X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বছরের পর বছর অগ্নিকাণ্ড বাড়ছে, কারণ কী?

কবির হোসেন
২৮ মার্চ ২০২৪, ১০:০০আপডেট : ২৮ মার্চ ২০২৪, ১০:০০

টানা কয়েক বছর ধরে সারা দেশে অগ্নিকাণ্ড বেড়েই চলছে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় গত বছর ও চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের ২৪ তারিখ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। শুধু রাজধানীতে নয়; চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানেও সম্প্রতি বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে হতাহতসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে গেলো কয়েক বছরে অগ্নিকাণ্ড কমেনি, বরং বেড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে উন্নত হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থাও, তারপরও অগ্নিকাণ্ড বাড়ছে। এর পেছনে কারণ কী?

ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছর জানুয়ারি মাসে ২ হাজার ৩৭২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এবং একই বছর ফেব্রুয়ারিতে মাসে ঘটে ৩ হাজার অগ্নিকাণ্ড। এদিকে এর আগের বছর ২০২৩ সালে একই সময়ে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ২ হাজার ৬৪৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ঘটে ২ হাজার ৭১৩টি অগ্নিকাণ্ড।

২০২১ সালে জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ২ হাজার ২৪১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে এবং একই বছর ফেব্রুয়ারিতে মাসে ২ হাজার ৩৭৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এদিকে এর পরের বছর ২০২২ সালে অগ্নিকাণ্ডে বেড়ে জানুয়ারি মাসে সারা দেশে ২ হাজার ২৭৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে এবং ফেব্রুয়ারিতে মাসে ঘটে ২ হাজার ৬০৯টি।

পুরো বছর হিসেবে দেখা গেছে, ২০২১ সালে সারা দেশে মোট ২১ হাজার ৬০১ এটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর পরের বছর ২০২২ সালে সারা দেশে মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২৪ হাজার ১০২টি। তার পরের বছর ২০২৩ সালে সারা দেশে মোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২৭ হাজার ৬২৪টি। ফলে ফায়ার সার্ভিসের এই পরিসংখ্যান দেখে গেছে প্রতি বছরে অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।

নিউ সুপার মার্কেটে আগুন (ফাইল ছবি)

ফায়ার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভবন নির্মাণের আগে ভবন কোড না মানা, ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালা তোয়াক্কা না করা, ভবন সাজসজ্জায় অতিরিক্ত দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করা, নিম্নমানের ও কম দামের বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করা। দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করলেও ফায়ার সেইফটি প্ল্যান না রাখা
অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ব্যবহার না করা। এসব কারণেই অগ্নিকাণ্ড না কমে বছর পর বছর অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বাড়ছে।  

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বড় বড় অগ্নিকাণ্ডে পর সূত্রপাত কারণ জানতে তদন্ত কমিটি গঠন হলেও বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় কোনও তদন্ত কমিটি হয় না। যেটি হচ্ছে সেটিও কোনও কোনও ক্ষেত্রে দৃশ্যমান নয়। ফলে বছরে কতগুলো কমিটি হচ্ছে তাও স্পট নয়। এছাড়া প্রতিবেদন রিপোর্ট পেতে বিলম্ব হয়। ফলে অগ্নিকাণ্ডের বহু ঘটনা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।

২০২৩ সালের ৪ এপ্রিল ভোরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুন লাগে। সেদিন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের পাশাপাশি আরও চারটি মার্কেট আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গত ১১ এপ্রিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দেয়। তারা বলেছে, মার্কেটের তৃতীয় তলায় একটি এমব্রয়ডারি টেইলার্স থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। সিগারেটের আগুন অথবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এই ঘটনা ঘটেছে। এতে ৩ হাজার ৮৪৫ জন ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়েছেন। ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৩০৫ কোটি টাকার।

ফায়ার সার্ভিস গঠিত তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণও প্রায় একই রকমের। তারা বলছে, মশার কয়েলের আগুন বা বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত।

এছাড়া একই বছর ১৫ এপ্রিল ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডে ২২৬টি দোকান পুড়ে গেছে। মার্কেটের মালিক সমিতি বলছে, আগুনে ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শটসার্কিট) থেকে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লাগে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার ও নিয়মিত তদারকি না করায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে এই অগ্নিকাণ্ড ঘটছে বলে তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে তারা।

এদিকে ২০২৩ সালে ফায়ার সার্ভিস তাদের এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দেশে আগুন লাগার বড় কারণ বৈদ্যুতিক গোলযোগ। ২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিদুর্ঘটনার ৩৮ শতাংশ ক্ষেত্রে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। এছাড়াও ফায়ার সার্ভিস অগ্নিদুর্ঘটনার আরও কিছু কারণ খুঁজে পেয়েছে।

সর্বশেষ এসব ঘটনার ক্ষত কাটতে না কাটতে নতুন আরেকটি ট্র্যাজেডি দেখতে হয়েছে দেশবাসীকে। চলতি বছরের গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের ‘গ্রিন কোজি কটেজ’ বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত সূত্র থেকে জানা গেছ, ভবনটিতে যে অগ্নিনিরাপত্তা থাকার কথা, তার ন্যূনতম ব্যবস্থাও ছিল না। ভবনটিতে ছিল প্রচুর দাহ্য পদার্থ। শুধু গ্রিন কোজি কটেজ ভবনই নয়, অগ্নিকাণ্ডের পর অধিকাংশ ভবন তদন্ত রিপোর্টেই ফায়ার সার্ভিসের সুপারিশ না মানা, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা না থাকার চিত্র উঠে এসেছে।

বেইলি রোডে আগুন (ফাইল ছবি)

অগ্নিকাণ্ডের তদন্ত কমিটি নিয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাজাহান শিকদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সাধারণত বড় কোনও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে এর জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয় এবং সে বিষয়ে গণমাধ্যমকে জানানো হয়। এছাড়া অন্যান্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তদন্তের স্বার্থে অনেক ক্ষেত্র তা প্রকাশ করা হয় না। যদি কারও একান্ত প্রয়োজনে তদন্ত কমিটি বিষয়ে জানতে হয়, তাহলে তাকে নির্দিষ্ট ফি জমা দিয়ে তথ্য কমিশনারের বরাবর দরখাস্ত করতে হবে বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা।

ফায়ার এবং দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ মেজর এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে শুরুতেই নিয়মের বাইরে গিয়ে অনেকে ভবনের নকশা তৈরি করেন। দেখা গেছে, একজন স্থপতি বাংলাদেশের ভবন কোড না মেনেই ভবনের নকশা তৈরি করেন। এমনকি ফায়ার সার্ভিসের অনুমতির বিষয়টিও আমলে নেয় না। সেসব ভুল নকশা ভবনে বাস্তবায়ন করছে। বর্তমান একটি ভবন নির্মাণ করতে যদি ৩০ কোটি টাকা খরচ হয় সেই ভবনটির ভেতরে সাজসজ্জা করতে আরও ৫ কোটি টাকা খরচ করে। সাজসজ্জার জন্য যেসব জিনিস ব্যবহার করা হয় তার অধিকাংশই দাহ্য পদার্থ। নিম্নমানের বৈদ্যুতিক তার, কেবল ব্যবহার, কাঠের বদলে পারটেক্স ব্যবহার, অ্যালুমিনিয়াম ও মেলামাইন এসব সবই দাহ্য পদার্থ। আধুনিকভাবে যে রান্নাঘর তৈরি করা হচ্ছে সেখানেও চারদিকে দাহ্য পদার্থ দিয়ে সাজানো হচ্ছে। ফলে এসব ভবনে যখনই আগুন লাগে মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো এতো দাহ্য পদার্থ রেখেও আমরা অগ্নিনির্বাপণের কোনও ব্যবস্থা রাখছি না। রাখলেও সেটা ব্যবহার করছি না, ব্যবহার করাও শিখছি না।’

তিনি আরও বলেন, ‘একটি ভবন থেকে আরেকটি ভবন তৈরি করতে যে দূরত্ব রাখার কথা, সেটা আমরা রাখছি না। আগে ভবনের ভেতরে বিভিন্ন কাঠ ব্যবহার করা হতো। কাঠ পুড়লে যে ধোঁয়া বের হয়, সেটা হয় সাদা। এ ধোঁয়া দিয়ে এতো দ্রুত লোকজন আহত হতো না। তবে পারটেক্স, অ্যালুমিনিয়াম ও মেলামাইন এসব যখন পুড়ে তখন বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। এ ধোঁয়ার ফলে মানুষের মুহূর্তে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছে। এই বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে অনেক মানুষ মারা গেছেন। এসব কারণেই বাংলাদেশে প্রতি বছরেই অগ্নিকাণ্ডের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।’

/ইউএস/
সম্পর্কিত
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষ খবর
বেসিস নির্বাচন: দেশের সফটওয়্যার খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চান ইকবাল আহমেদ
বেসিস নির্বাচন: দেশের সফটওয়্যার খাতকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চান ইকবাল আহমেদ
টি স্পোর্টসে বাংলাদেশ-ভারত টি-টোয়েন্টি সিরিজ
টি স্পোর্টসে বাংলাদেশ-ভারত টি-টোয়েন্টি সিরিজ
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্মেলন
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ব্যবসায়িক সম্মেলন
পড়ে থাকা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মা ও ২ শিশুসন্তানের মৃত্যু
পড়ে থাকা তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে মা ও ২ শিশুসন্তানের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই