X
সোমবার, ০৭ জুলাই ২০২৫
২২ আষাঢ় ১৪৩২

কিছুতেই থামছে না গণপিটুনি, বাড়ছে হত্যাকাণ্ড

কবির হোসেন
০৬ জুলাই ২০২৫, ২২:৪৮আপডেট : ০৬ জুলাই ২০২৫, ২৩:০৫

গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশে যখন আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে ঠিক তখনই দুর্বৃত্ত ও পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। এ সময় গণপিটুনি দিয়ে মানুষ হত্যা, ছিনতাই, চুরি ও ডাকাতির মতো ঘটনা বেড়ে গিয়েছিল। তবে তখন অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্থাগুলো এসব দুর্বৃত্তায়ন কঠোর হাতে দমনের হুঁশিয়ারি দেয় এবং সে সময় এদের বিরুদ্ধে বড় অভিযানও পরিচালনা করতে দেখা গেছে।

বিশেষ করে সম্প্রতি মানুষকে লাঞ্ছিত করা, হয়রানি, গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলা— এসবের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন মহল সোচ্চার হতে দেখা গেছে এবং তারা কড়া ভাষায় এর প্রতিবাদ জানিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে এসব বিষয়ে বারবার হুঁশিয়ারি এলেও অনেকে কোনও তোয়াক্কাই করছেন না। ফলে এখনও গণপিটুনি দিয়ে মানুষকে মেরা ফেলার মতো ঘটনা ঘটছে। বর্তমানে এ বিষয়গুলো যেমন উদ্বেগ বাড়িয়েছে তেমনি মানুষের নিরাপত্তা নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা।

এসব বিষয়ে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এখনও দৃশ্যমান কোনও কঠোর পদক্ষেপ দেখছেন না সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক অস্থিরতা ও একটি অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ— এ পরিস্থিতি দুর্বৃত্তদের উৎসাহিত করছে।

এমন উদ্বেগের মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকালে কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার আকবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে গণপিটুনিতে দুই নারীসহ তিন জন নিহতের ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এ ঘটনার তিন-চার দিন আগে একটি মোবাইল চুরিকে কেন্দ্র করে রুবি আক্তারের পরিবারের সঙ্গে স্থানীয়দের ঝগড়া হয়। সে সময় রুবি ও তার ছেলে বেশ কয়েকজনকে মারধর করেন। এ ঘটনার জের ধরেই কড়ইবাড়ি গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে রুবির বাড়িতে হামলা করে। ওই পরিবারের চার জনকে বেদম মারধর করে। এ সময় ঘটনাস্থলেই রুবি, তার মেয়ে জোনাকি ও ছেলে রাসেল নিহত হয়। রুবির অপর মেয়ে রুমাকে পুলিশ গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়।

এর আগে বুধবার (২ জুলাই) যশোরের ঝিকরগাছায় হাজিরবাগ ইউনিয়নের সোনাকুড় গ্রামে জহর আলী (৪০) নামে এক ব্যক্তিকে কুপিয়ে জখম করার অভিযোগ উঠে রফিকুল ইসলাম (৫০) নামে একজনের বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় উত্তেজিত জনতা রফিকুল ইসলামকে দড়ি দিয়ে বেঁধে গণপিটুনি দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
তার আগে, গত ২৯ জুন গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে ছয় বছর বয়সী শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে হাবিল মিয়া নামে ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তি গণপিটুনিতে নিহত হন। একই দিন কক্সবাজারের রামুতে এক তরুণীকে ধর্ষণচেষ্টা ও ছুরিকাঘাতের অভিযোগে স্থানীয়দের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ও গণপিটুনিতে আবদুল মান্নান (২৬) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন।

এসব ঘটনা ছাড়াও সম্প্রতি মানুষকে লাঞ্ছিত করা, হয়রানি, গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলার মতো আরও বহু ঘটনা সামনে এসেছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, গত ১০ মাসে দেশের আট বিভাগে ১৭৪ জনকে এভাবে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, কোথাও চোর, ছিনতাইকারী-চাঁদাবাজ এবং কোথাও ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের সহযোগী ও দোসর অপবাদ দিয়ে এসব মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

নিহতদের মধ্যে অনেকের বিরুদ্ধে মামলাও ছিল না। আসকের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ৩১ মে পর্যন্ত পিটিয়ে ও কুপিয়ে ১৭৪ জনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে ঢাকায় ৮০ জন, চট্টগ্রামে ২৮, বরিশাল ও রাজশাহীতে ১৬ জন করে, খুলনায় ১৪, রংপুরে ৭, ময়মনসিংহে ৬ এবং সিলেটে ৫ জনকে হত্যা করা হয়।

এই সময় প্রতি মাস হিসেবে দেখা যায়, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ২১ জন, সেপ্টেম্বরে ২৮, অক্টোবরে ১৯, নভেম্বরে ১৪ ও ডিসেম্বরে ১৪ জন নিহত হন। এছাড়া চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১১, মার্চে ২০, এপ্রিলে ১৮ ও মে মাসে ১৩ জন গণপিটুনিতে নিহত হন।

এছাড়া এসব ঘটনায় সর্বশেষ গত জুন মাসে ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট হত্যার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮৫ জনে। দেখা গেছে, এসব ঘটনায় সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে গত বছরের সেপ্টেম্বরে। ওই মাসে ২৮ জনকে হত্যা করা হয়।

এ প্রসঙ্গে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী কমিটির সদস্য ও মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একটা বিশেষ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করছে। রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগের অবস্থায় ফিরেছে, এটা বলার সুযোগ নেই। আবার সরকার পক্ষ থেকে এসব দুর্বৃত্তপনা বন্ধে যে ভূমিকা সেটাও দৃশ্যমান না। ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অস্থিরতা, একটা অনিশ্চিত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ— যারা এ ধরনের কর্মকাণ্ড করে এসব দুর্বৃত্তদের উৎসাহিত করছে। যেহেতু দৃশ্যমান কঠিন কোনও পদক্ষেপ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নেওয়া হচ্ছে না, ফলে এর থেকে বের হয়ে যেতে হলে অবশ্যই সরকারকে কঠিন ও কঠোর বার্তায় যেতে হবে। দৃশ্যমান কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই এখান থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করা সম্ভব হবে।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পাঁচ আগস্টের পরে সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি বলেই সমাজে গণপিটুনির মতো সহিংসতা ঘটছে। সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ শুধু বিবৃতি দেওয়া না, তাদের কাজ হলো ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ পর্যন্ত একটাও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি যা দেখে অন্যরা ভয় পাবে কিংবা সতর্ক হবে।

এই মুহূর্তে আর করণীয় কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেকোনও উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পরস্পরকে অনুধাবন করে অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া দুইটি উপায় আছে। একটি হচ্ছে শৈশব থেকে যেখানে তার পাঠ্যবইয়ে সামাজিক সংস্কৃতিবোধ তৈরির উপাদান থাকতে হবে। অপর একজন মানুষের সঙ্গে তার আচরণ কেমন হবে, ভুল বোঝাবুঝি হলে তা সামাজিকভাবে কীভাবে সমাধান করা যায়, কাউকে আঘাত না করে কিংবা তার মর্যাদা বা সম্পত্তি নষ্ট না করে জীবন যাপনের পারিবারিক শিক্ষাটাও থাকতে হবে।"

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এনামুল হক সাগর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এসব বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের অবস্থান আমরা আগেই জানিয়েছি। এখনও আমাদের একই অবস্থান। কেউ যেন আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়। যত বড় অপরাধীই হোক না কেন, তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে হবে, পুলিশকে জানাতে হবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে হবে। আমরা এসব বিষয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে সাড়া দেবো। অপরাধীকে গ্রেফতারের ব্যবস্থা করবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসব ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনার পাশে এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটছে কিনা, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে দেখভাল করার দায়িত্ব আপনারও আছে। আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সবার সহযোগিতা চাই। কেউ যদি আশেপাশে এসব ঘটনা দেখেন তবে পুলিশকে জানান, আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নেবো।’

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মব–সন্ত্রাস বন্ধে সরকার কাজ করছে। মব–সন্ত্রাস কি আগে থেকে কমেনি? পদক্ষেপ না নিলে কমছে কীভাবে? আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি দেখেই কমছে।’

/আরআইজে/
সম্পর্কিত
মুগদায় ছিনতাইকারী সন্দেহে গণপিটুনি, তরুণের মৃত্যু
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে পিটিয়ে দেওয়া হলো পুলিশে
অস্ত্রের মুখে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা, খালে লাশ ফেলতে আসা দুজনকে গণপিটুনি
সর্বশেষ খবর
গ্রেনাডায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুঁড়িয়ে দিয়ে টেস্ট সিরিজ অস্ট্রেলিয়ার
গ্রেনাডায় ওয়েস্ট ইন্ডিজকে গুঁড়িয়ে দিয়ে টেস্ট সিরিজ অস্ট্রেলিয়ার
নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে না কেন
নদীতে ইলিশের দেখা মিলছে না কেন
অধিনায়ক মুল্ডারের ডাবল সেঞ্চুরিতে প্রথম দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার রেকর্ড রান
অধিনায়ক মুল্ডারের ডাবল সেঞ্চুরিতে প্রথম দিনে দক্ষিণ আফ্রিকার রেকর্ড রান
ফার্মগেটে ককটেল বিস্ফোরণ, একজন আহত
ফার্মগেটে ককটেল বিস্ফোরণ, একজন আহত
সর্বাধিক পঠিত
আসছে নতুন কারিকুলাম: ফ্রেমওয়ার্ক ডিসেম্বরে, ‘বড় পরিসরে’ থাকবে জুলাই
আসছে নতুন কারিকুলাম: ফ্রেমওয়ার্ক ডিসেম্বরে, ‘বড় পরিসরে’ থাকবে জুলাই
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক 
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা পাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক 
ফার্মেসিতে ওষুধের আড়ালে ‘ট্যাপেন্টাডল’ বিক্রির অভিযোগ, আটক ৫
ফার্মেসিতে ওষুধের আড়ালে ‘ট্যাপেন্টাডল’ বিক্রির অভিযোগ, আটক ৫
লোহিত সাগরে জাহাজে হামলায় আগুন, ডুবে যাওয়ার শঙ্কা
লোহিত সাগরে জাহাজে হামলায় আগুন, ডুবে যাওয়ার শঙ্কা
সেই ব্যাংক কর্মকর্তার খোঁজ মিলেছে
সেই ব্যাংক কর্মকর্তার খোঁজ মিলেছে