X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন নতুন কৌশলে ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুরা

আদিত্য রিমন
১৭ আগস্ট ২০২০, ১৪:০০আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০২০, ০৮:২৮

নতুন নতুন কৌশলে ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুরা

রাজধানীর বিজয় সরণির মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যালের কারণে আটকে আছে শত শত গাড়ি। কোনও বলা-কওয়া ছাড়াই হঠাৎ করে পাশের ফুটপাত থেকে ৫-৬ জন শিশু রাস্তায় নেমে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা মোটরসাইকেল এবং প্রাইভেটকার একের পর এক মুছতে শুরু করে। এরপর শুরু করে ভিক্ষা চাওয়া। তাদের আচমকা এমন আচরণে গাড়িতে বসে  থাকা মানুষেরা কিছুটা বিব্রত বোধ করেন, তারপর যেন অনেকটা বাধ্য হয়েই ভিক্ষা দেন। শুধু বিজয় সরণির মোড়েই নয়, রাজধানীর বিভিন্ন ট্রাফিক সিগন্যালে দেখা মেলে প্রায় একই চিত্র। মারাত্মক  দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়েই নতুন এই কৌশলে ছোট ছোট শিশুরা প্রতিনিয়ত ভিক্ষাবৃত্তি করছে।   

সিগন্যাল উঠে যাওয়ামাত্র গাড়ি চলতে শুরু করলে এই শিশুরা পাশের ‘বিজয় সরণি ফোয়ারা’র নিচে গিয়ে অবস্থান নেয়। বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) বিকালে সেখানে কথা হয় আকলিমা, রিফাত, সায়েম, রুবেল, মারুফ ও পরশের সঙ্গে।  তাদের কারও বয়সই ৮ বছরের বেশি নয়। এই শিশু ভিক্ষুকরা জানায়, তারা সবাই তেজকুনিপাড়া বস্তির বাসিন্দা। ভিক্ষা করার কারণে দিনের বেশিরভাগ সময় তাদের কাটে বিজয় সরণির ৮ রাস্তার ট্রাফিক সিগন্যালে। দেখা গেলো, বিকাল শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলেও তাদের কারোরই বাসায় ফেরার তাড়া নেই।

এই শিশুরা জানায়, দেশে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের আগে তারা সবাই স্কুলে যেতো। তখন মাঝে মধ্যে বিভিন্ন দোকানে গিয়ে ভিক্ষা করতো। কিন্তু করোনার কারণে এখন তাদের স্কুল বন্ধ। একই কারণে  রাজধানীর বেশিরভাগ দোকানও বন্ধ রয়েছে। তাই তারা এখন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি রাস্তার মোড়ে, সিগন্যালে ভিক্ষা করছে। এমনকি দুপুরে খাওয়ার জন্য সবদিন বস্তিতেও যাওয়া হয় না। ভিক্ষা করে পাওয়া টাকায় ফুটপাত থেকে আমড়া, পপকন, আলুর চিপস কিনে খেয়েই দিন পার করে দেয়। রাতে বস্তির বাসায় গিয়ে ভাত খায় তারা।

নতুন নতুন কৌশলে ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুরা

গাড়ি মুছে দিয়ে টাকা চাওয়ার এই কৌশল তাদের কে শেখালো জানতে চাইলে রুবেল বলে, ‘কেউ শেখায়নি। আমরা নিজেরাই এটা শুরু করেছি। এমনে চাইলে মানুষ ভিক্ষা দেয় না। তাই গাড়ি মুছে দিয়ে টাকা চাই। তখন দেয়।’

তোমাদের তো কেউ  গাড়ি মুছতে বলে না, তাহলে কেন এটা করো প্রশ্নে রুবেল চুপ থাকে। পাশ থেকে রিফাত বলে, ‘গাড়ি মুছে দিলে স্যারেরা খুশি হয়ে টাকা দেন। এই জন্য মুছে দেই।’

বস্তিতে দাদির সঙ্গে থাকে মারুফ। মা তার মারা গেছে ডায়াবেটিসে জানিয়ে মারুফ বলে, ‘বাবা রিকশা চালান। কিন্তু সব সময় দাদিকে টাকা দেন না। দাদি আগে মানুষের বাসায় কাজ করতেন। এখন কাজ কমে গেছে।’ মারুফ এখন  প্রতিদিন ৩০-৪০ টাকা করে দাদিকে দেয়। শুধু মারুফ নয়, তারা প্রত্যেকেই দিন শেষে ভিক্ষা থেকে আয়ের একটা অংশ  তাদের সংসারে দিয়ে থাকে। 

স্কুল খুলে গেলে তারা কি ফিরে যাবে জানতে চাইলে আকলিমা বলে, ‘মা বললে যাবো। না হলে আর যাবো না।’

এই শিশুদের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তার পাশেই আমড়া বিক্রি করছিলেন মো. কামাল। তিনি বলেন, ‘শুরুর দিকে এই শিশুদের সঙ্গে তাদের মায়েরাও এখানে আসতেন। কিন্তু গত ১-২ মাস থেকে শিশুরা নিজেরাই সকাল থেকে  বিকাল পর্যন্ত একা-একা সিগন্যালে এভাবে ভিক্ষা করে। দুপুরের দিকে গরম বেশি পড়লে ফোয়ারার পানিতে গোসল করে নেয়। সারাদিন ওরা এখানে থাকে।’  

তেজগাঁওয়ে নাবিস্কোর মোড়ে প্রধান সড়কে গাড়ি মুছে দিয়ে ভিক্ষা করছে শিশু হানিফ, বয়স আনুমানিক ৪-৫ বছর। হানিফ জানায়, তার ভাইও সিগন্যালের পাশের রাস্তায় (সাত রাস্তার দিকে যাওয়ার সড়কে) তার মতো একই কাজ করছে। বেগুনবাড়ি বস্তিতে মায়ের সঙ্গে থাকে তারা। হানিফদের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সেখানেও তার আরেকজন মা আছেন। হানিফও কিশোরগঞ্জে  থাকতো এবং স্কুলেও যেতো। ঈদের সময় ঢাকার মা বাড়িতে গিয়ে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে, জানালো হানিফ।

জুলাই মাসে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য প্রতিষ্ঠান সেভ দ্য চিলড্রেনের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘‘করোনাভাইরাসের  সংক্রমণের পর প্রায় এক কোটি শিশু আর স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না। শিক্ষা তহবিল কাটছাঁট ও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার কারণে এই বিরাট সংখ্যক শিশু স্কুল থেকে ঝরে যাবে। ‘শিক্ষার লুপ্ত সংকটাপন্ন অবস্থা’য় গরিব শিশুদের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। আর শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার কারণে অনেক দরিদ্র পরিবারের শিশুরা স্কুলে যেতে পারবে না। পরিবারে অভাবে কারণে তারা ভিক্ষায় নেমে পড়েছে। আবারও অনেকে শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়বে। বস্তির শিশুরা বেশি ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত হবে।’’

নতুন নতুন কৌশলে ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুরা

রাজধানীতে দেখা গেছে, শুধু ট্রাফিক সিগন্যালেই নয়, অনেক দরিদ্র মা-বাবা তাদের শিশুদের সঙ্গে নিয়ে যেখানে-সেখানে ভিক্ষা করছে। কারণ, বয়স্কদের থেকে মানুষ শিশুদের বেশি ভিক্ষা দেয়। এই কারণে ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুদের ব্যবহার বাড়ছে। আবার ভিক্ষাবৃত্তি হচ্ছে অর্থ উপার্জনের  সবচেয়ে সহজ উপায়ও। তাই শিশুরাও ভিক্ষাবৃত্তিতে আসছে। এছাড়া বিভিন্ন অপরাধী চক্রও বিভিন্নভাবে কৌশলে শিশুদের ভিক্ষা করতে বাধ্য করে থাকে।

রাজধানীর মিরপুর-১০ নম্বর গোল চত্বরে বাবা সাইদুল হকের সঙ্গে  ভিক্ষা করছে ছয় বছরের মেয়ে শিশু সাদিয়া। সাইদুল হকের গলায় ঝুলানো আছে একটি হাসপাতালের ডাক্তারের দেওয়া ওষুধের ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন)। সেটি দেখিয়ে শিশু মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে এই বাবা ভিক্ষা করছেন।

সাইদুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তার একটি কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। অভাবের কারণে চিকিৎসা সম্পূর্ণ করতে পারছেন না। তাই ভিক্ষা করছেন।

ভিক্ষা করতে মেয়েকে কেন এনেছে  জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বেশিক্ষণ হাঁটতে পারি না। তাই সঙ্গে মেয়ে সাদিয়াকে রেখেছি। সে-ই আমাকে সাহায্য করে।’

মেয়ের লেখাপড়ার বিষয়ে সাইদুল হক বলেন, ‘আগে আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করতাম। তখন মেয়ের স্কুলের খরচ চালাতে কোনও সমস্যা হতো না।  গত  এক বছরের বেশি সময় ধরে অসুস্থ থাকার কারণে কাজ করতে পারি না। তাই মেয়ের লেখাপড়াও বন্ধ।’ সাদিয়ার অসহায় বাবার প্রশ্ন—‘গরিবের মেয়ে লেখাপড়ার খরচ কে দেবে?’

রাজধানীর আসাদ গেটে ছোট দুইটি শিশুকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষা করছেন মা  মরিয়ম বেগম। তিনি বলেন, ‘ভিক্ষা না করলে খামু কী। বাচ্চাদের খাওয়ামু কী। আমাদের কোনও ঘরবাড়ি নেই। ফুটপাতে থাকি।’

নতুন নতুন কৌশলে ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুরা

তিনি আরও বলেন, ‘সবাই বলে ভিক্ষা করো কেন, কাজ করে খাও। কিন্তু কেউ তো কাজও দেয় না। আমরা গরিব, আমাদের ছেলেমেয়েরাও গরিবই থাকবে।’         

শিশু আইন ২০১৩ অনুসারে, কোনও ব্যক্তি যদি শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেন, বা শিশুকে দিয়ে ভিক্ষা করান, অথবা শিশুর হেফাজত, তত্ত্বাবধান বা দেখাশোনায় নিয়োজিত কোনও ব্যক্তি শিশুকে ভিক্ষার উদ্দেশ্যে নিয়োগদানে প্রশ্রয়দান বা প্রদান করেন, তাহলে সেটা অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য ওই ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছরের কারাদণ্ড, অনধিক এক লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। শিশুদের ভিক্ষা বন্ধে এ ধরনের কঠোর আইন থাকলেও আইনের বাস্তবায়ন না থাকায়  প্রকাশ্যে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তিতে ব্যবহারের ঘটনা ঘটছে হরহামেশাই।

বাংলাদেশে কত শতাংশ শিশু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত আছে, সরকারি বা বেসরকারি কোনও প্রতিষ্ঠানের কাছেই এর কোনও হিসাব নেই। 

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি স্থায়ী কোনও কিছু না। শিশুরা ভিক্ষাবৃত্তিতে খুব একটা নেই। এরা রাস্তাঘাটে ফুলসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি করে। আবার কোনও সময় ভিক্ষাও করে। আর যেটা আছে তার পরিসংখ্যান এই মুহূর্তে বলতে পারবো না।’

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের গবেষণা সেলের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে তারা  ‘ভিক্ষাবৃত্তিতে শিশুদের ব্যবহার’ নিয়ে একটা জরিপ করেছিল। এরপর এ নিয়ে আর কোনও কাজ হয়নি। একই কথা জানিয়েছে সেভ দ্য চিলড্রেনও।

ছবি: সাজ্জাদ হোসেন  ও আদিত্য রিমন

/এপিএইচ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
গুলিস্তানে দুই জনের মৃত্যু, সন্দেহ ‘হিট স্ট্রোক’  
এসি বিক্রি বেড়েছে তিনগুণ, অনেক ব্রাঞ্চে ‘স্টক আউট’
সর্বশেষ খবর
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া