জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড রিফরেস্টেশন প্রজেক্ট (সিআরপিএআরপি) গ্রহণ করেছে সরকার। এতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ু সহিষ্ণু প্রজাতি গাছ দিয়ে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু এর সুফল মেলেনি। এ সংক্রান্ত প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সিনিয়র রিপোর্টার শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে তৃতীয় পর্ব।
জলবায়ু তহবিলের অর্থায়নে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় গাছ লাগানো হয়েছিল। কিন্তু বন হয়ে ওঠার আগেই এলাকাটি বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটিকে (বেজা) হস্তান্তর করে বন বিভাগ। পটুয়াখালী ও নোয়াখালীর প্রায় তিন হাজার ৮০০ হেক্টর বন উজাড় হয়েছে তাতে। অথচ ওই বন সৃজনে ব্যয় হয়েছিল প্রায় চার কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে গবেষণা ও মাস্টারপ্ল্যান করা জরুরি ছিল।
বন বিভাগ জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগের মিরসরাই রেঞ্জের বামনসুন্দর বিটে লাগানো ১৬৫ হেক্টর ম্যানগ্রোভ, ৩ হেক্টর মাউন্ড, ৩০০ হেক্টর গোলপাতা, ১০ হেক্টর এনরিচমেন্ট এবং ডোমখালী বিটে ৮০০ হেক্টর স্ট্রিপ বন লাগানো হয়। কিন্তু ‘মিরসরাই অর্থনৈতিক জোন’ স্থাপনের জন্য বেজা কর্তৃপক্ষ এসব গাছ কেটে ফেলে। একইভাবে গোরখঘাট রেঞ্জের সোনাদিয়া বিটে ৩৫ হেক্টর ম্যানগ্রোভ ও ৮৮ হেক্টর ঝাউ বন লাগানো হয়। পরে প্রকল্প এলাকাটি বেজা কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এতে সরকারের এক কোটি ৪৭ লাখ ৮৮ হাজার টাকা ব্যয় হয়।
এ ছাড়া, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য আশ্রয় ক্যাম্প স্থাপনের কারণে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের থাইনখালী বিটের ১৪০ হেক্টর বনায়ন ধ্বংস হয়েছে। এতে সরকারের খরচ হয়েছিল প্রায় ৯০ লাখ টাকা।
অপরদিকে, রাস্তা ও বাঁধ পুনর্নির্মাণে পটুয়াখালী ও চট্টগ্রাম বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে রাস্তার পাশে ও বাঁধে লাগানো বিপুল পরিমাণ ‘স্ট্রিপ প্ল্যান্টেশন’ কেটে ফেলা হয়। এক্ষেত্রে বনায়নের স্থান নির্বাচনে বিজ্ঞানভিত্তিক বায়োফিজিক্যাল ফিচার পর্যালোচনা করা হয়নি। ফলে ভৌগোলিক পরিবর্তনের কারণে অনেক স্থানে বন দ্রুত ধ্বংস হয়ে যায়। এতেও প্রায় ৯০ লাখ টাকার বনায়ন ধ্বংস হয়।
আরও ক্ষতি
অনুসন্ধানে দেখা যায়, নোয়াখালীর উপকূলীয় বন বিভাগের আওতায় বিভিন্ন রেঞ্জের অধীন দুই হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে প্রায় দুই কোটি ৭৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ম্যানগ্রোভ বনায়ন করা হয়। এর মধ্যে ভূমিধসের কারণে ৭৮ শতাংশ বনভূমি নদীতে বিলীন হয়। গচ্ছা যায় দুই কোটি ১৬ লাখ টাকা। একইভাবে নলচিরা রেঞ্জের চরতোমারুদ্দী বিটের ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে ১৮ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ব্যয়ে নন-ম্যানগ্রোভ বাফার বন করা হয়। একই রেঞ্জের ওছখারী বিটে ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০ হেক্টর জমিতে এবং জাহাজমারা রেঞ্জের নিঝুমদ্বীপের ৮ হেক্টর জমিতে ৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা ব্যয়ে নন-ম্যানগ্রোভ বাফার বন সৃজন করা হয়। কিন্তু বায়ো ফিজিক্যাল ফিচার অনুসরণ না করায় সেটাও ধ্বংস হয়। ক্ষতি হয় ২ কোটি ৫২ লাখ টাকা।
পরিবেশের উপযোগিতা বিবেচনায় না নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করায় এমনটা ঘটেছে বলে বলে মনে করেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। সব মিলিয়ে উপকূলীয় এলাকার এই তিন বিভাগে ধ্বংস হয়েছে ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকার বন।
বন বিভাগ বলছে নতুন বনায়ন এলাকায় সরকারের অন্যান্য বিভাগের গৃহীত উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের বিষয়ে বন অধিদফতরকে সময়মতো জানানো হয়নি। এ ছাড়া নদী ভাঙনসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও কিছু বন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সবুজ আন্দোলনের চেয়ার বাপ্পি সরদার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জলবায়ুর টাকায় প্রকল্প গ্রহণ করে আবার সেখানে অন্য প্রকল্পের কারণে গাছ কেটে ফেলা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। মহেশখালীসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় এমনটা ঘটেছে।
প্রকল্পের সর্বশেষ পরিচালক অজিত কুমার রুদ্র বলেন, সংশ্লিষ্ট ডিএফও (ডিস্ট্রিক ফরেস্ট অফিসার) জানিয়েছেন, সরকারের নির্দেশ অনুসারে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার জন্য মিরাসরাই রেঞ্জের বামনসুন্দর বিটে লাগানো ১৬৫ হেক্টর ম্যানগ্রোভ বনায়ন বেজা’কে হস্তান্তর করা হয়। উখিয়া রেঞ্জের থাইনখালী ও ভালুকিয়া বিটের ১৪০ হেক্টর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জানতে চাইলে বন অধিদফতরের পরিকল্পনা উইং-এর উপপ্রধান বন সংরক্ষক মো. জগলুল হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সরকারি সিদ্ধান্তে আমাদের কিছু করার নেই।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, যে কোনও প্রকল্পের উদ্দেশ্যের সঙ্গে কার্যক্রমের সামঞ্জস্য রাখতে হয়। এটা ব্যর্থ হলে দুটি বিষয় প্রমাণ হয়— প্রথমত, জনগণের অর্থের অপচয়, দ্বিতীয়ত, জলবায়ু মোকাবিলায় যে চ্যালেঞ্জ সেই বিষয়ে কর্তৃপক্ষ পর্যাপ্ত গুরুত্ব দিতে পারেনি। সাধারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে যে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়ে আসছে সেই ধরনের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটিতে।
পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের কাছে বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে প্রশ্ন পাঠানো হয়— ‘সিআরপিএআরপিসহ অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প গ্রহণের আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয় না। যে কারণে প্রকল্প থেকে পর্যাপ্ত সুফল পাওয়া যায় না। প্রকল্প গ্রহণের আগে যথাযথ স্টাডি করার পরিকল্পনা রয়েছে কি?’ কিন্তু এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়া পর্যন্ত মন্ত্রীর দফতর থেকে কোনও উত্তর আসেনি।
জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, একটা প্রকল্পের সুফল পাওয়ার আগেই যদি তা ধ্বংস করে ফেলা হয় তা দুঃখজনক। এখন বিষয়টি হচ্ছে, দেশে বন যদি একটুও না থাকে অনেক মানুষ খুশি হয়। বিশেষ করে জনপ্রতিনধিরা সবাই বনের বিরুদ্ধে। আমাদের স্ট্যান্ডিং কমিটির একজন সদস্যও ৫৯৭ একর বনের জমি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। এসব কারণেই বনের জমি হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে।