সাজিয়ে রাখলেও তা মাঝারি বা বড় ধরনের কোনও দুর্ঘটনার জন্য যথেষ্ট নয়। ফায়ার সার্ভিস থেকে এসব ভবনে বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা মানছে না ভবন মালিক বা কর্তৃপক্ষ।  নতুন করে সংস্কার করা ভবনগুলোয় আগের অবকাঠামোর ওপরেই শুধু নতুন চাকচিক্য যোগ করা হচ্ছে। বাণিজ্যিক ভবন হওয়ার জন্য যেসব নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখা দরকার তা অনুপস্থিত এসব ইমারতে।

মিরপুরের বাণিজ্যিক ভবনগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা খুব ব্যবস্থা দুর্বল (ছবি: প্রতিবেদক)

মিরপুর মাজার কো-অপারেটিভ মার্কেট, শাহ আলি শপিং কমপ্লেক্স, মুক্তিযোদ্ধা হক প্লাজা, মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট, মুক্ত বাংলা মার্কেট, ছিন্নমূল শপিং কমপ্লেক্স, বাগদাদ শপিং কমপ্লেক্সসহ বেশকিছু পরিচিত মার্কেট রয়েছে মিরপুর ১ জুড়ে। এসব মার্কেটের অধিকাংশ দোকানে কাপড় বিক্রি হয়। ঘুরে দেখা গেছে, মার্কেট গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে।

মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট মিরপুর ১ এর অন্যতম বড় বাণিজ্যিক ভবন। অথচ এই ভবন থেকে নামার জন্য তিন কোনায় তিনটি সিঁড়ি যা নতুন কারও জন্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মার্কেটে ওঠার জন্য ফুটপাতের ওপর লোহার সিঁড়ি তৈরি করে দেওয়া হয়েছে এর দুই পাশে। এই ভবনটি পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে মিরপুর থানা মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতি।

মিরপুরের বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে নিরাপত্তার কথা না ভেবেই গড়ে তোলা হচ্ছে নানা রকম দোকানপাট (ছবি: প্রতিবেদক)

ভবনের বিষয়ে সমিতির সহ-সভাপতি মোসালিন বলেন, ‘এই ভবনে ছোটখাটো কিছু অগ্নিকাণ্ড ঘটলে অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকায় তা নেভানো সম্ভব হয়েছে। তবে ভবনটি ভেঙে নতুন করে বানানোর পরিকল্পনা আছে।’

ছিন্নমূল বণিক সমবায় সমিতির লিমিটেড পরিচালিত ছিন্নমূল শপিং কমপ্লেক্সটি এখনও নির্মাণাধীন। প্রায় ২০ বছর আগে এই ভবনের কাজ শুরু হয়। কিন্তু নানা কারণে এই কাজ আর সম্পন্ন হয়নি। ফলে অপরিকল্পিতভাবেই এই মার্কেটের ভেতর দোকান করে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। এই ভবনে নামার জন্য সিঁড়িগুলো খুবই সরু। লিফট বন্ধ করে এর দরজার সামনেও দোকান দিয়ে রাখা হয়েছে। চলন্ত সিঁড়ির জায়গায় লোহা দিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে রাখা হয়েছে।

স্বাভাবিক অবস্থায়ও বাণিজ্যিক ভবনগুলোতে সিঁড়ি খুঁজে পাওয়ায় কঠিন (ছবি: প্রতিবেদক)

এই ভবনের পরিচালনা কমিটির দাবি, ভবন নির্মাণাধীন, তাই এই অবস্থা। নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হলে তখন সব ঠিক করা হবে। তবে দীর্ঘসময় অযত্নে থাকা এই ভবনটি টেকসই কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।

মিরপুর-১ এর আরেকটি বড় বাণিজ্যিক ভবন মিরপুর মাজার কো-অপারেটিভ মার্কেট। এই মার্কেটি অনেক আগেই নির্মাণ করা হয়েছে এবং বর্তমানে এর অবস্থা খুবই নাজুক। ভেতরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশের সুযোগ নেই। ভবনের ওপরের তলার সিঁড়িগুলোও যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। এই ভবনটির বহুমুখী ব্যবহার হচ্ছে। তবে অধিকাংশই কাপড় ও অন্যান্য গার্মেন্টস আইটেমের দোকান। অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি এই ভবনে নেই বললেই চলে।

মার্কেটগুলোর সিকিউরিটি গার্ডদের সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউন প্রতিবেদকের। এসব মার্কেটে আগে আগুন লাগার কোনও ঘটনা ঘটেছে কিনা সেব্যাপারে কোনও তথ্য দিতে পারেননি তারা।

মার্কেট ঘিরে হকার, দুর্ঘটনায় দ্রুত ব্যবস্থায় বাধা

মিরপুর ১ ও ১০ নম্বরে অবস্থিত মার্কেটগুলোর সামনে গায়ে গা ঘেঁষে সারি সারি হকারের দোকান। এসব অস্থায়ী দোকানের কারণে মার্কেটগুলোর প্রবেশপথও ঢেকে গিয়েছে৷ ফলে শঙ্কা রয়েছে, ধরনের বড় কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে মার্কেটের ভেতরে অবস্থান করা মানুষেরা দ্রুত বের হতে গিয়ে সমস্যায় পড়বেন। এছাড়া উদ্ধারবাহিনীর জন্যও হকারদের এসব দোকান বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

ভবনগুলোর সামনে দিয়ে স্বাভাবিক চলাচল বিঘ্নিত করে অস্থায়ী এসব দোকান (ছবি: প্রতিবেদক)

অভিযোগ জানিয়ে বিভিন্ন মার্কেটের দোকান মালিক সমিতির সদস্যরা বলেন, ‘হকারদের কারণে একে তো মার্কেটের সৌন্দর্য ও মান নষ্ট হচ্ছে। আবার কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে এদের কারণে দ্রুত কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার উপায় নেই। এমনভাবে ঘিরে রেখেছে মার্কেট।’

হকারদের সঙ্গে মার্কেটের কারও কোনও সম্পর্ক নেই জানিয়ে দোকান মালিকরা বলেন, এসব হকারের কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত। পুলিশ প্রশাসন চাইলেই এর সমাধান করতে পারে। কেন তারা করে না এই প্রশ্নের উত্তরেই এই হকার সমস্যার সমাধান।

পুরানো ভবনগুলো সংস্কার করে নতুন ভবন

মিরপুর ১২, পল্লবী, ১০ ও ১১ এই সড়কের ওপর দিয়ে চলে গেছে মেট্রোরেলের লাইন। এই রুটে রয়েছে তিনটি মেট্রো স্টেশন। ফলে বদলে গেছে এই এলাকার চিত্র। নামি-দামি বিভিন্ন রেস্টুরেন্ট, পোশাকের দোকান, অফিস, ব্যাংকসহ নানা প্রতিষ্ঠান এই এলাকায় তাদের একটি বা একাধিক শাখা খুলেছে। এর একারণে এই এলাকাগুলোতে, বিশেষ করে সড়কের পাশের পুরানো ভবনগুলো সংস্কার করে নতুন করা হচ্ছে। অথচ একসময় এসব ভবনের কোনোটা আবাসিক আবার কোনোটা গার্মেন্টস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নতুন করে সংস্কার করলেও এসব ভবনের মূল অবকাঠামো আগের মতই রয়ে গেছে। এতে ভবনগুলো বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সম্প্রতি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হওয়ায় মিরপুরের নতুন সংস্কারকৃত কয়েকটি ভবন আবারও সংস্কারের কারণ দেখিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছে।

প্রায় সব মার্কেটের ভেতরেই কাপড়-কাগজের মতো দাহ্য পদার্থ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে (ছবি: প্রতিবেদক)

যেখানে সেখানে রুফটপ রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্ট

মিরপুরের বেশ কয়েকটি বহুতল ভবনের ছাদে রেস্টুরেন্ট ও ফুড কোর্ট দেখা গিয়েছে। এসব রুফটপ রেস্টুরেন্টের মালিকদের দাবি, সব নিয়ম মেনেই তারা এই রেস্টুরেন্ট করেছেন। তবে ভবনগুলোর পুরনো দোকানিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, অতিরিক্ত ভাড়া পাওয়ার আশায় ভবন মালিকরা ভবনের ছাদকে সংস্কার করে এসব রেস্টুরেন্টে করার অনুমতি দিচ্ছেন।

দায়িত্ব অবহেলায় এতদূর

সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো এবং কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে ভবনগুলো আজ মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলেন, ভবন মালিকদের অতিমুনাফা লাভের মনোভাব ও এসব বিষয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি সংস্থাগুলোর দায়িত্ব অবহেলার কারণে আজ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতেও সাধারণ মানুষের আসা যাওয়া। এর মাঝে যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে এর ওর ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের অবহেলার বিষয়টি এড়িয়ে যায়।

যথাযথ অগ্নিনির্বাপন সামগ্রীও নেই সব ভবনে (ছবি: প্রতিবেদক)

এবিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভবন মালিক ও দোকানিদের যেমন দায় রয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোরও অবহেলা রয়েছে৷ ফায়ার সার্ভিস কেবল জানিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করে৷ রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) নিয়মিত খোঁজ রাখে না কী অনুমতি নিয়ে কী পরিচালিত হচ্ছে। ভবনগুলো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা দেখে না৷ ফলে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। তবু আমাদের কোনও বোধোদয় হয়নি।

কী বলছে ফায়ার সার্ভিস

মিরপুর জোনের ফায়ার স্টেশনের স্টেশন অফিসার মো. শাহজাহান সিরাজ বলেন, আমরা মিরপুরের বেশ কয়েকটি ভবনে পরিদর্শনে গিয়েছি। যেসব ভবনগুলোতে অতিরিক্ত সিঁড়ি নেই বা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই সেগুলোকে আমরা নোটিস দিয়ে এসেছি। তাদের কী কী করতে হবে তা জানিয়েছি। এর বাইরে তো আমাদের কিছু করার নেই। এখন মার্কেট বা ভবন মালিকরা যদি এরপরও সতর্ক না হন, তাহলে কী বলার থাকে!

পুরানো ভবনগুলোতে অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি শুরুতেই নিশ্চিত করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, ভবনগুলো যখন বানানো হয়, তখনই অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়টি দেখা উচিত ছিল। তখন তারা এসব নিয়ে এত গুরুত্ব দেয়নি বলে আমার মনে হয়। তবে ভবনগুলোর এখনও সুযোগ আছে এই বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার।

আরও পড়ুন- মার্কেট ঘিরে অবৈধ দোকানপাটে বাড়ছে নিরাপত্তা ঝুঁকি

/এফএস/
সম্পর্কিত
বৃষ্টির প্রার্থনায় নামাজ
হিট অফিসারের পরামর্শে ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’ ছিটাবে ডিএনসিসি
বনানীতে যাত্রীবাহী বাসে আগুন
সর্বশেষ খবর
বৃষ্টির প্রার্থনায় নামাজ
বৃষ্টির প্রার্থনায় নামাজ
মোহামেডানকে রুখে দিলো পুলিশ, চট্টগ্রাম আবাহনী দিলো ৫ গোল
মোহামেডানকে রুখে দিলো পুলিশ, চট্টগ্রাম আবাহনী দিলো ৫ গোল
হিট অফিসারের পরামর্শে ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’ ছিটাবে ডিএনসিসি
হিট অফিসারের পরামর্শে ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’ ছিটাবে ডিএনসিসি
চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া কিশোরকে জীবিত উদ্ধার
চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া কিশোরকে জীবিত উদ্ধার
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই