অতিথিপরায়ণতা ইসলামের অন্যতম বিধান। কারও বাড়িতে কোনও ব্যক্তি উপস্থিত হলে তিনি ওই বাড়ির মেহমান বা অতিথি। আর যার বাড়িতে উপস্থিত হয়েছেন তিনি মেজবান। অতিথিকে যথাসম্ভব সমাদর করা মেজবানের কর্তব্য।
অনুরূপভাবে অতিথিরও বেশ কিছু দায়িত্ব ও করণীয় আছে। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে বেশ সুন্দরভাবে অতিথির করণীয় সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা যারা ঈমান এনেছো শোনো! নবীগৃহে প্রবেশ করো না যতক্ষণ না তোমাদেরকে অনুমতি দেওয়া হয় খাদ্যগ্রহণের জন্য, (আগেভাগেই এসে পড়ো না) খাদ্য প্রস্তুতির জন্য অপেক্ষা করো যেন বসে থাকতে না হয়। তবে তোমাদেরকে ডাকা হলে প্রবেশ করো। এরপর তোমাদের খাওয়া হলে তোমরা চলে যাও। কথাবার্তায় মশগুল হয়ে যেয়ো না। তোমাদের এ কাজ নবীকে কষ্ট দেয়। সে তোমাদেরকে (উঠে যাওয়ার জন্য বলতে) লজ্জাবোধ করে, আল্লাহ সত্য কথা বলতে লজ্জাবোধ করেন না।
তোমরা যখন তাঁর স্ত্রীদের কাছে কোনও কিছু চাও, তখন পর্দার আড়াল থেকে চাও। এটাই তোমাদের ও তাঁদের অন্তরের জন্য পবিত্রতর। তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলকে কষ্ট দেওয়া সঙ্গত নয়। আর তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রীগণকে বিয়ে করাও তোমাদের জন্য কখনও বৈধ নয়। আল্লাহর দৃষ্টিতে এটা মহাঅপরাধ’। (সুরা আহজাব, আয়াত : ১৫৩)
মহান আল্লাহ এই আয়াতে মুসলমানদের পরস্পরের ঘরে আসা-যাওয়া, ইসলামি সামাজিকতা ও অতিথির করণীয় সম্পর্কে কয়েকটি হুকুম ও শিষ্টাচার বর্ণনা করেছেন। যেহেতু এখানে প্রিয় নবী (সা.) ও তাঁর স্ত্রীদের বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে- এজন্য ‘বুয়ুতুন নাবী’ তথা নবীজীর ঘরসমূহ উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আয়াত দুটি অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট থেকে বোধগম্য যে এখানে সামগ্রিকতা ও ব্যাপকতা উদ্দেশ্য; শুধু আল্লাহর নবীর ঘরগুলো নয়। অর্থাৎ যে কারও ঘরে প্রবেশের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো পালনীয়। এটিই পূর্বাপর ওলামায়ে কেরাম ও ইসলামি স্কলারদের অভিমত।
আল্লাহতায়ালা আলোচ্য আয়াতে আদব ও শিষ্টাচারের আবরণে চারটি হুকুম বর্ণনা করেছেন। সেগুলো হলো-
এক. অনুমতি ছাড়া কারও ঘরে প্রবেশ করা যাবে না। এখানে দুটি আদব ও শিষ্টাচার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে- প্রথমত, কারও ঘরে প্রবেশের ক্ষেত্রে তার অনুমতি চাওয়া। দ্বিতীয়ত, অনুমতি না হলে ওই ঘরে প্রবেশ না করে ফিরে আসা।
দুই. বিনা দাওয়াতে কোনও খাবার অনুষ্ঠানে যাওয়া যাবে না। সমাজের কিছু মানুষ এমন থাকেন, যাদের মধ্যে বিনা দাওয়াতে খাবার গ্রহণের প্রবণতা রয়েছে। তাদেরকে এই অভ্যাস পরিত্যাগের হুকুম দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর গোটাজীবনে এরকম অভ্যাস পরিত্যাগের প্রতি নানাভাবে নিরুৎসাহিত করে গেছেন।
তিন. যদি কেউ কোনও ভোজ অনুষ্ঠানে দাওয়াত পান, তাহলে নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে উপস্থিত হওয়া, এর আগে নয়। যাতে খাবার প্রস্তুত হওয়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে না হয়। অনেক ক্ষেত্রে খাবার গ্রহণের আগে ভোজ অনুষ্ঠানে পৌঁছানো আয়োজকদের কষ্টের কারণ হয়। আর খাবারের জন্য অপেক্ষা দৃষ্টিকটু। অথচ ইসলাম এমন এক মহান ধর্ম, যা মুসলমানদের অল্পেতুষ্টির পাশাপাশি অভাব ও দারিদ্রের সময়েও স্বনির্ভরতার গুণ শিখিয়েছে।
চার. দাওয়াতে নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হওয়ার পাশাপাশি খাবার গ্রহণ শেষে যথাসম্ভব দ্রুত অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করা। কারণ, অনেক সময় খাওয়ার পর সেখানে সময় কাটানো মেজবানদের অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমন্ত্রিত অতিথিদের কয়েক দফায় পৃথক পৃথক বৈঠকে বসিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয়, এই পরিস্থিতিতে খাওয়ার পর বিনা কারণে সেখানে সময় কাটানো আয়োজকদের জন্য বেশ অস্বস্তিকর। কেননা, উপরোক্ত আয়াতে নবীজী সম্পর্কে বলা হয়েছে—‘সে তোমাদেরকে (উঠে যাওয়ার জন্য বলতে) লজ্জাবোধ করে।’ এরকম পরিস্থিতি আমাদের সমাজেও হতে পারে যে অতিথি বিনা কারণে অবস্থান করছেন—এতে মেজবান বিরক্তবোধ করছেন কিন্তু কিছু বলতে পারছেন না। তবে পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে দেরি করলে মেজবানদের কোনও সমস্যা হচ্ছে না; বরং অনুষ্ঠান আরও আকর্ষণীয় ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, সেক্ষেত্রে দেরি করা এবং আয়োজকদের চাহিদামত সময় অতিবাহিত করা যাবে।
আলোচ্য আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসুলের মাধ্যমে সাহাবিদেরকে ‘অতিথি’র করণীয় সম্পর্কে শিখিয়েছেন। আর এটি আমাদের জীবনের জন্যও বিরাট শিক্ষা। আল্লাহ আমাদের বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখার তাওফিক দান করেন। আমিন।
লেখক: শিক্ষক। মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।