X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২

ভারতে আটক বাংলাদেশি আবদুল্লাহ: বিয়েপাগলা নাকি জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা?

রঞ্জন বসু, নয়াদিল্লি
০৯ আগস্ট ২০১৭, ০২:৩৬আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০১৭, ১৯:০৭

ভারতে আটক বাংলাদেশি আবদুল্লাহ (ফাইল ছবি)

ভারতের দিল্লি থেকে একটানা চার ঘণ্টা ড্রাইভের পর যখন উত্তর প্রদেশের মুজফফরনগর পেরিয়ে মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) সকালে কুতেসরা গ্রামে পৌঁছালাম, তখন শ্রাবণের তুমুল বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে চারদিক। জলকাদায় থৈ থৈ, আখ-বোঝাই ট্রাক্টরে ঠাসা ঘিঞ্জি একটা গ্রাম; এ গ্রামেরই একটা এক-কামরার ভাড়াবাড়ি থেকে ঠিক ৪৮ ঘণ্টা আগে উত্তর প্রদেশের পুলিশ তুলে নিয়ে গেছে বাংলাদেশি আবদু্ল্লাহ আল মামুনকে– যাকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্য বলা হচ্ছে।

কিন্তু সত্যিই কী জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিল আবদুল্লাহ? সে-ই কী বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা জঙ্গিদের জন্য জাল পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে গোপন আস্তানা– সব কিছুর ব্যবস্থা করে দিত? এ ব্যাপারে কুতেসরা বা একটু দূরের আমবেতা শেখা গ্রামের অনেকের সঙ্গেই কথা হলো; যারা আবদুল্লাহকে ভালভাবে চিনতেন। তাদের কিন্তু এখনও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। তাদের সন্দেহ, একটু গোবেচারা ও বোকাসোকা ধরণের ওই বাঙালি মানুষটি আদৌ কী কোনও জঙ্গি সংগঠনের সদস্য ছিল!

হ্যাঁ, বাঙালি বলেই আবদুল্লাহ আল মামুনকে চিনতেন তারা; বাংলাদেশি হিসেবে নয়। আব্দুল্লাহও নিজেকে পরিচয় দিত আসামের বাঙালি মুসলিম হিসেবে। সে বলত, তার বাড়ি আসামের বঙ্গাইগাঁওয়ের কাছে। আসাম যাচ্ছি বলে বছরে দু-একবার বেরিয়েও পড়ত সে। সেটা নিয়ে কখনও সন্দেহ করার কারণও দেখেননি গ্রামবাসীরা।

কিন্তু উত্তর প্রদেশের অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াড, যারা তাকে রবিবার সকালে গ্রেফতার করেছে; তারা বলছে, বাংলাদেশ থেকে যে জঙ্গিরা উত্তর ভারতে আসত- তাদের প্রায় সবারই ‘নোডাল পয়েন্ট’ ছিল এই আবদুল্লাহ। তার কাছ থেকে বেশ কিছু জাল আধার কার্ড (ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র) ও রেশন কার্ড উদ্ধার করা হয়েছে বলেও দাবি করেছে অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াড।

কিন্তু একটু দূরের আমবেতা শেখা গ্রামে, যেখানকার স্থানীয় জামা মসজিদে গত প্রায় সোয়া বছর ধরে ইমামতি করেছে আবদুল্লাহ, সেখানকার কেউই তার জঙ্গি পরিচয়টার সঙ্গে তাকে মেলাতে পারছেন না। গ্রামের চৌপালে বসে আলম ত্যাগী নামের এক তরুণ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আরে, বাঙ্গালি ইমাম (এই নামেই আবদুল্লাহকে ডাকতেন তারা) তো শুধু তার জন্য কনে জোগাড় করে দেওয়ার কথা বলত। ও আবার কবে জঙ্গিদের সঙ্গে ভিড়ল?’

তিনি আরও জানান, গত বছর যখন থেকে আমবেতা শেখা গ্রামের মসজিদে আবদুল্লাহর ইমামের চাকরি জোটে, তখন থেকে তার ধ্যান-জ্ঞান ছিল ওটাই, একটা বউ জোটানো। যার সঙ্গে দেখা হতো, তাকেই বলত ‘এত বয়স হয়ে যাচ্ছে, আমার জন্য একটা কনে দেখে দিন না! এখানে তো আর বাঙালি পাত্রী জুটবে না, হিন্দিওয়ালিই মানিয়ে নেব না হয়!’

আমবেতা শেখ গ্রামে আব্দুল্লাহর ইমামের চাকরি পাওয়ার ব্যাপারে স্থানীয়রা জানান, চাকরিটাও পেয়েছিল সে অদ্ভুতভাবে। গ্রামের মসজিদের জন্য ইমাম চেয়ে দেওবন্দের দারুল উলুমের দেওয়ালে পোস্টার সাঁটা হয়েছিল গত বছর। সেগুলোর একটা পোস্টার ছিঁড়ে নিয়ে গত বছর রমজানের আগে এই গ্রামে আসে আবদুল্লাহ। আর কোনও প্রার্থী না থাকায় গ্রামের মুরুব্বিরাও চাকরিটা দেন তাকে। মসজিদেই থাকা-খাওয়া, সঙ্গে বেতন হিসেবে মাসে সাড়ে আট হাজার রুপি। এই চুক্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয় আব্দুল্লাহকে।

কিন্তু গোল বাঁধল আবদুল্লাহর ভাষা নিয়ে। একে তো হিন্দিতে দুর্বল, তার ওপর পশ্চিম উত্তর প্রদেশের দেহাতি ঠেট হিন্দিটা কিছুতেই রপ্ত করতে পারেনি সে। মসজিদে যে মুসল্লিরা আসতেন, তারা এই বাঙালি ইমামের কথা এক বর্ণও বুঝতে পারতেন না বললেই চলে। অবশেষে এ কারণেই তার চাকরিটা চলে যায়। এ বছর রোজার ঈদের পরেই আলবেতা শেখা গ্রাম থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে আব্দুল্লাহ চলে যায় ঠিক ১০ কিলোমিটার দূরের কুতেসরা গ্রামে। সেখান থেকেই রবিবার ধরা পড়ে সে।

এ ব্যাপারে কুতেসরা গ্রামের সাবেক মুখিয়া (মোড়ল) মহম্মদ তাজিম বলেন, ‘ও যদি জঙ্গি হয়, তাহলে অবশ্যই কঠোর সাজা হওয়া উচিত। কিন্তু ও যে জঙ্গি, তার কোনও প্রমাণ কিন্তু আমরা কখনও পাইনি।’

কুতেসরা গ্রামের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় সাত বছর ধরে এই সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ ও তার আশেপাশের এলাকায় বসবাস করছে আব্দুল্লাহ। সে কোনও জঙ্গি নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত, এমন অভিযোগ আগে কখনও ওঠেনি। পুলিশের খাতাতেও তার নামে এর আগে কোনও কেস ছিল না। ফলে আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে কোনও চার্জশিট আদৌ দাঁড়াবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ আছে বলেও ভাবছেন গ্রামের অনেকেই।

কুতেসরার গ্রামবাসীরা আরও জানান, ‘সন্দেহভাজন এ জঙ্গিকে জেরা করে উত্তর প্রদেশের পুলিশ যে তথ্যপ্রমাণ পেয়েছিল, তার ভিত্তিতে তারা দেওবন্দ থেকে সোমবার ছয় জন মাদ্রাসা ছাত্রকে তুলে নিয়ে যায়। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আটক রাখা হয় সেই ছয় ছাত্রকে। তবে কোনও অপরাধের সঙ্গে তাদের যোগসাজশ মেলেনি, ফলে তাদের সবাইকে আজ  (মঙ্গলবার) ছেড়েও দেওয়া হয়েছে।’

উত্তর প্রদেশের অ্যান্টি টেররিজম স্কোয়াডের ইতিহাস টেনে স্থানীয়রা বলছেন, এর আগেও অনেকবারই সন্দেহভাজন মুসলিম যুবকদের আটক করেছে এই স্কোয়াড, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা দাঁড় করাতে পারেনি। আটককৃতরা আদালতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত খালাস পেয়েছেন। আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে হয়তো বড়জোর বাংলাদেশ থেকে ভারতে অনুপ্রবেশ বা পরিচয়পত্র জালিয়াতির মামলা দাঁড়া করানো যাবে, কিন্তু তাকে আদালতে জঙ্গি বলে প্রমাণ করা যাবে কি না, সেই সন্দেহ প্রকাশ করছেন অনেকে।

কুতেসরা আর আমবেতা শেখা গ্রামের মুসলিমদের অনেকেই আব্দুল্লাহকে জঙ্গি ভাবতে পারছেন না, তাকে একজন সাদাসিধে বিয়েপাগলা ইমাম হিসেবে ভাবতেই আপাদত পছন্দ করছেন তারা।

/এএইচ/এমএ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
সর্বাধিক পঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
এনবিআরের আরও ৫ শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের আরও ৫ শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক