হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলায় দখল দূষণ ও অবৈধ বালু উত্তোলনে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে কুশিয়ারা ও শাখা বরাক নদী। দেশে পটপরিবর্তনের পর স্থানীয় বিএনপি-যুবদলের কয়েকজন নেতার ওপর ভর করে আওয়ামী লীগ নেতারাই কুশিয়ারা নদী থেকে টানা অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। ফলে হুমকির মুখে রয়েছে কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরে অবস্থিত প্রতিরক্ষা বাঁধসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। অন্যদিকে শাখা বরাক নদীতে প্রতিদিন ফেলা হচ্ছে শহরের সব ময়লা-আর্বজনা।
দেশের নদ-নদীর চিত্র যখন এমন, সেসময় শুক্রবার (১৪ মার্চ) পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস। ১৯৯৮ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলের কুরিতিয়া শহরে অনুষ্ঠিত একটি আন্তর্জাতিক সমাবেশ থেকে আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নদীর প্রতি মানুষের করণীয়, নদী রক্ষায় দায়িত্ব, মানুষের দায়বদ্ধতা কতটুকু—এসব বিষয় স্মরণ করিয়ে দিতে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দিবসটির প্রাক্কালে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নবীগঞ্জ উপজেলার আউশকান্দি ও দীঘলবাক ইউনিয়নে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী কসবা, দুর্গাপুর, পাহাড়পুর, পারকুল, শেরপুর বাজারের নিকটবর্তী স্থানসহ কয়েকটি জায়গা থেকে দীর্ঘদিন ধরে ড্রেজার মেশিন বসিয়ে অবৈধভাবে তোলা হচ্ছে বালু। উত্তোলনকৃত বালু চড়া দামে ট্রাকপ্রতি বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে। প্রতি ট্রাক বালু বিক্রি হচ্ছে ৬৫০০ থেকে ৮৫০০ হাজার টাকা দরে।
স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে কুশিয়ারা নদীতে ড্রেজার বসিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে আসছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য আব্দুল মতিন আছাব, রনি, দুলালসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্র। দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর নবীগঞ্জ বিএনপির এক সাবেক জনপ্রতিনিধি ও যুবদলের কয়েকজন নেতার ওপর ভর করে আওয়ামী লীগের নেতারাই ঘুরেফিরে কুশিয়ারা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন নিয়ন্ত্রণ করছেন। কুশিয়ারা নদীর নবীগঞ্জ উপজেলার অংশ থেকে দিনদুপুরে অবৈধ বালু উত্তোলন করলেও প্রশাসন কার্যকর কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা। অন্যদিকে কুশিয়ারা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে প্রতিনিয়ত কুশিয়ারা নদীর বিভিন্ন অংশে ভাঙন দেখা দিচ্ছে। ফলে হুমকির মুখে রয়েছে কুশিয়ারা নদীর উভয় তীরে নির্মাণাধীন প্রতিরক্ষা বাঁধসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
অন্যদিকে এক সময়ের উত্তাল স্রোতের বরাক নদী কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। নদীপথ ফিরে পেতে বিভিন্ন সময়ে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেও সুফল মিলছে না এলাকাবাসীর। রাঘববোয়ালদের দখলে রয়েছে বরাক নদীর চরাঞ্চল। দখল ও দূষণের ফলে শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কপথগুলো বর্ষা মৌসুমে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। সামান্য বৃষ্টিতেই শহরের সড়কগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায়। এতে সড়কগুলো অকালেই ভেঙে পড়ে। এ নিয়ে পৌর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগও রয়েছে। যদিও চলতি বছরে পৌর কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে ড্রেন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, নবীগঞ্জ শেরপুর সড়কের ১নং ব্রিজের নিচ দিয়ে যে খালটি শিবপাশা ঠাকুরপাড়ার ভেতর প্রবাহিত হয়ে নোয়াপাড়া-শাখা বরাক নদীতে মিলিত হয়েছে, এই স্থানের অনেকটাই এখন দখলদারদের কবলে বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় শত কোটি টাকার ডিসির খতিয়ানভুক্ত খাস ভূমি দখল নিয়ে প্রশাসনের ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ঐতিহ্যবাহী শাখা বরাক নদীটি কালের আবর্তে দখলদারদের কবলে পড়ে একটি নালায় পরিণত হয়েছে। এসব দেখার কেউই নেই। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ প্রয়োজন। শহরের সেই পরিবেশ এখন হুমকির মুখে।
২০২০ সালের ২ মার্চ নবীগঞ্জের শাখা বরাক নদী সচল ও প্রবহমান রাখতে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেয় হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন। তৎকালীন জেলা প্রশাসক কামরুল হাসানের নির্দেশে নবীগঞ্জ উপজেলার শাখা বরাক নদী থেকে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন, করা হয় অবৈধ স্থাপনার তালিকা প্রণয়ন। নবীগঞ্জের শাখা বরাক নদীর ১০১টি স্থাপনা উচ্ছেদ করার সিদ্ধান্ত হয়। আশার আলো জ্বলে নবীগঞ্জবাসীর মনে। আনন্দের জোয়ার দেখা যায় প্রকৃতিপ্রেমীদের মাঝে। জেলা প্রশাসনের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানান নবীগঞ্জবাসী।
সেসময় অনেকেই মনে করেছিলেন হয়তো হারানো যৌবন ফিরে পাবে শাখা বরাক। ওই সময় পানি উন্নয়ন বোর্ড, নবীগঞ্জ ভূমি অফিস ও পৌরসভার সার্ভেয়াররা সরেজমিনে দখলদারদের নাম তালিকাভুক্ত করে বিভিন্ন বাসা-মার্কেটে লাল রঙ দ্বারা চিহ্নিত করেন। পরে প্রশাসন অভিযান করে বেশ কিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করেন। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বাড়ায় অভিযান শুরুর কিছুদিন পরই বন্ধ হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত নদী সচল ও প্রবহমান রাখতে আর কোন কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়নি।
বর্তমানে শাখা বরাক নদীতে ফেলা হচ্ছে শহরের সকল ময়লা-আবর্জনা। বর্তমানে ডাকবাংলোর সামনে, সবজি বাজারের পেছনে, নোয়াপাড়া পয়েন্টে, শিবপাশা ব্রিজের নিকটে ও হাসপাতাল সংলগ্ন শাখা বরাকে ফেলা হচ্ছে এসব ময়লা। এতে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ, বাড়ছে দূষণ ছড়িয়ে পড়ছে রোগব্যাধি। কিন্তু নাকওলা জনপ্রতিনিধি বা সংশ্লিষ্ট কারও নাকেই যেন এই পচা গন্ধ লাগছে না। যদিও স্থানীয়দের অভিযোগ তারা দামি গাড়ি দিয়ে দাপিয়ে বেড়ান, তাই গাড়ির ভেতর দিয়ে গন্ধ তাদের নাকে পৌঁছায় না।
রিভার উইনসের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কীর্তিনারায়ণ কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ফয়জুর রব পনি বলেন, ‘আমাদের নবীগঞ্জ শহরের প্রাণ, শহরের অস্তিত্ব শাখা বরাক নদী বছরের পর বছর ধরে চলা দূষণ আর দখলে আজ বিলীন প্রায়। কয়েক বছর ধরে ব্যাপক হারে দূষিত হচ্ছে, এই দূষিত হওয়ার পেছনে যে প্রতিষ্ঠানকে সবাই দায়ী করছে, সেটা হচ্ছে আমাদের পৌর প্রশাসন। তারা পৌর শহরের ময়লা সংগ্রহ করে তা এই নদীর ওপর ময়লার ভাগাড় বানিয়েছে। বর্তমানে আমাদের সহজ সরল দাবি, নদীতে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে, পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যে ময়লা ফেলে ভাগাড় করা হয়েছে সেটা পরিষ্কার করতে হবে। আমি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে পৌরসভার মেয়রের প্রতি আকুল আবেদন জানাই, আপনারা দয়া করে এই নদীকে আর অত্যাচার করবেন না।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জ শাখার সাধারণ সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য তোফাজ্জল সোহেল বলেন, ‘কুশিয়ারা নদী থেকে তোলা হচ্ছে অবৈধ বালু। অন্যদিকে শাখা বরাক নদী করা হয়েছে দখল, বরাকে প্রতিনিয়ত ফেলা হচ্ছে ময়লা-আবর্জনা। দীর্ঘদিন ধরে কুশিয়ারা নদী থেকে অবৈধ বালু উত্তোলন নিয়ে সরব প্রতিবাদ করে এলেও প্রশাসন কার্যত কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ হুমকির মুখে পড়েছে। অতি দ্রুত কুশিয়ারা নদীর বালু উত্তোলন বন্ধে ও শাখা বরাক নদীর অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণসহ শাখা বরাক নদী থেকে ময়লার ভাগাড় অপসারণ করে নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি।‘
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন জানান, কুশিয়ারা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, কোনোভাবেই কুশিয়ারা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করতে দেওয়া হবে না।