শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আন্ডারগ্রাউন্ড। সিঁড়ি দিয়ে নেমে হাতের ডান দিকে তাকাতেই চোখে পড়ে সারি সারি কফিন। কিছুটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে এক বাবা দাঁড়িয়ে কফিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, কিন্তু তার চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। কাছে যেতেই জানালেন তার নাম আনোয়ার হোসেন। হাসপাতালে অপেক্ষা করছেন ছেলের জন্য। ‘ছেলেটা বাইচা নাই, মইরা গেছে,’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন রিকশাচালক আনোয়ার হোসেন। আরেক দগ্ধ ১৫ বছরের মঈনুদ্দীনের মা মর্জিনা বেগম ছেলের লাশ বলেই স্বীকার করতে চাইলেন না একটি মৃতদেহকে। ‘আহা, আমার বাবায় কই রে!’ বলে এই মায়ের সে-কী আহাজারি! তার আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। এভাবেই স্বজনহারা মানুষগুলো কেউ ডুকরে আবার কেউবা চিৎকার করে কেঁদে উঠছিলেন।
নারায়ণগঞ্জের পশ্চিম তল্লা বায়তুস সালাত জামে মসজিদে একসঙ্গে ছয়টি এসির বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৪ জনে দাঁড়িয়েছে। তারা সবাই রাজধানীর শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মোট চিকিৎসাধীন ছিলেন ৩৭ জন।
আর এ ঘটনায় কেবল স্বজনরা নয়, ইনস্টিটিউটে দায়িত্বরত চিকিৎসকরাও কেঁদেছেন, কাঁদছেন। বছরের পর বছর ধরে চোখের সামনে দগ্ধ মানুষদের দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া চিকিৎসকদের মনের ভেতর কেমন হয়– জানতে চাইলে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহকারী পরিচালক ডা. হোসাইন ইমাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের ঠিক না থেকে উপায় নেই।’ চোখের সামনে দগ্ধদের মারা যাওয়ার নিদারুণ কষ্টের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এই চিকিৎসক বলেন, ‘রোগী তো সব চলে যাচ্ছে, তাদের তো ধরে রাখতে পারছি না…। যেখানে বাঁচার আশা করার কিছু নেই, এর থেকে বড় হতাশার কিছু নেই, থাকতে পারে না!’
শুক্রবার দিবাগত রাতে যখন রোগীদের আনা হয় তখন থেকে রাত আড়াইটা পর্যন্ত ডা. হোসাইন ইমাম দায়িত্ব পালন করেছেন। এরপর শনিবার সকাল থেকে রাত পর্যন্ত দেখেছেন ৩৭ জন পুড়ে যাওয়া রোগী আসা থেকে ২১ জন মানুষের চলে যাওয়া। হাসপাতালের পরিস্থিতি জানতে চাইলে বলেন, ‘গতকাল রাত সাড়ে ৮টা অথবা ৯টার দিকে প্রথম ফেসবুকে জানতে পারি। তারপর হাসপাতালকে জানাই “অ্যালার্ট” হওয়ার জন্য, এটা আমাদের দায়িত্ব। তারপরই ফোন পাই প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জন রোগী এসেছে হাসপাতালে। তখনই চলে আসি হাসপাতালে। ইতোমধ্যে ইনস্টিটিউট পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সঙ্গেও কথা হয় আমার।’
‘হাসপাতালে এসে দেখি ম্যাসিভ অবস্থা…মানুষজন গড়াগড়ি খাচ্ছে। মানুষ আগুনে পুড়ে গেলে পেইন হয়। পোড়ার কারণে প্রচণ্ড জ্বালা করে’, বলেন তিনি।
ইনস্টিটিউটে দগ্ধদের আনার পরের পরিস্থিতি বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘দগ্ধদের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে, চেহারা চেনা যাচ্ছে না। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। হাত-পা সব পোড়া, একটা ক্যানুলা দেওয়ার অবস্থা পর্যন্ত নেই। বেশিরভাগ মানুষের ৯৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের ড্রেসিং করে র্যাপ আপ করা…একটা মানুষের ড্রেসিং করতে কমপক্ষে আধাঘণ্টা সময় চলে যায়। কিন্তু এই রোগীগুলোর এত সময় নেই, তখন ডা. পার্থ, ডা. হেদায়েত, ডা. মামুন, ডা. লেলিন, ডা. আবীরসহ প্রতি ফ্লোরে একজন করে সিস্টার থেকে সব সিস্টাররা হাসপাতালের নিচতলায় নেমে আসেন। পরে যুক্ত হন অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদও। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম উপস্থিত হয়ে রোগীদের চিকিৎসা দিয়েছেন।
‘সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে পোস্ট অপারেটিভ ওয়ার্ডে তাদের স্থানান্তর করা হয়েছে। সে সময় রোগীদের আহাজারির মধ্যে আমরা। প্রচণ্ড জ্বালাপোড়ায় চিৎকার করছিলেন তারা। এক বেডে একজন চিৎকার করলে তার কাছে যাই তো আরেক বেড থেকে আরেকজন চিৎকার করে ওঠেন।…তারপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, রোগীদের ঘুম পাড়াতে হবে যেভাবে হোক। তখন তাদের ঘুমের ব্যবস্থা করা হয় ওষুধ দিয়ে।’
ডা. হোসাইন ইমাম বলেন, ‘রোগীদের ভেতরে সাত বছরের একটা বাচ্চা ছিল। তার মা পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাকে আমরা বললাম, আপনি চলে যান, আমরা এখন বাচ্চাটার সেন্ট্রাল লাইন দেব। মা চলে গেলেন। এরপরই যখন বাচ্চাটাকে সেন্ট্রাল লাইন দিতে যাবো, তখন বাচ্চাটা চুপ হয়ে গেছে। সে মারাই গেলো।
‘আমাদের কাছে খারাপ লাগছিল, বাচ্চাটার মাকে আমরা বের করে দিলাম, ঠিক তখনই সে মারা গেলো। ছেলেটা মারা গেল এই খবরটা আমরা তার মাকে দিতে পারছিলাম না।... কী বলবো?’
‘তার নাম ছিল জুয়েল…সবার আগে মারা গেল বাচ্চা ছেলেটা। কাল রাতে যখন সাংবাদিকরা জানতে চাচ্ছিলেন, জুয়েল মারা গেছে কিনা? আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। ওর মাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললাম, এখন কীভাবে বলি মারা গেছে?’... ধরে আসে এই চিকিৎসকের কণ্ঠ। ‘এজন্য আমরা জুয়েলের ডেথ ডিক্লেয়ার করেছি একটু দেরিতে, সময় নিয়ে’, বলেন ডা. হোসাইন ইমাম।
তবে এ ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ডা. হোসাইন ইমাম। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এসি বিস্ফোরণের কথা বলা হলেও আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্ন হচ্ছে, এসি থাকে ওপরে। সেখান থেকে যে ব্লো আসে সেটা লাগার কথা মুখে। এজন্য সবার শ্বাসনালি পুড়ে গেছে– ধরে নিলাম এটা। কিন্তু সবার হাত-পা কীভাবে শতভাগ পুড়ে গেলো? পা তো নিচে, এসির ব্লো তো সে পর্যন্ত যাওয়ার কথা না।’ যোগ করেন তিনি।
স্বল্প সময়ে দগ্ধদের একে এক মারা যাওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, ‘শনিবার সারা দিন হাসপাতালে ছিলাম, কিন্তু প্রতি মিনিটে শুনছি, স্যার ওমুক নাই, স্যার আরেকজন মারা গেছেন, স্যার এই রোগী মারা গেছেন। শনিবার রাতে গুনে গুনে ২০ জন রোগী মারা গেলো। হয়তো আগামী কয়েকদিনে আমরা আরও কিছু মানুষকে আমরা হারিয়ে ফেলবো।
‘এ রকম ক্যাজুয়ালিটি আমরা দেখেছি, কিন্তু এরকম একটা ঘটনা একদম নাই হয়ে গেল মানুষগুলো। মানুষের যে কান্না, বিলাপ... স্বজনদের হাহাকার, সবকিছু মিলিয়ে গুমোট পরিবেশ। কিন্তু আমাদের তার ভেতরেই কাজ করতে হয়। রোগী চিৎকার করছে, স্বজনরা কাঁদছে, কেউ ব্যথায় গড়াগড়ি করছে, কেউ বেডেই টয়লেট করে দিচ্ছে, সেগুলো তাৎক্ষণিক পরিষ্কার করতে হচ্ছে– এই দৃশ্যগুলো আসলে বলে বোঝানো খুব কঠিন। এইগুলো যখন চোখের সামনে ঘটে তখন বোঝা যায়, আসলে আমরা চিকিৎসকরা কী ফেস করি।’
মৃতের সংখ্যা বাড়ার বিষয়ে ডা. হোসাইন ইমাম আরও বলেন, ‘আমরা তো খুব সহজে বলে ফেলি, আজ (শনিবার রাত) পর্যন্ত ২০ জন মারা গেছে, কাল সংখ্যাটা হয়তো আরও বাড়বে…। বেঁচে যে থাকবে, বাঁচার যে আশা…আসলে কারও নেই। আমরা হিসাব করে রেখেছি, চারজন রোগীর ৫০ শতাংশের নিচে বার্ন কিন্তু তাদের প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এখন যে কথা বলছে, আমি জানি আগামী তিন দিন পর সে কথা বলতে পারবে না, ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারবে না…।’
আর ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্তলাল সেন বলেন, ‘এটা যে এতবড় বীভৎস ঘটনা হবে তা প্রথমে বুঝিনি। রোগীদের পুরো শরীর, মাথার চুল পর্যন্ত পুড়ে গেছে। এই মানুষগুলো বাঁচবে কী করে? ইতোমধ্যে ২০ জন মারা গেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কতজন থাকবেন সেটা দেখার বিষয়।’
ছবি: সাজ্জাদ হোসেন।