X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আবারও কাঠগড়ায় দাঁড়াবে ‘মাসুদ রানা’!

উদিসা ইসলাম
১৭ জুন ২০২০, ২১:৩৫আপডেট : ১৮ জুন ২০২০, ১৩:৪৩

বাংলার জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ ‘মাসুদ রানা’র অধিকাংশ বইয়ের লেখক হিসেবে কাজী আনোয়ার হোসেনের নাম ছাপা হলেও বইগুলোর লেখক মূলত শেখ আবদুল হাকিম। কপিরাইট অফিসের এই ঘোষণার পর দুই পক্ষই আইনি লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আবদুল হাকিমের পক্ষ থেকে কপিরাইট চেয়ে আবেদন করতেও বলা হয়েছে। ফলে লড়াই এখনও শেষ হয়নি। আবারও কাঠগড়ায় দাঁড়াবে ‘মাসুদ রানা’। কাজী আনোয়ার হোসেন (বাম থেকে) ও শেখ আবদুল হাকিম

নিয়ম অনুযায়ী কপিরাইট কার্যালয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে কপিরাইট বোর্ডে আপিল করতে পারবেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সেই প্রক্রিয়া শেষ হতেও কমপক্ষে ৬ মাস সময় লাগবে।

শেখ আবদুল হাকিমের অভিযোগের ভিত্তিতে তিনটি শুনানি শেষে গত রবিবার কপিরাইট অফিস এক আদেশে বলেছে, মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক-স্বত্ব শেখ আবদুল হাকিমের৷ যদিও কাজী আনোয়ার হোসেন কপিরাইট অফিসের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন৷ তিনি বলেন, ‘আদেশের মূল কপি হাতে পেলেই আপিল করবো।’ এদিকে শেখ আবদুল হাকিম এখন তার ওই সব বইয়ের স্বত্বের জন্য আবেদন করবেন এবং বইয়ের বিপরীতে পাওনা টাকা আদায়ে প্রয়োজনে আদালতে যাবেন বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান৷

শেখ আবদুল হাকিমের সমসাময়িক বা পরবর্তীকালে সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে জড়িত লেখক ও সহকর্মীরা বলছেন, বিষয়টি আদালত পর্যন্ত না গড়ানোই সম্মানের হতো। এতে লেখক-প্রকাশক সম্পর্কে নেতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি হলো। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেবা প্রকাশনীর সাবেক এক লেখক জানান, বেশ কিছু দিন থেকেই শেখ আবদুল হাকিম কাজী আনোয়ার হোসেনকে টাকার জন্য চাপ দিয়ে আসছিলেন। মূল সমস্যা টাকাকে কেন্দ্র করেই।

কী বলছে কপিরাইট অফিস

কপিরাইট অফিস তাদের সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় বলেছে, লেখক-স্বত্ব কখনোই বিক্রয় বা ক্রয়যোগ্য নয়৷ আদেশের বিষয়ে বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শুনানির একপর্যায়ে কাজী আনোয়ার হোসেনের আইনজীবী দাবি করেন যে হাকিম সাহেব কর্মচারী ছিলেন এবং তার নির্দেশ অনুযায়ী তিনি লিখেছেন। পরবর্তীকালে সে সময় যারা সেবা প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের মতামত চাওয়া হয়। তারা প্রত্যেকে বলেন, তারা শেখ আবদুল হাকিমকে লেখক হিসেবেই দেখেছেন। আইন বলছে, কেউ ব্যবসার স্বত্ব কিনতে পারেন, প্রকাশনা-স্বত্ব কিনতে পারেন, কিন্তু লেখক-স্বত্ব নয়৷ ফলে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ নিয়ে কপিরাইট আইনের ৭১ এবং ৮৯ ধারা লঙ্ঘন হয়েছে৷

৬ যুক্তিতেই আবদুল হাকিমের জয়

বাংলাদেশ কপিরাইট অফিসের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী মোট ৬টি যুক্তির বিষয়ে উল্লেখ করে বলেন, কোন দালিলিক চুক্তি না থাকার কারণে এবং আবদুল হাকিমের যুক্তিগুলোর সপক্ষে আইনি অবস্থান থাকায় এমন আদেশ হয়েছে। ছয়টি যুক্তির উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি জানান, কাজী আনোয়ার হোসেন নিজে গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন তিনি আর ‘মাসুদ রানা’ লেখেন না। হাকিমসহ কয়েকজন তা লেখেন। একইসঙ্গে ‘মাসুদ রানা’ সিরিজের একাধিক বইতে আলোচনা বিভাগে কাজী আনোয়ার হোসেন স্বীকার করেছেন, তিনি ‘মাসুদ রানা’ সিরিজ লেখেন না। ‘মাসুদ রানা’ ও ‘কুয়াশা’ সিরিজের বইগুলো কোন বইয়ের ছায়া অবলম্বনে কীভাবে লেখা হয়েছে সেটি আবদুল হাকিম বলতে পারবেন, কাজী আনোয়ারের পুরোটা জানাও নেই।

এদিকে মাসুদ রানার লেখক হিসেবে হাকিমকে স্বীকার করে কাজী আনোয়ার হোসেনের স্বহস্তে লেখা চিঠি আছে। কয়েকটি বইয়ের পাণ্ডুলিপি শেখ আবদুল হাকিমের কাছে এখনও আছে। নামধন্য ব্যক্তিরা তার পক্ষে সাক্ষ্যও দিয়েছেন। তবে কপিরাইট অফিস এও মনে করেন, মাসুদ রানার স্রষ্টা কাজী আনোয়ার হোসেন।

এখন কী হবে ‘মাসুদ রানা’র

কপিরাইট কার্যালয়ের এই আদেশের পর এখন তাহলে মাসুদ রানা কার? এর প্রকৃত উত্তর পেতে আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। কাজী আনোয়ার হোসেন আপিল করবেন বলে ইতোমধ্যে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। তিনি আপিল করলে সেটার তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে কী আদেশ হয় সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

শেখ আবদুল হাকিম পরবর্তী কার্যক্রম বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমার পক্ষ থেকে ওই সুনির্দিষ্ট বইগুলোর স্বত্ব চেয়ে আবেদন করতে হবে। যদি সমঝোতা হয়, তাহলে আর পরবর্তীতে আদালতে মামলার প্রয়োজন হবে না৷ আমি তো আমার প্রাপ্য টাকার জন্য শেষ পর্যন্ত লড়াই করবো। তবে এখন আমাকে উনাদের আপিলের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। এরইমধ্যে তিনি বিভিন্ন গণমাধ্যমে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন সেসবের কোনও ভিত্তি নেই।’

কপিরাইট কার্যালয়ের রেজিস্ট্রার জাফর রাজা চৌধুরী পরবর্তী প্রক্রিয়ার বিষয়ে বলতে গিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, আগামী ৯০ দিনের মধ্যে কাজী আনোয়ার হোসেন কপিরাইট বোর্ডে আপিল করার পরে উভয়পক্ষকে আবার নোটিশ করা হবে। কাজী আনোয়ার হোসেনের নতুন কোনও বক্তব্য থাকলে সেটা তিনি ব্যাখ্যা করবেন। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের একটি কমিটি দিয়ে বোর্ড গঠন হয়। সেখানে রেজিস্ট্রার হিসেবে থাকবো কিন্তু বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ থাকবে না। বছরে বোর্ড কয়বার বসবে বিদ্যমান আইনে সেটি নির্ধারিত নেই। তবে দুই থেকে তিনবার বসে। ফলে এই প্রক্রিয়া শেষ হতে অন্তত আরও ৬ মাস লাগতে পারে। এরপর কপিরাইট বোর্ডের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে সংক্ষুব্ধ পার্টি হাইকোর্টে যেতে পারবে। হাইকোর্ট ছাড়া অন্য কোনও আদালতে তারা যেতে পারবেন না।

সেবার লেখক প্রতিক্রিয়া
শেখ আবদুল হাকিম সাহেবের অভিযোগে দুর্বলতা আছে উল্লেখ করে চিত্রকর হাশেম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি যতটা চিনি কাজী আনোয়ার হোসেন লোক ঠকানো মানুষ নন। পরবর্তীকালে চেঞ্জ হয়েছে কিনা জানি না। তাদের মধ্যে অন্য কিছু নিয়ে মনোমালিন্য হয়েছে কিনা তাও জানি না। কিন্তু বিষয়টি পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সমাধান করা যেত। আমার কাছে কপিরাইট অফিস কিছু বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। আমি সেসব নিজ হাতে লিখে দিয়েছি। পাণ্ডুলিপি আইনে যা জানি বলেছি। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে আবদুল হাকিমকে লেখক করেছেন আনোয়ার হোসেন, লিখে সংসার চালানো যায় সেই সময়ে সেটা আনোয়ার হোসেন করে দেখিয়েছেন। আবদুল হাকিম পাণ্ডুলিপি দিয়েছেন, প্রয়াত সাংবাদিক শাহাদাত সাহেব সে সময় লিখেছেন, আরও অনেকে ছিলেন। সেটাকে নিজের ভাষা দিয়ে উপযুক্ত করে তুলেছেন কাজী আনোয়ার। মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের মধ্যে কোনও লিখিত চুক্তি না থাকা।

বাংলাদেশের প্রকাশনা জগতে বেশিরভাগ কাজ মৌখিক চুক্তিতেই হয়ে থাকে। এই মামলার কারণে সেটি প্রকাশক-লেখক সম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়ে গেলো কিনা প্রশ্নে ওয়েস্টার্ন সিরিজের লেখক রওশন জামিল চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই উদাহরণ ভবিষ্যতের জন্য বাজে দৃষ্টান্ত রেখে গেলো। লেখকরা প্রকাশককে যেকোনও সময় টেনে আদালতে নিয়ে গিয়ে দাবি উত্থাপন করবেন, প্রকাশকদের পক্ষ থেকেও সেটা করার রাস্তা তৈরি হলো। এটা সবাই জানেন লেখক-প্রকাশকের মধ্যে একটা চুক্তিগত ফাঁক আমাদের দেশে রয়ে গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক লেখক বলেন, ‘এসবের কোনও দরকার হতো না। টাকার জন্যই মূল সমস্যা তৈরি হয়েছে। যতক্ষণ মনোমালিন্য হয়নি ততক্ষণ মৌখিক চুক্তিতেই হয়েছে সবকিছু, কোন সমস্যা হয়নি। এটা আদালতের বাইরে যদি সমাধান করা যেতো তাহলে সবার জন্যই মঙ্গল হতো। আর যাই হোক কাজী সাহেব কারোর টাকা মেরে নিয়েছেন এমন কেউ শোনেনি। কিন্তু তিনি অল্পে রেগে যান। আর রেগে গেলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে কতকিছুই তো বলে।’

/এফএএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করারোপ: আইনের বিশ্লেষণ
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
ইউক্রেনের মার্কিন সামরিক সহায়তা আইনে স্বাক্ষর বাইডেনের
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
নামাজ শেষে মোনাজাতে বৃষ্টির জন্য মুসল্লিদের অঝোরে কান্না
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগে বৃষ্টির আভাস
সর্বাধিক পঠিত
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
সিয়াম-মেহজাবীনের পাল্টাপাল্টি পোস্টের নেপথ্যে…
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
‘মারামারি’র ঘটনায় মিশা-ডিপজলের দুঃখপ্রকাশ
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা
‘বয়কট’ করা তরমুজের কেজি ফের ৬০ থেকে ১২০ টাকা