অভাবের তাড়নায় ১৯৮৭ সালে জামালপুর থেকে ঢাকায় এসেছিলেন আবুল কালাম। রিকশা চালিয়ে জীবনযুদ্ধের হাল ধরেন তিনি। বিন্দু বিন্দু করে জমিয়েছিলেন ঘরের আসবাসপত্র। এক রাতের আগুনে পুড়ে যায় কালামের ৩৫ বছর ধরে গড়ে তোলা সহায়-সম্পদ। গত বছরের ১৩ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের কুনিপাড়া বস্তিতে লাগা আগুনে আবুল কালামের মতো তিন শতাধিক পরিবারের ঘর পুরে ছাই হয়ে যায়।
আবুল কালাম বলেন, ‘যুবককালে ঢাকা আসছি, এখন বুড়া হইয়া গেছি। এক রাতের আগুনে আমার সব পুইড়া গেছে। অনেক কষ্ট কইরা একটা স্টিলের আলমারি ও খাট কিনেছিলাম। এই জীবনে তা আর করতে পারমু না।’
২০২৩ সালের ১৩ মার্চ রাত পৌনে ৮টার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের কুনিপাড়া এলাকার এই ঘনবসতির বস্তিতে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিটের প্রায় আড়াই ঘণ্টা চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে ৬টি প্লটের ৩০০টিরও বেশি বাড়ি পুড়ে যায়। এলাকাটি ‘রোলিং মেইল বস্তি’ নামেও পরিচিত। সেখানে পোশাকশ্রমিক, রিকশাচালক, রাজমিস্ত্রি, হকারসহ নিম্ন আয়ের মানুষ বসবাস করেন। টিন ও কাঠের তৈরি বস্তির প্রতিটি ঘরবাড়ি দোতলা, তিন তলা ও চার তলা। অগ্নিঝুঁকির মধ্যেই যেন এখানকার মানুষের বসবাস।
গত ২৫ মে কুনিপাড়া রোলিং মেইল বস্তি সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, চারপাশে শিল্প প্লটের মাঝখানে কুনিপাড়া রোলিং মেইল বস্তিটি গড়ে উঠেছে। দাঁড়িয়ে আছে কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি অর্ধশতাধিক দোতলা, তিন তলা ও চার তলা বাড়ি। প্রতিটি বাড়িতে ৫০টিরও বেশি ছোট ছোট কক্ষ। এসব কক্ষে নিম্ন আয়ের মানুষেরা বাস করেন।
তেজগাঁও শিল্প এলাকার কুনিপাড়ার ২২/৫-জি-২ নম্বর প্লটে ছয়টি বাড়ি রয়েছে। গত বছরের আগুনে এই ছয়টি বাড়ির ৩৩৩টি কক্ষের সবগুলোই পুড়ে যায়। এরপর এই প্লটে নতুন করে ইট-সিমেন্ট ও টিন দিয়ে তিন তলা একটি বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। অন্য বাড়িগুলোরও নির্মাণকাজ চলছে। তবে কোনও বাড়িতেই নেই অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা।
ভয়াবহ ওই আগুনের বর্ণনা দিয়ে একটি বাড়ির ম্যানেজার শাকিল বলেন, মাঝখানের একটি বাড়ির তিন তলায় ইলেকট্রিক শর্টসার্কিট থেকে আগুন লেগেছিল। ১০ মিনিটের মধ্যে পাশাপাশি থাকা সবগুলো বাড়িতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। চোখের সামনে এতগুলো ঘর পুরে ছাই হয়ে যায়।
সাত বছরের গোছানো সংসার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে– এই আক্ষেপ করে জেসমিন আক্তার বলেন, আমার স্বামী গার্মেন্টে চাকরি করেন। এক মেয়ে নিয়ে আমরা এখানে থাকি। গত সাত বছর ধরে জামাকাপড়সহ যা কিছু জমাইছিলাম, আগুন আমাদের সব কেড়ে নিছে। সাত বছরের গোছানো সংসার কি এক বছরে হবে!
রিকশাচালক মো. মকল মিয়া বলেন, আমরা গরিব মানুষ। আমাগো ঘরে আর কী থাকবো! তারপরও অনেক শখের কিছু জিনিসপত্র তৈরি করছিলাম। সব পুইড়া গেলো।
সিফাত নামে এক কিশোর জানায়, আমরা দুই ভাই ও বাবা-মা এখানে থাকি। আগুন লাগার দিন সকালে আমরা একটা নতুন ফ্রিজ ও টিভি কিনছিলাম। ওই আনন্দে অনেক বাজারও করছিলাম। মাছ-মাংস কিছুই খাইতে পারি নাই। এখন আমাগো দুই বেলা খাইতেই কষ্ট হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. শফিউল্লাহ শফি বলেন, ভবন কেমন থাকবে, কীভাবে নির্মাণ করা হবে— এটা রাজউকের দেখভালের বিষয়। এ বিষয়ে সিটি করপোরেশনের কোনও এখতিয়ার নেই। তবে আমরা ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলে এলাকাবাসীর জন্য ফায়ার মহড়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারি— যাতে করে কোনও দুর্যোগ বা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তারা প্রাইমারি ব্যবস্থা নিতে পারে। ভবন মালিকদের ফায়ার এক্সটিংগুইশার যন্ত্র কেনার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হবে।
ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকার বেশিরভাগ বাড়ি অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকিতে রয়েছে। কেননা এসব বাড়ি নির্মাণে ফায়ারের কোনও নিয়মনীতি মানা হচ্ছে না। ঘনবসতি বা বস্তি এলাকায় মানুষ অগ্নিঝুঁকির মধ্যেই বসবাস করছে। এসব এলাকায় ন্যূনতম কোনও ফায়ার সেফটি নেই। বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে দ্রুত অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের তাগিত দেন এই কর্মকর্তা।