X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
ভাষা মতিনের অপ্রকাশিত সাক্ষাৎকার

নিজ ভাষা নিয়ে যেন হীনম্মন্যতা তৈরি না হয়

উদিসা ইসলাম
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১৭:০০আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৩, ১৫:৪১

কোনও একটি আন্দোলনের কর্মী হিসেবে, নেতা হিসেবে সেই আন্দোলনের নামের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত হয়ে যাওয়া সবচেয়ে বড় পাওয়া। বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের ‘ভাষা’ অংশটুকু নামের সঙ্গে জুড়ে যার নাম সবার মুখে মুখে— তিনি আব্দুল মতিন, ‘ভাষা মতিন’ নামে  পরিচিতি পান। ১৯২৬ সালের ৩ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম ধুবালীয়ায় তার জন্ম। বাবার নাম আব্দুল জলিল। মায়ের আমেনা খাতুন।

১৯৫২ সালে তিনি টগবগে তরুণ। বিশ্ববিদ্যালয়ে গড়ে ওঠে ভাষার দাবিতে আন্দোলন। সে আন্দোলনের চূড়ান্ত সময়ে হানাদারের বুলেটে ভেসে যায় আব্দুল জব্বার, আবুল বরকত, সালাম, রফিক প্রমুখ। তারপরে অর্ধশত বছরেরও বেশি সময় জীবিত থেকে যিনি আমাদের মাঝে ভাষা সংস্কৃতির চেতনার আলো জ্বেলে গেছেন, তিনি ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিন, যাকে আমরা ভাষা মতিন বলেও সম্বোধন করে থাকি।

মৃত্যুর কয়েক বছর আগে (২০১৪) তিন দফায় তার সঙ্গে আলাপে ছড়ানো ছিটানো স্মৃতিচারণ করেন তিনি।  বারবারই বলেছেন, চেতনা বিক্রয়যোগ্য না। কোমর শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকার বিকল্প নেই। সেই আলাপচারিতায় উঠে আসে— ছেলেবেলার রাজনীতি, সারাজীবনের রাজনীতির ধারাবাহিকতা, মুক্তিযুদ্ধ ও তারপরের বাংলাদেশ। সেই আলাপচারিতা প্রকাশের অনুমতি থাকলেও তার রাজনৈতিক জীবনের আলাপের বাইরে কেবল ভাষা আন্দোলন অংশটি তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্য। এবছর অমর একুশে আরেকবার সেই ঘটনাগুলোর মধ্যে ঘুরে আসি— সেই সময়ের টগবগে যুবক ভাষা মতিনের সঙ্গে। 

বায়ান্নর ৮ ফাল্গুন, আমাদের চিরচেনা ২১ ফেব্রুয়ারি, ভাষার জন্য লড়াই চিরস্মরণীয় হয়ে আছে সেই দিনগুলো। আন্দোলনের কোন সময়টার কথা ভাবলে এখনও শিহরিত হন?

ভাষা সৈনিক আবদুল মতিন: যখন আমরা কোনও আন্দোলনের মধ্যে থাকি, তখন একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকলেও তার গুরুত্ব টের পাই না। কিন্তু দূরবর্তী জায়গা থেকে দেখলে ঠিক বুঝা যায়— কী ঘটে চলেছে। ফলে ২১ ফেব্রুয়ারির আগে পরের বছরগুলোজুড়ে নানাকিছু ঘটছিল, যার মধ্যে আমরা থাকলেও শিহরণ ছিল বলা যাবে না, জিদ ছিল। এখন এসে দিনগুলোতে ফিরে গেলে শিহরণ বোধ করি, বাংলা ভাষা নিয়ে এখন কিছু হতে দেখলে সেসব দিনে ফিরে যাই। তেমনই একটা হলো ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ সমাবর্তন সভা। পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল জিন্নাহ ঘোষণা দিলেন— ঢাকাতেই, উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। তখনতো সেখানে দাঁড়িয়ে নো নো বলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। আমাকে বলতে শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার সহযোদ্ধারা, অন্য ছাত্ররাও নো নো বলে চিৎকার করে ওঠে। সেই সময়টাকে মনে পড়লে শিহরণ হয়। কী করছি, এর ফল কী হবে এসব না ভেবে, যেটা ঠিক মনে করেছি, সেটা করেছি।

তা না ভেবে যা কাজটি করেই ফেললেন, পরে কি খেসারত দিতে হয়েছিল?

আবদুল মতিন: (মৃদু হেসে, মাথা দুলিয়ে বললেন) তা তো হয়েইছিল। আমি নিজেও নিজেকে ধন্য মনে করি যে, আমি তো ওই সাহসী কাজটা করেছিলাম। আমাকে অনেকে পরে বকাবকি করেছে। তবে হ্যাঁ, তারা আমার ভালো চাইতেন বলেই বকেছেন। তবে অন্যটাও ছিল। অনেকে আমাকে পরমুহূর্ত থেকে বলা শুরু করলো যে, তুই তো বিপদে পড়বি। এসব রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তের বিষয়। ছাত্রদের ঢোকা উচিত হবে না। একসময় দেখবা, পাশে কেউ নেই। নানারকমের ভয় দেখানো। বরং তাদের এসব কমেন্ট আমার নিজেকে বুঝতে হেল্প করেছিল, এখনও করে।

এখনও করে মানে কী?

আবদুল মতিন: মানে হলো। আমি নেগেটিভ মন্তব্য থামিয়ে দিই না। আমি সেটা এগুতে দিই। এবং একইসঙ্গে সেগুলো শুনে আমি নিজের বিবেচনা কাজে লাগিয়ে সিদ্ধান্ত নিই। যখন কেউ বলে, তোমাকেই কেন করতে হবে। আমি বুঝি আমার কিছু করণীয় অছে। ফলে সবাইকে বলতে দিতে হবে। সবারটা শুনতে হবে। আমার ভাষা, আমার কথা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমরা প্রথম জায়গাতেই দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বুঝিয়ে দিয়েছি যে, কাজটা আসলে আমরা ভালোভাবে নিচ্ছি না। এমন পরিস্থিতিতে যদি কেউ বলে— কী দরকার ছিল। তাহলে বুঝতে হবে, আমরা ঠিক লাইনে আছি।

আন্দোলন যখন দানা বাঁধছে। তখন কি রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন পেয়েছিলেন? কাজ কীভাবে হতো?

আবদুল মতিন: সে এক ব্যাপার বটে। হঠাৎ করেই আমাকে ‘বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’র আহ্বায়ক করা হলো। মিছিল করছি, সভা করছি, স্লোগান দিচ্ছি। কিন্তু সংগঠনটা তখনও বুঝি না। আমাকে কী করতে হবে? অনেককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কাজটা কী করতে হবে— সেটা যেন কেউ আমাকে বলে দেয়।

এত বড় কাজ। পরে এক এক করে বুঝলাম। তবে রাজনৈতিক নেতারা আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটাতে যে এই ঘটনা ঘটবে, সেটা হয়তো হিসাবের বাইরে ছিল বলে অনেক নেতা সেখানে ছিলেন না। কিন্তু রাজনীতি ছাড়াতো আসলে ওখানে আর কিছু করণীয় ছিল না।

তো তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এত বড় গুরুদায়িত্ব আমি কিভাবে কোনও অভিজ্ঞতা ছাড়া পরিচালনা করি? পরে কাজটা বুঝে নিয়ে ১৯৫০ সালে আমি দুটো সভার নোটিশ দিলাম। কিন্তু কমিটির বৈঠকগুলোতে সবাইকে হাজির করা সম্ভব হচ্ছিল না। ওই সময় মানে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ সালের মার্চ পর্যন্ত বড় বড় নেতারা খুব বেশি সম্পৃক্ত ছিলেন না। পরে আগের কমিটির বাইরে ছোটো করে আরেকটা কমিটি করা হয়, কাজগুলো তোলার জন্য। আমরা ছাত্ররা নানাভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করেছি, গণসংযোগ করেছি, অর্থ সংগ্রহ করেছি। আর সামনে কী ঘটতে চলেছে— তার আন্দাজ করার চেষ্টা করে গেছি।

এই যে কাজগুলো করছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আপনার বা আপনাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি?

আবদুল মতিন: নিয়েছে তো। বহিষ্কার করেছে, প্রলোভন দেখিয়েছে, টোপ দিয়ে আন্দোলন থেকে সরাতে চেয়েছে। একবার জেলে হলো কী, জেলারের মাধ্যমে পুলিশ অফিসার আমার কাছে একটা কাগজ নিয়ে এলেন। তাতে লেখা ছিল— আমি সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে ও সেবাদানে প্রস্তুত। ইংরেজিতে লেখা। ওরা চাইলো অমি স্বাক্ষর করি। আমি তো রাগ দেখালাম, প্রস্তাব নাকচ করে দিলাম। আমাকে সে অফিসার খুব ভালো করে বুঝাতে চাইলেন। আমার কী কী লাভ হবে বারবার বললেন। আবার সেসবের মধ্যে প্রচ্ছন্ন হুমকিও ছিল। তার কথা না শুনলে কী কী সমস্যা হবে বললেন। আমি রাজি হইনি। তখন সেই সাহস ছিল। দেখি না কী হয়, সেটা বলতে পারতাম। কারাগারে শেখ মুজিবুর রহমানসহ বড় বড় নেতারা। সাহস তখন আমাদের অনেক বেশি। আমি কারামুক্ত হলাম তারও দু’মাস পরে। এ ঘটনার দু’মাস পরে আমি জেল থেকে মুক্তি পাই। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আমাকে তার অফিসে ডেকে খুব হেনস্তা করলেন। তিনি আমাকে নিষ্ক্রিয় করতে যা যা প্রস্তাব করা যায়, করলেন। কিন্তু ঘাড় তো তখন আমার অনেক ত্যাড়া। শুনতেই চাইলাম না কিছু। আমাকে তিন বছরের জন্যে বহিষ্কার করা হলো।

অনেকবার শুনেছি, কিন্তু আবারও ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার সময়টার বিবরণ শুনতে চাই।

আবদুল মতিন: ২১ ফেব্রুয়ারি আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম। তোমরা টেক্সটটা দেখেছো কিনা জানি না। আমি বলেছিলাম, আজ  ১৪৪ ধারা ভাঙা না হলে ভাষা অন্দোলন তো বটেই, ভবিষ্যতে কোনও আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া যাবে না।আমি সমবেত ছাত্রদের কাছে প্রশ্ন করি— আমরা কি তাহলে ১৪৪ ধারার ভয়ে পিছিয়ে যাবো? জবাবে সবাই সমস্বরে উত্তেজিত কণ্ঠে উচ্চরণ করে— না। আগের দিন মানে ২০ ফেব্রুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ১১জন মত প্রকাশ করেছিলেন— সরকার আরোপিত ১৪৪ ধারা মেনে নিয়ে নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। আর তার বিপরীতে মাত্র ৪ জন— অলি আহাদ, গোলাম মাওলা, শামসুল আলম এবং আমি  ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে মত দিই।

তো ২১ তারিখ যখন আমি কৌশলে ছাত্রদের সংখ্যা গরিষ্ঠের মতামতটা নিলাম, তখন কারোর আপত্তি তোলার সুযোগ ছিল না। তখন আমি বললাম— ১০ জন করে করে এক লাইনে দাঁড়িয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। তবে এ ভাবনা শুধু আমার একার ছিল না।

বাংলাদেশে এখনও সব পর্যায়ে বাংলা ভাষা চালু হয়নি। আপনার অভিমত কী?

আবদুল মতিন: ১৯৫১ সালে আমরা যে আন্দোলন করেছি ভাষার জন্য, সেটা সে সময়ের দাবি ছিল। আমরা আমাদের একটি রাষ্ট্রভাষা আদায় করে নিয়েছি। এখন সময় বদলেছে। এখনকার পৃথিবীতে আমরা অন্য অনেক ভাষা শিখবো, সেই ভাষার অধিকার নিয়ে কথাও বলবো। আর নিজের ভাষাটাকে বাঁচিয়ে রাখবো। অন্য অনেক ভাষার সঙ্গে সংমিশ্রণ হবে, স্বাভাবিক। কিন্তু নিজস্বটা বজায় রেখে যেন হয়, সেই দায়িত্বটুকু বোধ করতে হবে। আপনার নিজের ভাষা নিয়ে কখনও যেন হীনমন্যতায় ভুগতে না হয়। অন্য ভাষা শেখা একজন ব্যক্তির দক্ষতা। কিন্তু নিজের ভাষাটা দিয়ে সে দেশের অভ্যন্তরে যেন সব কাজ সম্পাদন করতে পারে।

আপনার রাজনৈতিক জীবন অনেক বাঁক নিয়েছে। একসময় আপনি সমাজ বদলাতে চরমপন্থাকেও সমর্থন করেছেন। সে সময়টা নিয়ে কিছু বলবেন কিনা?

আবদুল মতিন: না, ওই সময় নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। তোমার বাবা আমিরুল ইসলামও সেখানে আমার কমরেড ছিলেন। তিনি কি কিছু বলেছেন? ফলে ওই সময়ে আমাদের যে লড়াই, সেটা নিয়ে এখন আর কথা বলতে চাই না। অন্য কখনও সময় হলে বলবো।

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও মানস ঘোষমুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবাদ সংগ্রহ
করারোপ নীতি শিক্ষা সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করবে: সলিমুল্লাহ খান
তাসখন্দে শহীদ মিনার স্থাপনের প্রস্তাব
সর্বশেষ খবর
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়, হাইকোর্টের রায় প্রকাশ
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
এক কোরাল ৩৩ হাজার টাকায় বিক্রি
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা