জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দেশে তরুণদের রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা চলছে। তবে এ বিষয়ে তরুণদের মতামত স্পষ্ট— তারা নতুন রাজনৈতিক দলের চেয়ে বিদ্যমান দলগুলোর সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
গত ২৭ জানুয়ারি বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টার (বিওয়াইএলসি) প্রকাশিত ‘ইয়ুথ ম্যাটার্স সার্ভে’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে আসে। সারা দেশে সর্বমোট ১ হাজার ৫৭৫ জন সরাসরি ও অনলাইনে ১ হাজার ৬৬৩ জন তরুণ এ জরিপে অংশ নেন। গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বর মাস জুড়ে এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, তরুণদের বড় অংশ দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের সরিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের পক্ষে। সরাসরি জরিপে ৪০ দশমিক ৪ শতাংশ এবং অনলাইন জরিপে ৪৪ শতাংশ তরুণ এ মত দিয়েছেন। একই সঙ্গে, দলগুলোর মধ্যে তরুণ নেতৃত্ব বাড়ানোর পক্ষে সরাসরি ৩০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অনলাইনে ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ মতামত দিয়েছেন।
অন্যদিকে, নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের পক্ষে সরাসরি ২৮ দশমিক ৪ শতাংশ এবং অনলাইনে ২৫ শতাংশ তরুণ মত দিয়েছেন।
রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি জোরালো
জরিপের ফলাফলে তরুণদের মাঝে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে অন্তত ১ থেকে ৩ বছর রাষ্ট্র পরিচালনার পক্ষে সরাসরি ৪১ দশমিক ৪ শতাংশ এবং অনলাইনে ৫০ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণ মত দিয়েছেন।
তবে দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকবে কী না, সে বিষয়ে নিশ্চিত নন বলে জানিয়েছেন সরাসরি ২০ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অনলাইনে ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ।
ভোটের প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে
আগামী নির্বাচনে ভোট দেওয়ার বিষয়ে তরুণদের আগ্রহ বেড়েছে। ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী তরুণদের মধ্যে ৯৫ দশমিক ৫ শতাংশ (সরাসরি জরিপ) এবং ৯৫ দশমিক ৭ শতাংশ (অনলাইন জরিপ) ভোট দেওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন।
নারীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ
জরিপে অংশ নেওয়া ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ (সরাসরি) এবং ৭০ শতাংশ তরুণ (অনলাইন) মনে করেন, বর্তমান বাংলাদেশে নারী ও মেয়েরা নিরাপদবোধ করছেন না।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কে তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৫ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ (সরাসরি) এবং ৭৩ দশমিক ১ শতাংশ তরুণ (অনলাইন) মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব তরুণদের ওপর সরাসরি পড়ছে।
শিক্ষার মান উন্নয়ন জরুরি
তরুণরা শিক্ষার মান উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। সরাসরি ৭১ শতাংশ এবং অনলাইনে ৮৬ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ মনে করেন, ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি শিক্ষার স্বাধীন পরিবেশ বজায় রাখার অন্তরায়। এছাড়া, সরাসরি ৭৭ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা চাকরির জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা দেয় বলে মনে করলেও অনলাইনে ৭৯ দশমিক ৩ শতাংশ তরুণ একমত নন।
উদ্যোক্তা হওয়ার আগ্রহ বাড়ছে
জীবিকার মাধ্যম হিসেবে তরুণদের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৫২ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ (সরাসরি) এবং ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ (অনলাইন) ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হতে চান।
সংস্কারের পক্ষে তরুণদের মতামত
বিওয়াইএলসির নির্বাহী পরিচালক তাহসিনা আহমেদ বলেন, ‘এই সমীক্ষা দেখিয়েছে যে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুবসমাজ সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। তারা দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অবসান চায় এবং নাগরিকদের— বিশেষ করে নারীদের—নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করার দাবি জানায়। তরুণরা মুক্তভাবে কথা বলার পরিবেশ এবং দেশের উন্নয়ন ব্যবস্থায় সক্রিয় অংশগ্রহণের সুযোগ চায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘তরুণরা মনে করে, সংস্কার কার্যকর করতে সরকারকে সময় দিতে হবে এবং তারা রাষ্ট্র সংস্কারে একসঙ্গে কাজ করতে চায়। যদিও কিছু তরুণ নতুন রাজনৈতিক দল চায়, বেশিরভাগই বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তারা চায় রাজনীতিতে ভালো মানুষ প্রার্থী হোক।’
তরুণদের প্রত্যাশা স্পষ্ট
জরিপের বিষয়ে তরুণ নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনায় থাকা নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘যারা বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার চান, তারা স্পষ্টভাবেই একটি পরিবর্তিত রাজনৈতিক কাঠামো দেখতে চান। অর্থাৎ, সংস্কারের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলোর যে নতুন চেহারা দাঁড়াবে, তরুণরা সেটাই প্রত্যাশা করে।’
তিনি বলেন, ‘তরুণরা পরিবর্তন চায়। বর্তমান সরকারের অনেক দুর্বলতা থাকলেও সাধারণ মানুষ ও তরুণরা এখনও সময় দিচ্ছে, কারণ তারা বিশ্বাস করে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট। এত সংগ্রাম ও রক্তদানের পর তরুণরা পুরোনো ব্যবস্থায় ফিরতে চায় না। তারা অন্তত কিছু মৌলিক পরিবর্তন চায়।’
নতুন রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি তরুণদের আগ্রহের কথা জানিয়ে সারোয়ার তুষার বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব জরিপে দেখা গেছে, তরুণরা সত্যিকার অর্থেই নতুন রাজনৈতিক দল চায়। তবে তারা পুরোনো রাজনীতির দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও স্বার্থপরতার সংস্কৃতি চান না। তারা এমন একটি দল চান, যা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে, দুর্নীতি মুক্ত থাকবে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করবে এবং সবসময় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াবে।’