X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১
সাক্ষাৎকারে আ স ম আবদুর রব

২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদ নিয়ে বেরিয়ে পড়ি

সালমান তারেক শাকিল
২৬ মার্চ ২০২৩, ১৫:৪৮আপডেট : ২৭ মার্চ ২০২৩, ০১:০১

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি’র সভাপতি আ স ম আবদুর রব— মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক এবং ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর ভিপি। তিনি ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাবলি,  জামায়াতের রাজনীতি, জাসদ-বিতর্কসহ নানা বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে কথা বলেছেন আ স ম রব।

বাংলা ট্রিবিউন: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা ত্যাগের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলেন, তিনি অর্থ সহযোগিতার পাশাপাশি আপনাকে চুমুও দিলেন। এরপরের যাত্রাটা কেমন?

আ স ম আবদুর রব: আমরা ছিলাম স্বাধীনতা অন্তঃপ্রাণ। যেকোনও মূল্যের বিনিময়ে বাঙালির স্বাধীনতা ছিল আমাদের আরাধ্য। ২৫ শে মার্চের বহু পূর্বেই স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে আমরা ‘জয়বাংলা বাহিনী’ গঠন করি এবং ছাত্র-যুবকদেরকে সশস্ত্র ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। আন্দোলন-সংগ্রামকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে ধাবিত করার জন্য অসংখ্য কাজ আমাদের সম্পাদন করতে হয়েছে, সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ও নির্দেশে। এই সংগ্রামে বহু ছাত্র-যুবক অংশ নেন। অনেকেই আত্মাহুতি দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চের পূর্বেই সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের সম্ভাবনা ক্রমান্বয়ে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর রূপ ধারণ করে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-জনতার পক্ষে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের ধারা সূচিত করা হয়। ৩ মার্চ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতসহ রাষ্ট্রের মৌলিক উপাদানগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। সেদিনই ঘোষণা দেওয়া হয়— ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ৭ মার্চ বাঙালির জীবনে এক অবিস্মরণীয় দিন। বাঁধভাঙা মানুষের  ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ ইত্যাদি স্লোগান ঢাকার আকাশ-বাতাস, মাটিকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছে জনসমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গ। স্বাধীনতার জন্য একটা জাতি কী রূপ উম্মাদ এবং উদ্দাম, কী রূপ উৎকণ্ঠিত ও উদ্বেল, কী রূপ উচ্ছ্বাস ও আবেগ দ্বারা স্বতঃস্ফূর্ত তা প্রকাশ করেছে, যা ইতিহাসে  বিরল। আমার সৌভাগ্য আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ৭ মার্চের মঞ্চে অবস্থান নিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধু কর্তৃক একটি দায়িত্ব নির্দেশিত হয়ে। তখন আমাদের সবার হৃদয়ে ছিল বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন ও স্বাধীনতার কথা। অসংখ্য ঘটনা, অজস্র কর্মকাণ্ড কোনোক্রমেই একটি সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর  সঙ্গে দেখা করে, বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদ নিয়ে  আমি কলাতিয়ায় যাই। এর কিছুক্ষণ পরই পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন জায়গা ঘুরে আমি ভারতের আগরতলায় যাই।

আ স ম আবদুর রব বাংলা ট্রিবিউন: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের গল্পটা শুনতে চাই। প্রথমে কী পরিকল্পনা করলেন, কীভাবে এগুলেন যুদ্ধের পথে।

আ স ম রব: মুক্তিযুদ্ধ একটা মহাকাব্য। প্রতিরোধের আওয়াজ। এটা সহজে বলার বিষয় নয়। স্বাধীনতার লক্ষ্যে সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে ‘নিউক্লিয়াস’ গঠিত হয়েছিল ১৯৬২ সালে। পরবর্তীকালে স্বাধীনতার মন্ত্র উদযাপিত হয়। আমি এই নিউক্লিয়াসের সঙ্গে যুক্ত হই এবং দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ করি।।

বাংলা ট্রিবিউন: রাজনৈতিক দল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যান্য দলের কেমন ভূমিকা ছিল বলে আপনি মনে করেন?

আ স ম রব:  মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত জনযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ ছিল স্বাধীনতা অন্তঃপ্রাণ ছাত্র-যুবক-কৃষক ও শ্রমিকদের সমাবেশ। সামরিক বাহিনীর অংশগ্রহণ ছিল মুক্তিযুদ্ধের খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিক। এসব গভীর সত্যকে ইতিহাসে ঠাঁই দিতে হবে। কোনও একক দলের ভূমিকা নয়, সবার সম্মিলিত শক্তিতে মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয়লাভ করেছি। অগনিত মানুষের আত্মদান, সংগ্রাম ও লড়াইয়ের মাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে।

বাংলা ট্রিবিউন: এখন মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানা বিতর্ক হয়? আপনার মত কী এ বিষয়ে?

আ স ম রব: আমরা যে পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি, সেই শাসন-শোষণ আবারও পুনর্বহাল করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। ফলে আমরা উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থা এবং উপনিবেশিক মানসিকতা বা সংস্কৃতি থেকে মুক্তি লাভ করতে পারিনি। সুবর্ণজয়ন্তীতে এসেও আমরা দলীয় সংকীর্ণতা থেকে  নিজেদের উদ্ধার করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধে যার যা অবদান তা আমরা স্বীকার করতে পারিনি, আমাদের হীনম্মন্যতার কারণে। ইতিহাসের বিকৃতি যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা, তাও অনেকে  উপলব্ধি করতে পারেন না।

বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশ যে লক্ষ্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, তার কাঙ্ক্ষিত অর্জন কী সম্ভব হয়েছে?

আ স ম রব:  জনগণ মুক্তি অর্জন করবে বলেই আমাদের সশস্ত্র লড়াইয়ের নাম জনগণই নির্ধারণ করে ‘মুক্তিসংগ্রাম’ বা ‘মুক্তিযুদ্ধ’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিনির্মাণের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু ৭২ সালের সংবিধান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের দার্শনিক ভিত্তিকে উপেক্ষা করে রচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অনুপস্থিত ছিলেন। তখন নেতৃত্ব দিয়েছেন তাজউদ্দীন আহমদ। রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের রাজনীতির কারণে আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে রাষ্ট্রকে ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি।

বাংলা ট্রিবিউন: রাজাকারের একটি তালিকা তৈরি নিয়ে কাজ চলছে। এ বিষয়ে আপনি কী মনে করেন?

আ স ম রব: এগুলো চমক। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এখনও মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হচ্ছে। নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছে। যাদের বয়স ৫০ তাদেরকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

বাংলা ট্রিবিউন: বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক দলের মধ্যে মতবিরোধ থাকলেও জাতীয় ইস্যুতে তারা ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশে এর অভাব পরিলক্ষিত হয়। আপনার কী পর্যবেক্ষণ?

আ স ম আবদুর রব আ স ম রব: স্বাধীনতার পরপরই লৌহ কঠিন জাতীয় ঐক্যকে আমরা  খানখান করে দিয়েছি। বিদ্যমান ধ্বংসপ্রাপ্ত সমাজ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করার প্রয়োজনে, সমাজ রূপান্তরের প্রয়োজনে এবং একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রয়োজনে জাতীয় ঐক্য আমাদের জন্য অনিবার্য। দলীয় স্বার্থ বা ব্যক্তি স্বার্থে নয়, জনগণের স্বার্থ প্রাধান্য পেলেই জাতীয় ইস্যুতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো। ঐকমত্যের ভিত্তিতে অপশাসনকেন্দ্রিক, নিপীড়নকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার বদল করে গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে।

বাংলা ট্রিবিউন: নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন নেই। সরকারের পক্ষ থেকে বহুবার বলা হয়েছে— মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতার দায়ে দলটিকে নিষিদ্ধ করার। আপনার কী মত এ বিষয়ে?

আ স ম রব: এসব হচ্ছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির সমীকরণ। সরকারের যখন প্রয়োজন হয় তখন এক ধরনের কৌশল, আর  সরকারের সংকট সৃষ্টি হলে তখন আরেক ধরনের কৌশল।

বাংলা ট্রিবিউন: বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রসঙ্গ এলে রাজনৈতিকভাবে জাসদের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা হয়। আপনি কী মনে করেন?

আ স ম রব:  নিজেদের সব ব্যর্থতা ঢাকার জন্য আমাদেরকে দোষারোপ করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে খুন করে আওয়ামী লীগ নেতা মোশতাক আহমেদ।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
আলাপচারিতায় ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম ও মানস ঘোষমুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও সংবাদ সংগ্রহ
করারোপ নীতি শিক্ষা সম্প্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করবে: সলিমুল্লাহ খান
বাংলা ট্রিবিউনকে ওয়াসিকা আয়শা খান‘নারীরা যে শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে চলেছেন, এর নেপথ্যে শেখ হাসিনা’
সর্বশেষ খবর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ দমনে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে পুলিশ: আইজিপি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
সর্বাধিক পঠিত
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
দুর্নীতির অভিযোগ: সাবেক আইজিপি বেনজীরের পাল্টা চ্যালেঞ্জ
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সারা দেশে স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় ছুটি ঘোষণা
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া
সংঘাত বাড়াতে চায় না ইরান, ইসরায়েলকে জানিয়েছে রাশিয়া