বাহাদুর শিকদারের বয়স এখন ৭৫ বছর। ১৩ বছর বয়সে পরিবারের কাউকে না জানিয়ে পালিয়ে ঢাকা এসেছিলেন। প্রথমে কাওরান বাজারে সবজি বিক্রি শুরু করেছিলেন। পরে সেই ব্যবসা বদল করে ঝিলপাড়ে গড়ে তোলেন মাছের আড়ত। ব্যবসা ভালো হতে থাকলে বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে ঝিলের কাছে সোনারগাঁও বস্তিতে বসবাস শুরু করেন। ৯০ দশকে ঝিলপাড়ের বস্তি ভেঙে ফেলে সরকার। তিনি একসঙ্গে বাসস্থান ও মাছের আড়ত দুটোই হারান। এ ঘটনার পর স্ট্রোক করায় বাহাদুর শিকদারের এক হাত ও পা অচল হয়ে যায়। তিনি কর্মহীন হয়ে পড়েন। পরে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে স্ত্রী রুমা খাতুন (৫০) ও দুই মেয়েকে নিয়ে মোল্লাবাড়ি বস্তিতে আশ্রয় নেন। গত ১৩ জানুয়ারি মধ্যরাতে এই বস্তিতে আগুনের ঘটনায় আবারও সব সম্বল হারান বাহাদুর শিকদার। এরপর পরিবার নিয়ে আশ্রয়ে নেন কাওরান বাজার বস্তির পাশে, রেললাইনঘেঁষা খোলা আকাশের নিচে।
বাহাদুর শিকদার বলেন, ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়েছে আমার সংগ্রাম। মাঝ বয়সে জীবনে সফলতা দেখা দিয়েছিল। তবে সেই সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। শূন্য হাতে ঢাকায় এসেছিলাম। শেষ বয়সেও শূন্য হাতেই রয়ে গেলাম। এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকি। এ বয়সে আর কিছু করাও সম্ভব না। আমার স্ত্রী মানুষের বাড়িতে কাজ করে। সে যা পায় তা দিয়েই আমাদের জীবন কাটছে।
একই রকম কষ্টের গল্প শোনালেন বস্তির আরেক বাসিন্দা রাবিয়া বেগম (৫০)। ষাটোর্ধ্ব স্বামীকে নিয়ে তিনিও খোলা আকাশের নিচে ঠাঁই নিয়েছেন। ৪০ বছর আগে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ি থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। কিছু দিন পর হাসু মিয়ার সঙ্গে তার বিয়ে হয়। এরপর থেকে কাওরান বাজার এলাকায় বসবাস। ৩০ বছর ধরে কাওরান বাজারের মোল্লাবাড়ি বস্তির বাসিন্দা তারা। এই বস্তিতেই তাদের দুই সন্তানের জন্ম হয়েছে। ধীরে ধীরে সাজিয়েছিলেন সংসার। এক ঘণ্টার আগুনে পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে তাদের সবকিছু।
রাবিয়া বেগম বলেন, আমাদের সব শেষ। এখন যাওয়ার কোনও জায়গা নেই। যদি থাকতো, তাহলে কি এত কষ্ট করে এখানে পড়ে থাকতাম? এখন এখানেও থাকতে দিচ্ছে না। পুলিশ চলে যেতে বলে। পায়ে-হাতে ধরে আছি। এখানে রাস্তার কাজ চলছে, কাজ শেষ হলে কি আর থাকতে দেবে? হয়তো দেবে না। তখন কোথায় যাবো?
ডুকরে কেঁদে কেঁদে রাবিয়া বলেন, আমার ঘরে দুই লাখ টাকার মালামাল ছিল। কিছুই বের করতে পারিনি। শূন্য হাতে বের হয়েছি। এখন পর্যন্ত তেমন কোনও সাহায্য-সহযোগিতা পাইনি। আমার দুই ছেলে রিকশা চালায়। তারা নিজেদের সংসার গড়েছে। আমাদের খোঁজ নেওয়ার সময় তাদের নেই। বর্তমানে আমার স্বামীও অসুস্থ। আমি কাওরান বাজারে সবজি টোকাই। তা দিয়ে কোনোভাবে চলি।
মোল্লাবস্তির আগুনে নিঃস্ব হয়েছেন তাসলিমা বেগম (৪০)। তিনি জন্ম থেকেই অন্ধ। দীর্ঘদিন ধরে সপরিবার বাস করছিলেন এই বস্তিতে। আগুনে সব হারিয়ে পথে বসেছে তাসলিমার পরিবারও।
তাসলিমা বলেন, বস্তিতে দুই কক্ষের বাসা নিয়ে থাকতাম। আমাদের ঘরে অনেক জিনিসপত্র ছিল। সবই আগুনে পুড়ে গেছে। এখন প্রাণটা নিয়ে কোনোভাবে বেঁচে আছি। আমার স্বামী অল্প বেতনে একটি মাদ্রাসায় চাকরি করেন। আমাদের আট সদস্যের পরিবার। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে রেললাইনের পাশে খোলা আকাশের নিচে থাকছি। সারাক্ষণ ভয়ে থাকি। আমার ছোট ছেলেমেয়ে, সঙ্গে বৃদ্ধা মা-ও আছেন।
অগ্নিকাণ্ডের সেই অভিশপ্ত রাত
এখনও সেই ঘটনা তাড়া করে ফিরে আল-আমিনকে। কাওরান বাজারে মাছ কাটার কাজ করেন তিনি। কাজ শেষে বাসায় এসে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। তিনি জানান, হঠাৎ শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। বের হয়ে দেখতে পাই বস্তিতে আগুন জ্বলছে। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজের ঘরেও আগুন ধরে যায়। নিমেষে শেষ হয় যায় সব। আল-আমিনের স্ত্রী খাদিজা বেগম বলেন, বস্তিতে আমাদের বাসাটি ছিল দুই কক্ষের। একটু একটু ঘরটা সাজিয়ে ছিলাম। চোখের সামনে সব পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। প্রায় চার লাখ টাকার মাল ছিল। সব হারিয়ে ছোট দুটি মেয়েকে নিয়ে আজ পথে পথে ঘুরছি।
কাওরান বাজারের অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মোল্লাবাড়ি বস্তিতে গত বৃহস্পতিবার (১৬ মে) সরেজমিনে দেখা যায়, শত শত বস্তিবাসী মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
১৩ জানুয়ারি রাতে মোল্লাবাড়ি বস্তিতে আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে এসে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘অগ্নিকাণ্ডে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা নিম্নবিত্ত পরিবারের। সবাই কাওরান বাজারে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পেশার সঙ্গে জড়িত। আগুনের ভয়াবহতায় তারা বের হওয়ার রাস্তা পাননি। তাই ক্ষতির পরিমাণটাও বেশি। অগ্নিকাণ্ডের কারণ খোঁজার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অসতর্কতা নাকি বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে আগুন লেগেছে, সেটা ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসবে। এ ছাড়া এই বস্তির মালিকানা নিয়ে আমরা জানার চেষ্টা করছি।’
ওই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছিল ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বস্তিতে অল্প জায়গায় অনেক লোকজন বসবাস করে। আর এসব ছোট জায়গায় অনিয়ম হয় বেশি। রাজধানীতে যত বস্তিতে আগুন লেগেছে, প্রাথমিক তদন্তে একই ধরনের কারণ পাওয়া গেছে। সেটা হলো বৈদ্যুতিক গোলযোগ। আমরা তদন্ত করে দেখেছি। বস্তির বাসিন্দারা এলোমেলোভাবে বৈদ্যুতিক তার ব্যবহার করে। একটার ওপর দিয়ে অনেক তার ব্যবহার করে। সিলিন্ডারের ওপর গ্যাসের চুলা বসিয়ে রান্না করে। নিম্নমানের মাল্টিপ্লাগ ব্যবহার করে। বেশিরভাগ বস্তিবাসীই এসব কাজ করে।
তেজগাঁওয়ে বিএফডিসির পাশে মোল্লাবাড়ি বস্তির অবস্থান। ১৩ জানুয়ারির আগুনে দগ্ধ হয়ে দুজন মারা যান। এছাড়া আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন। ভয়াবহ এ আগুনে বস্তির ৩০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর তারা আশ্রয় নেন রেললাইনের পাশে ঝিলপাড়ে। খোলা আকাশের নিচে। নতুন করে ঘরসংসার শুরুর স্বপ্ন দেখলেও কোথায় কীভাবে সেটা হবে, তা জানা নেই তাদের কারোরই।