X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে সাহেদের ভয়ঙ্কর প্রতারণা

আমানুর রহমান রনি
১৭ জুলাই ২০২০, ১২:৫৯আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২০, ১৪:৩৯

সাহেদ ও জাহিদ এক নিরাপত্তাকর্মীর সঙ্গে ভয়ঙ্কর প্রতারণা করেছে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ। সাহেদের মারধরের শিকার হয়ে ওই নিরাপত্তাকর্মী প্রায় পঙ্গু জীবনযাপন করছেন। করেছেন কারাভোগ এবং হারিয়েছেন বেঁচে থাকার সম্বল বাপ-দাদার জমি।

ওই নিরাপত্তাকর্মীর নাম মো. জাহিদ (৪৭)। বাড়ি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলায়। বাবা রহমত উল্লাহ অনেক বছর আগেই মারা গেছেন। দরিদ্র পরিবারে জন্ম, তাই লেখাপড়া করা হয়নি। বাবার মৃত্যুতে ধরতে হয়েছে সংসারের হাল। মা, স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে তার সংসার। সিলেট সিটি করপোরেশনে নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করতেন জাহিদ। মেয়র বদরউদ্দিন আহমেদ কামরানের দফতরেই তিনি ডিউটি করতেন। ২০০৪ সাল থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত সিলেট সিটি করপোরেশনে চাকরি করেন জাহিদ। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সিলেটের কিচেন মার্কেট মামলা হয় মেয়রের বিরুদ্ধে। তখন সাহেদ মেয়রের সঙ্গে দেখা করতে সিলেট গিয়েছিল। ওই সময় সাহেদের সঙ্গে নিরাপত্তাকর্মী জাহিদের পরিচয়।

জাহিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘তিনি (সাহেদ) আমাকে একটা ভিজিটিং কার্ড দিলেন। তখন তাকে দেখে ভদ্রলোকের মতো লাগছিল। তিনি আমাকে বলেছিলেন, চাকরি লাগলে যেন তাকে ফোন দেই। ঢাকায় তার অফিস আছে। এরপর মেয়র গ্রেফতার হয়, আমার চাকরি চলে যায়। এরপরও আমি সিলেটেই ছিলাম। টুকটাক কাজ করতাম।’

২০১৭ সালের প্রথম দিকে মোহাম্মদ সাহেদের দেওয়া ভিজিটিং কার্ডে থাকা মোবাইল নম্বরে ফোন দেয় জাহিদ। ফোন দিয়ে জাহিদ চাকরি চায় সাহেদের কাছে। সাহেদ তাকে মোটা অংকের বেতনের আশ্বাস দিয়ে ঢাকায় আসতে বলে। জাহিদ ওই বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে কুলাউড়া থেকে ঢাকায় আসে। সাহেদের সঙ্গে দেখা করে। সাহেদ তাকে বলে, ‘তুমি প্রধান নিরাপত্তাকর্মী, তোমার বেতন ২৫ হাজার টাকা। তুমি ভালো বেতন পাবা, তোমার অধীনে আমার প্রতিষ্ঠান থাকবে, তাই তোমাকে জামানত দিতে হবে। তুমি এক লাখ টাকা জামানত দিবা। তাহলে তোমার চাকরি কনফার্ম।’

বাড়িতে গিয়ে ৫ শতাংশ জমি আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করেন জাহিদ। এক লাখ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসেন। পুরো টাকা তিনি সাহেদের কাছে জমা দেন। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রিজেন্ট হাসপাতালের মিরপুর শাখায় জাহিদ প্রধান নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ শুরু করে।

জাহিদ মিরপুর রিজেন্টে যোগদানের পর তার প্রতিদিনই নতুন অভিজ্ঞতা হয়। সাহেদ স্টাফদের সঙ্গে কথায় কথায় খারাপ ব্যবহার করে। কাউকে কাউকে মারধর করে। পান থেকে চুন খসলেই সাহেদ এমন ব্যবহার করতো। জাহিদ ফেব্রুয়ারি মাস চাকরি করার পরই হাসপাতালের ম্যানেজারকে বলেন, ‘আমি চাকরি করবো না, আমার জামানত ফেরত দিন।’ রিজেন্টের ম্যানেজার জাহিদের এই সিদ্ধান্তের কথা সাহেদকে জানান। সাহেদ তখন জাহিদকে লিখিত অব্যাহতিপত্র দিতে বলে। জাহিদ তাই করেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বেতন ও জামানতের টাকার জন্য ঢাকায় থাকে জাহিদ।

জাহিদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মিরপুরের ইলিয়াস মোল্লা মার্কেটের পেছনের একটি মেসে থাকতাম। আমি আমার এক লাখ টাকা জামানত ও একমাসের বেতনের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ১৩ মার্চ আমি বেতন ও জামানত আনার জন্য রিজেন্ট হাসপাতালে যাই। তখন আমাকে হাসপাতালের ম্যানেজার ও দুজন ব্যক্তি সাহেদের কক্ষে নিয়ে আটকে রাখে। কিছুক্ষণ পর সাহেদ আসে। সে এসেই আমার পিঠে ও কোমরে মেডিক্যালের হাতুড়ি দিয়ে পেটাতে থাকে। আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। এরপর পল্লবী থানায় খবর দেয় সাহেদ। পুলিশ এসে আমাকে নিয়ে যায়। পরে শুনি আমাকে চুরির মামলা দিয়েছে। আমি পুলিশকে এত বললাম, কেউ আমার কথা শুনলো না। থানায় নেওয়ার পর পুলিশ আমাকে আবার মারলো।’

কাঁদতে কাঁদতে জাহিদ বলেন, ‘থানা থেকে আমাকে আদালতে চালান দিলো। ঢাকায় আমার কেউ নেই। আমি কাউকে চিনি না। আদালত থেকে আমাকে কারাগারে পাঠালো। ১৫ দিন পর কারাগার থেকে আবার আমাকে আদালতে নিয়ে এলো পুলিশ। আমাকে কাঠগড়ায় তুললো। আমি হাঁটতে পারছিলাম না। কারণ, সাহেদ আমাকে মেরে কোমর ফাটিয়ে দিয়েছিল। তাই কাঠগড়ায় বাঁকা হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। সেখানে আমি কাঁদছিলাম। আমার কান্না দেখে একজন মুহুরি বিস্তারিত জানতে চাইলো, আমি তাকে বিস্তারিত বললাম। তিনি একটা ওকালতনামা আনলেন, আমি তাতে স্বাক্ষর করলাম। ঠিকানা বললাম। কিন্তু বাড়িতে কারও মোবাইল ছিল না। তাই খবর দিতে পারিনি। আমাকে আবার জেলখানায় নিয়ে গেলো। মুহুরি আমাকে বললো সে জামিন করানোর চেষ্টা করবে।’ ঘটনার দুই মাস পর আবার মামলার তারিখ আসে। জাহিদকে কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসে পুলিশ। তার জামিন হয়। এরপর বাড়ি ফিরেন তিনি।

জাহিদ ২০১৭ সালের শেষের দিকে কুলাউড়া থেকে আবার ঢাকায় আসেন। মেরুদণ্ডের আঘাতের কারণে তিনি কুঁজো হয়ে হাঁটতেন। তার কোমরে ঘা হয়ে গিয়েছিল। ঢাকায় এসে মিরপুরের স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেন। পরবর্তীতে তিনি এই সংসদ সদস্যের ভাই আশিক মোল্লার সঙ্গে দেখা করেন। জাহিদ বলেন, ‘আমি আশিক মোল্লাকে সব বললাম। তিনি আমার আঘাত দেখে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। কিছু টাকা দেন। আমি চিকিৎসা করি। সাহেদ খারাপ লোক তাকে কেন টাকা দিয়েছি, সেটা নিয়ে আশিক মোল্লা আমাকে বকা দেন। এমন ভুল যেন আর না করি, তিনি সতর্ক করে দেন।’

চিকিৎসা নিয়ে একটু সুস্থ হয়ে ফের বাড়িতে যান জাহিদ। এরমধ্যে পল্লবী থানা পুলিশ তার বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। জাহিদকে বাড়ি থেকে এসে নিয়মিত মামলার হাজিরা দিতে হয়। তবে উকিলকে কোন ফি দিতে পারতেন না তিনি। উকিলের কাছে সবকিছু খুলে বলেন। মামলা সাক্ষী পর্যায়ে চলে যায়। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে জাহিদের আইনজীবী সবকিছু ঢাকার সিএমএম’র সংশ্লিষ্ট আদালতে খুলে বলেন। বিচারক জাহিদকে খাস কামরায় নিয়ে পুরো বক্তব্য রেকর্ড করেন। এরপর জাহিদ মামলা থেকে অব্যাহতি পান। জাহিদের দুর্দশা ও দরিদ্রতার কথা শুনে বিচারক তাকে কিছু টাকা পয়সা দিয়েও সহযোগিতা করেন বলে জানান তিনি।

জাহিদ বলেন, ‘বিচারককে আমি সব বললাম, তিনি সব লিখলেন। এরপর আমি খাস কামরা থেকে চলে আসার সময় তিনি আমাকে কিছু টাকা দেন। আমি চলে আসি। এরপর মামলা থেকে আমি অব্যাহতি পেয়েছি।’

মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে জাহিদ ২০১৮ সালে ফের তার জামাননের টাকার জন্য রিজেন্টের মিরপুর হাসপাতালে যায়। সেখানে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়। জাহিদ বলেন, ‘নিরাপত্তাকর্মীরা আমাকে বলেছে সাহেদ আবার তাকে মারধর করবে। আটকে রাখবে। তারপর চলে আসি। আমি অনেকের কাছে বলেছি, থানায় মামলা দিতে চেয়েছি, কিন্তু আমাকে কেউ সহযোগিতা করেনি।’

সাহেদের রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর নিজের অভিযোগ নিয়ে তিনি র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। র‌্যাব তাকে সহযোগিতা করার ও আইনি পরামর্শ দিয়েছে। তবে জামানতের টাকার কোনও ডকুমেন্ট তার কাছে নেই। মামলা করারও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না অসহায় এই মানুষটি। জাহিদ বর্তমানে একটি গ্যাস কোম্পানির অফিস দেখাশোনা করেন।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগের বিষয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল বাতেন বলেছেন, ‘সাহেদের বিষয়ে কোনও ভুক্তভোগী এলে আমরা তাদের আইনি সহযোগিতা দেবো।’

ভুয়া করোনা রিপোর্ট প্রদানসহ নানা প্রতারণার অভিযোগে গত ৬ জুলাই রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব-১। সিলগালা করে দেওয়া হয় রিজেন্টের উত্তরা ও মিরপুরের দুটি শাখা। ১৫ জুলাই ভোরে সাতক্ষীরার সীমান্ত এলাকা থেকে সাহেদকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। সাহেদসহ রিজেন্টের ১১ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী গ্রেফতার হয়েছে। এদের মধ্যে সাহেদ ও রিজেন্টের এমডি ডিবি রিমান্ডে রয়েছে।

/এমআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাফাহ শহরে নতুন করে  ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
রাফাহ শহরে নতুন করে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ