X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু প্রকল্পের মেয়াদ শেষেও সাড়ে ৫ কোটি টাকা উত্তোলন

শাহেদ শফিক
২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:০০আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২২, ২১:৪৫

জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড রিফরেস্টেশন প্রজেক্ট (সিআরপিএআরপি) নিয়েছে সরকার। এতে উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রজাতি গাছ দিয়ে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এর সুফল মেলেনি। এ সংক্রান্ত প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব।

বন বিভাগের প্রকল্পটির একটি অংশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আরণ্যক ফাউন্ডেশন। প্রতিষ্ঠানটি প্রকল্প শেষ হওয়ার পরও ‘যৌথ ঘূর্ণায়মান সঞ্চয় ও ঋণ তহবিল’ থেকে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭ হাজার টাকা উত্তোলন করেছে। এই অর্থ ব্যয়ের সঠিক তথ্য-প্রমাণ নেই সংস্থাটির কাছে।

বন বিভাগ বলছে, বিষয়টির সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। এটি আরণ্যক ফাউন্ডেশনই বলতে পারবে। আরণ্যক বলছে অভিযোগটি সঠিক হয়নি। তারা বন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করেই প্রকল্পের কাজ করেছেন।

বাংলা ট্রিবিউনের হাতে আসা নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আরণ্যক ফাউন্ডেশনের আর্থিক বিবরণী অনুসারে ৫৫টি মিউচুয়াল রোটেটিং সেভিংস ও লোন ফান্ড (এমআরএসএলএফ) তহবিলে ক্লাইমেট চেঞ্জ রেসিলিয়েন্স ফান্ড (সিসিআরএফ) থেকে সরাসরি অনুদান হিসেবে ১৩ কোটি ৯২ লাখ ১১ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া বননির্ভর ব্যক্তিদের অংশগ্রহণমূলক সঞ্চয়ের মাধ্যমে ২ কোটি ৪০ লাখ টাকা ম্যাচিং ফান্ড সংগ্রহ করা হয়। মোট তহবিল দাঁড়ায় ১৬ কোটি ৩২ লাখ ১১ হাজার টাকায়।

প্রকল্পের পরিচালন ব্যয়ের জন্য পৃথক বরাদ্দ হয়। পাশাপাশি দুটি সহযোগী এনজিও-কেও পৃথকভাবে অর্থ পরিশোধ করা হয়।

প্রকল্পের ডিপিপি, পিআইএম এবং প্রকল্প বাস্তবায়কারী কর্তৃপক্ষ, বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী এনজিওর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে, প্রকল্প সমাপ্তির পর আরণ্যক ফাউন্ডেশন বা সহযোগী এনজিওগুলো এমআরএসএলএফ থেকে কোনও অর্থ উত্তোলন বা প্রত্যাহার করতে পারবে না। কিন্তু ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর প্রকল্প শেষ হওয়ার পর আরণ্যক ফাউন্ডেশন ও দুটি সহযোগী এনজিও ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্টের মধ্যে ৫৫টি এমআরএসএলএফ তহবিল হতে ৫ কোটি ৩০ লাখ ৭ হাজার টাকা উত্তোলন করে। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে—পরিচালন ব্যয়, উপ-অনুদানের টাকা আরণ্যক ফাউন্ডেশনকে ফেরত, আরণ্যক কর্তৃক অনুদান প্রত্যাহার বা স্থানান্তর। এই অর্থ কখন কোন খাতে ব্যয় করা হয়েছে তার বিবরণ বা ব্যয়ের কোনও নথি দেখাতে পারেনি সংস্থাটি।

ফাউন্ডেশনটি বলছে, প্রকল্প শেষের পর বিশ্বব্যাংক থেকে নবগঠিত সমিতিগুলোর মনিটরিং, সক্ষমতা বৃদ্ধি, ২০০টি গ্রামে ভ্যালু চেইন কর্মসূচি সম্প্রসারণে সহায়তা দিতে আরণ্যককে অনুরোধ করা হয়। দুটি এনজিওর মাধ্যমে আগের প্রকল্পের সেটআপ ব্যবহার করে সহযোগিতা করে আরণ্যক।

ফাউন্ডেশনটি আরও দাবি করছে, তারা যে ১৩ কোটি ৯২ লাখ ১০ হাজার টাকা পেয়েছে তার মধ্যে ৬ কোটি সঞ্চয়ী হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। ৩৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বিশেষায়িত হস্তশিল্প প্রশিক্ষণের জন্য এবং ৪ কোটি ৭৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে ভ্যালু চেইন কার্যক্রম, মনিটরিং এবং সক্ষমতা বৃদ্ধিতে অতিরিক্ত সহায়তা প্রদানের জন্য। বাকি ২ কোটি ৭৭ লাখ ৩০ হাজার টাকা বিকল্প জীবিকায়ন কর্মসূচি পরিচালনা, বিনিয়োগ ও উন্নয়নের জন্য রাখা হয়েছে।

সংস্থাটি বলেছে, প্রকল্পের শেষ সময়ে বিশ্বব্যাংক ১০ লাখ ডলার দেয়। এই অর্থ ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর অনুমোদন হলেও পাওয়া গেছে ১৬ ডিসেম্বর। ২০১৬ সালে যা খরচ করা সম্ভব হয়নি। পরের বছর ২০১৭ সালে ৫৫টি সমিতির সঙ্গে ৪ কোটি ৭৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা ভাগাভাগি করে ব্যয় করা হয়।

আরণ্যকের এই জবাব গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করছে বন বিভাগ। দফতরটি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছে, প্রকল্পের ডিপিপি ও পিআইএম-এর শর্ত এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ, বিশ্বব্যাংক ও সহযোগী এনজিওর মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি লঙ্ঘন করা হয়েছে। প্রকল্প সমাপ্তির পর ‘পরিচালন ব্যয়’-এর নামে এমআরএসএলএফ হতে অর্থ উত্তোলন বা প্রত্যাহার করাটা এনজিও ও সমিতির নির্বাহী কমিটির কর্তৃত্ববহির্ভূত।

ওই অর্থ সরকারি কোষাগারে ফেরত দেওয়ার সুপারিশ করেছে অডিট বিভাগ। পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে মন্ত্রণালয়কে।

তহবিল এক, হিসাব একাধিক

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একটি মাত্র এমআরএসএলএফ তহবিলের জন্য একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে লেনদেনের কারণে স্বচ্ছতা বজায় রাখায় সংকট দেখা দিয়েছে। প্রত্যেক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের বিপরীতে ব্যাংক চার্জসহ বিভিন্ন কর কাটার ফলে সমিতির অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ও বেড়েছে। এ ছাড়া প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও সাইট কো-অর্ডিনেটর এমআরএসএলএফ তহবিলের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর আবশ্যিক স্বাক্ষরদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। বিষয়টিকে প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্ট ম্যানুয়ালবহির্ভূত বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

আরণ্যক বলেছে, প্রাথমিকভাবে অংশীদার বেসরকারি সংস্থার ডকুমেন্টারি সহায়তায় অনিবন্ধিত ফেডারেশনগুলো ব্যাংক হিসাব খোলে। তারপর সমবায় সমিতি হিসেবে নিবন্ধিত করার সময় তাদের নাম বদলে যাওয়ায় দ্বিতীয় হিসাব খুলতে হয়।

২০১৬-২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংক থেকে অতিরিক্ত তহবিল পেতে সমিতিগুলো তৃতীয় ব্যাংক হিসাব খোলে। সমিতিগুলো ইতোমধ্যে তাদের মূল ব্যাংক হিসাব রেখে বাকিগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।

আরণ্যক ফাউন্ডেশন আরও বলছে, নতুন স্বাক্ষরকারী নির্বাচনে বিলম্ব হওয়ায় অ্যাকাউন্টগুলো বন্ধ করা যায়নি। সাইট কো-অর্ডিনেটররা সব অ্যাকাউন্টের বাধ্যতামূলক স্বাক্ষরকারী ছিলেন। কিন্তু প্রকল্প মেয়াদোত্তীর্ণের পর তারা ক্রমান্বয়ে চাকরি ছেড়ে যান।

জানতে চাইলে বন অধিদফতরের পরিকল্পনা উইংয়ের উপপ্রধান বন সংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটি আমাদের বিষয় নয়। বিশ্বব্যাংক আরণ্যককে অর্থ দিয়েছে। এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই। এ বিষয়ে আরণ্যক ফাউন্ডেশনই ভালো বলতে পারবে।

আরণ্যক ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক রকিবুল হাসান মুকুল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নানা কারণে এমনটা হয়েছে। আমরা বন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে বিষয়টির সমাধান করার চেষ্টা করছি।’

জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ডা. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটি অবশ্যই অনিয়ম। প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

/এফএ/এমওএফ/
টাইমলাইন: জলবায়ু প্রকল্পে অনিয়ম
২৯ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:০০
২৮ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:০০
জলবায়ু প্রকল্পের মেয়াদ শেষেও সাড়ে ৫ কোটি টাকা উত্তোলন
২৭ ডিসেম্বর ২০২১, ০৮:০০
সম্পর্কিত
‘জলবায়ুর প্রভাব মোকাবিলায় অর্থের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না’
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় গবেষণা বাড়ানো হবে: কৃষিমন্ত্রী
জলবায়ুর পরিবর্তন: ক্ষতি কমাতে বছরে ব্যয় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার
সর্বশেষ খবর
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!