X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

আমার দুটো দুঃখ আছে: আইনমন্ত্রী

বাহাউদ্দিন ইমরান
২৬ মার্চ ২০২৩, ১৫:৪৪আপডেট : ২৬ মার্চ ২০২৩, ১৭:৫০

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধু, সহপাঠী ও তার মামলার অন্যতম আইনজীবী ছিলেন প্রয়াত অ্যাডভোকেট সিরাজুল হক। তারই সন্তান বর্তমান আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক। জন্ম থেকেই তিনি বাবাকে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী থেকে কাজ করতে। বড় হয়ে নিজেও একই আদর্শ অনুসরণ করছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় একবার আগরতলার উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন, তবে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাননি। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ও জেলহত্যা মামলায় প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলা ট্রিবিউনের কাছে নিজের নানা ভাবনা আর অভিজ্ঞতার অংশবিশেষ তুলে ধরেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

বাংলা ট্রিবিউন: একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার বয়স কত ছিল?

আনিসুল হক: তখন আমার বয়স ছিল ১৫ বছর। সেন্ট জোসেফ হাইস্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়তাম। আমরা তখন মোহাম্মদপুরে থাকতাম।

বাংলা ট্রিবিউন: যুদ্ধ শুরু হলে ওই ছোট বয়সেই কি রণাঙ্গনে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়েছিল?

আনিসুল হক: একাত্তরের অক্টোবর মাসে আগরতলায় যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু নবীনগরের বিটঘর পর্যন্ত যাওয়ার পরে তখন আর পার (বর্ডার) হতে পারিনি।

আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

বাংলা ট্রিবিউন: মুক্তিযুদ্ধকে তখন কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন?

আনিসুল হক: দেখুন, পরিবার হিসেবে আমরা জন্ম থেকেই আওয়ামী লীগপন্থি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আমার বাবা মরহুম সিরাজুল হকের সহপাঠী-বন্ধু-নেতা। একইসঙ্গে আমার পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর আইনজীবী। সেই সূত্রে আমাদের পুরো বাসার পরিবেশ ছিল ছয় দফা আন্দোলনের পক্ষে এবং বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনের সপক্ষে। সেই ক্ষেত্রে আমার বাবা পঞ্চাশের শেষ দিক থেকেই কসবা আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা করান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাব-ডিভিশনের ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাই কখনোই আওয়ামী লীগের বাইরে চিন্তা করার সুযোগ আমাদের ছিল না।

আমার বাবা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির মেম্বার নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৭-১৮ মার্চ বাবাকে তারা গ্রেফতার করে। সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয়। তারা (পাকিস্তানিরা) বাবাকে বলেন, তাদের প্রস্তাবে রাজি না হলে পূর্ব পাকিস্তানকে তারা গুঁড়িয়ে দেবে। এর পরদিন সম্ভবত ১৮ মার্চ, আমার বাবা এলাকায় চলে যান। তারও আগে ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই মা, ছোট ভাই, দুই চাচাতো বোন এবং দাদিকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। তখন আমার বড় বোন মেট্রিক পরীক্ষা দেবে বলে ঢাকায় ছিল, সে কারণে আমিও ঢাকায় থেকে গেছি।  

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিবেদক বাহাউদ্দিন ইমরান  

বাংলা ট্রিবিউন: বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় প্রসিকিউটরের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

আনিসুল হক: প্রথমবার যখন শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন তখনই এই মামলা রুজু করার পরিকল্পনা নেন। যেই মুহূর্তে পরিকল্পনা করেন তখন থেকেই এই মামলা পরিচালনার জন্য আমার বাবাকে দায়িত্ব দেন। আমাকেও এই মামলা দেখাশোনার দায়িত্ব দেন। এরপর মামলার এফআইআর (এজাহার) লেখা থেকে শুরু করে আপিল বিভাগে মামলার রায় ও রিভিউ পিটিশনের পরে রায় কার্যকর পর্যন্ত আমি এই মামলায় জড়িত ছিলাম। এই মামলা চলাকালীন সময়ে দেখভাল করেছি এবং আমার পিতার মৃত্যুর পর এই মামলার প্রধান কৌঁসুলি হয়েছি।

বাংলা ট্রিবিউন: দীর্ঘদিনেও মামলাটির রায় সম্পূর্ণরূপে কার্যকর না করতে পারাকে আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন কিনা?

আনিসুল হক: রায় কার্যকর করার বিষয়ে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে না। বিষয়টি হচ্ছে, যারা খুনি তারা জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় বিদেশে তাদের আস্তানা গাড়তে সক্ষম হয়েছিল। সেই কারণে এখন কয়েকজনের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। তবে দুই জন আছেন, তাদের আনার চেষ্টা চলছে। তাই যেটা বলতে চাচ্ছি, তারা (খুনিরা) আওতার বাইরে চলে গেছেন বলেই আনার ব্যাপারটা নিয়ে আমাদের একটু বেগ পেতে হচ্ছে। কিছু দিন আগে ক্যাপ্টেন মাজেদকে যখন পাওয়া গেলো তখন তার বিরুদ্ধে দেওয়া রায় কিন্তু ঠিকই কার্যকর করেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: মামলাজট ও দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে বঙ্গবন্ধু বারের অনুষ্ঠানে আক্ষেপ করে বক্তব্য রেখেছিলেন। সেই পরিস্থিতি থেকে কখনোই কি উত্তরণ সম্ভব নয়?

আনিসুল হক: ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট উদ্বোধনের সময় বঙ্গবন্ধু এসেছিলেন। তিনি একটি দেশকে ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করে যখন লাইনে আনছিলেন তখনই তাকে হত্যা করা হয়। তারপর থেকে বিচার বিভাগকে নিয়ে রাজনীতি করা হয় এবং সত্যি বলতে, জিয়া ও এরশাদ বিচার বিভাগকে পকেটেই রেখেছিল। জননেত্রী শেখ হাসিনা সরকার গঠন করার পর থেকেই কিন্তু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ শুরু করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ হলেও এর যে বাস্তবিক রূপরেখা, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবার যখন সরকার গঠন করেন তখন থেকেই করে আসছিলেন। যখন বিচার বিভাগ পৃথক হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন যে বিচার বিভাগ স্বাধীন হওয়া উচিত এবং স্বাধীন থাকা উচিত। সেই বিশ্বাসে তিনি ২০০৯ সাল থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য তাদের যে ভৌত অবকাঠামো এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে যাচ্ছেন এবং যাবেন।

আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক (ছবি: সাজ্জাদ হোসেন)

বাংলা ট্রিবিউন: জেলহত্যা মামলায় কোনও করুণ দৃশ্যপট কি ফুটে উঠেছিল?

আনিসুল হক: জেলহত্যা মামলার দুটো দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ড যারা ঘটিয়েছে তারাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের ১৭ জন সদস্যকে হত্যা করেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় এই জেল হত্যাকাণ্ড হয়। যেহেতু বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় তাদের (খুনিদের) ফাঁসি হয় এবং রায় কার্যকর হয়, সেহেতু ধরে নেওয়া হয় জেল হত্যাকাণ্ডের বিচারও সেখানে হয়েছে। কিন্তু দুঃখের কিছু কিছু জিনিস আছে যা আমার কাছে মনে হয়, নতুন প্রজন্ম ও বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মকে যদি না জানানো হয়, তবে সেটা অন্যায় হবে এবং বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করার সুযোগ দেওয়া হবে।

দুঃখের বিষয় দুটো হলো, এক. আমরা যখন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা হাইকোর্ট বিভাগে শুনানি করতে যাই তখন সাত জন বিচারপতি এই মামলা শুনতে বিব্রতবোধ করেছিলেন। আমি এখনও তাদের (বিচারপতিদের) এই অবস্থানের নিন্দা জানাই। আমার কথা হচ্ছে- তারা কোনও কারণ দেননি যে তারা কেন এই মামলা শুনতে বিব্রতবোধ করলেন। আইনজীবী হিসেবে আমরা জানি বিব্রতবোধ হওয়ার দুটি কারণ থাকে। তা হলো- যদি কোনও বিচারক সংশ্লিষ্ট মামলায় আইনজীবী হিসেবে কখনও পরিচালনা করে থাকেন বা কোনও আসামি যদি তার আত্মীয় হন, তবেই বিব্রতবোধ করতে পারেন। এখানে আমার বলার বিষয় হচ্ছে- যেই সাত জন বিচারপতি এই বিব্রতবোধ করেছেন তাদের একজনেরও কিন্তু বিচারপতি হওয়ার যোগ্যতা থাকতো না যদি না বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গড়ে দিতেন। এটি একটি দুঃখের দিক।

দ্বিতীয় দুঃখের বিষয়টি হলো, জেলহত্যা মামলায় হাইকোর্ট বিভাগ একটি পারভার্স জাজমেন্ট (বিকৃত রায়) দিয়েছিল। সব সাক্ষী-সাবুদ থাকা সত্ত্বেও বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি আতাউর রহমান খানের হাইকোর্ট বেঞ্চ মামলাটির রায়ে বললেন, জেল হত্যাকাণ্ড শুধু একজন ঘটিয়েছে, আর কেউ ঘটায়নি। তাই একজনকে দণ্ড দিয়ে বাকি সবাইকে খালাস দিয়ে দিলো। সত্যিই এর থেকে পারভার্স (বিকৃত) জাজমেন্ট খুব একটা হয় না! তারপর আমরা আপিল বিভাগে আপিল করি। তখন আপিল বিভাগ জানতে চান, এভাবে জাজমেন্ট দিলো (হাইকোর্ট) কীভাবে? তখন বিএনপি সরকারে ছিল। কে এম ওবায়দুর রহমান, শাহ মোয়াজ্জেম- এরা বিচারিক আদালতকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আপিল বিভাগ বিচারিক আদালতের রায় বহাল রেখেছিলেন। 

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আনিসুল হক: আপনাকেও ধন্যবাদ।

/এফএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
দক্ষ বিচার বিভাগ গঠনে বিশ্বমানের জুডিশিয়াল অ্যাকাডেমি প্রয়োজন: আইনমন্ত্রী
৭ দফা আবেদন করেও প্রশাসনের সহায়তা পায়নি মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট
দেশে শ্রমিকদের অধিকার বাড়বে, কমবে না: আইনমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
দিল্লিকে ভয় ধরিয়ে হারলো গুজরাট
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
ডিইউজে নির্বাচনে সভাপতি পদের মীমাংসা মামলার শুনানি ২৫ এপ্রিল
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
জুড়ী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে মারধরের অভিযোগ
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী
ছয় দিনের সফরে ব্যাংকক গেলেন প্রধানমন্ত্রী