বসিলার মেট্রো হাউজিংয়ের ৯ নম্বর সড়কের শেষ মাথায় বাঁশ ও টিনের তৈরি তিন কক্ষের একটি বাড়ি। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে রবিবার (২৮ এপ্রিল) রাত ৩টার দিকে র্যাব কর্মকর্তারা ওই বাড়িতে যান। দরজায় কড়া নাড়ার পর এক নারী সাড়া দেন। দরজা খোলার অনুরোধ করলে তিনি দরজা খুলে দেন। এরপর র্যাব সদস্যরা ভেতর থেকে জিকিরের শব্দ পায়। ওই নারীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, ‘ভেতরে কারা জিকির করে, তাকে বের হতে বলেন।’ এ প্রশ্নের পরপরই গুলি শুরু হয়। পরে র্যাব ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে দূরে অবস্থান নেয় এবং পরে বাড়িটি ঘিরে ফেলে। এরপরও বাড়ির ভেতর থেকে থেমে থেমে গুলি করা হচ্ছিল।
জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে অংশ নেওয়া র্যাবের এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে এসব কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বাসার ভেতর থেকে জিকিরের শব্দ শুনে ভেবেছিলাম কেউ তাহাজ্জুতের নামাজ আদায় করতে উঠেছেন। কিন্তু যখন তাকে বের হয়ে আসতে বলি তখনই গুলি।’
র্যাব-২ কর্মকর্তা পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাসা থেকে প্রথমে চারজনকে বের করে আনা হয়। তারা হলেন বাড়ির কেয়ারটেকার সোহাগ, তার স্ত্রী মৌসুমী ও তাদের দুই সন্তান।
বাড়িটির বর্ণনা দিয়ে র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, “বাড়িটিতে দু’টি কক্ষ। একটিতে কেয়ারটেকার থাকে। আরেকটি কক্ষ কিছুদিন ধরে বাড়ির মালিক ওহাব মসজিদ বলে দান করে দিয়েছেন। আসলে সরকারি খাস জমিতে ওহাব ঘর তুলেছেন। কিছুদিন আগে বিআইডব্লিউটিএ অভিযান চালানোর পর সে ভাড়াটিয়া তুলে দিয়ে মসজিদ করে দিয়েছে। ইউসুফ নামে একজন ইমাম সেখানে নামাজ পড়াতেন। আমাদের ধারণা ছিল আরও দু’টি কক্ষ আছে। তবে মসজিদের সঙ্গে আরও একটি ছোট লাগোয়া ঘর ছিল। সেখান থেকেই বিস্ফোরণ হয়েছে।’
ভোর ৩টার দিকে গোলাগুলির পর ভোর ৫টার দিকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। জঙ্গি আস্তানার পাশের দোতলা বাড়ির ভাড়াটিয়া মিঠু হাওলাদার বলেন, ‘আমি ৭/৮ মাস ধরে পরিবার নিয়ে এখানে ভাড়া থাকি। রবিবার রাতে বিদ্যুৎ ছিল না। তাই বাসার ছাদে উঠি। বাড়ির অন্য বাসিন্দারাও ছাদে ওঠে। হঠাৎ গুলির শব্দ পাই। এরপর র্যাব এসে আমাদের ছাদ থেকে নামিয়ে দেয়। পরে বাসায় এসে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেই। এর কিছুক্ষণ পর বিকট শব্দে আবার বিস্ফোরণের শব্দ পাই। তখন র্যাব আমাদের নিরাপত্তার স্বার্থে বাসা থেকেও বের করে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘যে বাড়িটিতে বিস্ফোরণ হয়েছে সেটির মালিক ওহাব নামে এক ব্যক্তি। বাড়িটিতে কেয়ারটেকার সোহাগ, তার স্ত্রী ও দুই সন্তান থাকে। অন্য কক্ষে অনেক দিন আগে ভাড়াটিয়া ছিল। বর্তমানে বাড়ির একপাশে মসজিদ করা হয়েছে। একজন ইমাম নামাজ পড়াতেন।’
জঙ্গি আস্তানার পাশের আরেকটি বাড়িতে গরুর খামারে কাজ করেন মিন্টু নামে এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, ‘বাড়িটিতে ভাড়াটিয়া কাউকে দেখিনি। তবে কেয়ারটেকার সোহাগ তার বউ নিয়ে থাকতেন। তাদের মাঝে মাঝে দেখতাম। আমাকে বাড়ির মালিক একদিন নামাজ পড়তে ডেকেছিল, আমি যাইনি।’
মিন্টুর স্ত্রী রহিমা বেগম বলেন, ‘বাড়িটিতে নতুন মসজিদ করা হয়েছে। একজন কালো লোককে মসজিদের চারপাশে কয়েকদিন বালু দিতে দেখছি। তবে তাকে চিনি না।’
সোহাগের স্ত্রী মৌসুমীর বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাসায় কোনও ভাড়াটিয়া বর্তমানে ছিল না। দুই-তিন মাস আগে ছিল। তবে কিছু দিন আগে কেয়ারটেকারের স্ত্রী মৌসুমী বলেছিলেন বাসায় মেস ভাড়া দিয়েছে। একটা ছেলে থাকতো মেসে। তবে তাকে আমি দেখিনি। রুমটা প্রায় তালা মারা দেখতাম।’
তিনি আরও বলেন, ‘রাতে আমি শব্দ পেয়েছিলাম। পুরুষ কণ্ঠে বলতে শুনেছি, আরও মারবেন, মারেন। এরপর আমি বাসা থেকে বের হয়ে আসি।’
মেট্রো হাউজিংয়ের ৯ নম্বর সড়কের একটি বাসায় ভাড়া থাকেন আব্দুর রহীম। তিনি বলেন, জঙ্গি আস্তানায় মসজিদটি নতুন করা হয়েছিল। তাই মসজিদটির এলাকায় বেশি পরিচিতি নেই।
তিনি আরও বলেন, ‘আমি একদিন বাসা থেকে বের হয়ে হাউজিংয়ের ১ নম্বর সড়কের একটা মসজিদে জোহরের নামাজ পড়তে যাচ্ছিলাম। তখন এক লোক আমাকে বললো, এখানে মসজিদ আছে, নামাজ পড়তে পারেন। এরপর আমি ভেতরে যাই। আমি আগে জানতাম এটি বাসাবাড়ি, কিন্তু ভেতরে গিয়ে দেখি মসজিদ। তারপর নামাজ পড়ি, এরপর চলে আসি। এরপর আরও দু’দিন মাগরিবের নামাজ পড়েছি। এ সময় মসজিদে ৫/৬ জনকে নামাজ পড়তে দেখেছি। তবে কাউকে চিনতাম না। কারও সঙ্গে আমার কথাও হয়নি।’
র্যাব কর্মকর্তা ফারুকী বলেন, ‘ভ্যানচালক পরিচয় দিয়ে ১৫০০ টাকায় মসজিদের পাশে ছোট্ট একটা কক্ষ ভাড়া নেয় দুই তরুণ। তারা নিজেদের সুমন ও সুজন বলে পরিচয় দিয়েছিল বলে কেয়ারটেকার সোহাগ আমাদের জানিয়েছে। তবে তাদের বিস্তারিত পরিচয় নেয়নি কেয়ারটেকার।’
এ ঘটনায় জমির মালিক ওহাব, কেয়ারটেকার সোহাগ, সোহাগের স্ত্রী মৌসুমী, ইমাম ইউসুফকে আটক করেছে র্যাব।
জঙ্গি আস্তানার পাশের বাসিন্দারা কেউ জানেন না এখানে একটা মসজিদ আছে। নুরজাহান বেগম নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘এখানে কবে মসজিদ হলো তা আমরা কেউ জানি না। বাড়ির মালিক ডিশ ও ইন্টারনেটের ব্যবসা করেন।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার তারেকুজ্জামান রাজীব বলেন, ‘মেট্রো হাউজিং এলাকাটি আমার নির্বাচনি এলাকার বর্ধিত অংশ। ৪/৫ বছর আগে এটি হয়েছে। এখনও উন্নয়ন কাজ চলছে। যে বাড়িতে জঙ্গি আস্তানা সেটি খাস জমিতে বলে শুনতে পেরেছি। ওহাব নামে একজন সেখানে ঘর তুলেছেন। তবে তাকে আমি চিনি না।’
প্রসঙ্গত, জঙ্গিদের অবস্থানের খবর পাওয়ার পর রবিবার রাত ৩টার দিকে মেট্রো হাউজিংয়ে ওই টিনশেড বাসাটি ঘিরে ফেলেন র্যাব-২ সদস্যরা। অভিযান শুরুর পরপরই ওই বাসার ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো এবং র্যাবকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়। পরে র্যাবও পাল্টা গুলি চালায়। সকাল ৯টার পর বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটকে সঙ্গে নিয়ে র্যাবের স্পেশাল ফোর্সের সদস্যরা ওই বাড়িতে ঢোকে। ওই সময়ও সেখান থেকে কয়েক দফা গুলির শব্দ পাওয়া যায়। এরপর সকাল ১১টায় বাঁশ ও টিন দিয়ে তৈরি বাড়িটিতে হঠাৎ আগুন ধরে যায়। পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস।
এ সংক্রান্ত খবর:
র্যাবের অভিযানের মধ্যেই জ্বলে উঠলো ‘জঙ্গি আস্তানা’
দুই থানার ঠেলাঠেলিতে তথ্য ফরম নেন না বসিলার বাড়িওয়ালারা
‘জঙ্গি আস্তানায়’ বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট
বাসাটি মাস দেড়েক আগে ভাড়া নেয় দু'জন
বসিলায় জঙ্গি আস্তানা সন্দেহে এক বাসা ঘিরে রেখেছে র্যাব