X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্রোহী ও মদতদাতাদের বিষয়ে আ.লীগের তিন মত

এমরান হোসাইন শেখ
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:০০আপডেট : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১৪:২৩

সদ্য অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদতদাতাদের বিষয়ে তিন মত আওয়ামী লীগে। দলের একটি অংশ ভবিষ্যৎ নির্বাচনে বিদ্রোহী ও মদতদাতা ঠেকাতে তাদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের পক্ষে মত দিয়েছে। আরেকটি অংশ চাচ্ছে, অতীতের মতো সাধারণ ক্ষমার আওতায় এনে তাদের ক্ষমা করে দিতে। আর তৃতীয় একটি পক্ষ চাচ্ছে, দল থেকে চূড়ান্ত বহিষ্কার না করে প্রত্যেকের পদাবনতি করে রাখা। যাতে তারা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে, আবার দলের বিপক্ষে যাওয়ার শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে ভবিষ্যতে সতর্ক হবে। অবশ্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের ব্যাপারে দলের বেশিরভাগের বক্তব্য হচ্ছে,  তাদেরকে কোনোভাবেই সাধারণ ক্ষতার আওতায় না আনা। কোনও না কোনও ফরমেটে তাদের অন্তত টোকেন শাস্তির আওতায় এনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি দেশে দশম সাধারণ ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।  গত ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটটি ধাপে চার হাজার ১৩৬টি ইউপিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এসব ইউপির মধ্যে ইসি থেকে প্রাপ্ত ৪ হাজার ৪৪টির ফলাফলে দেখা গেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থীরা দুই হাজার ১৯০টি ইউপিতে চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। এছাড়া এক হাজার ৭৮৯ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী চেয়ারম্যান পদে জয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ৩৫০ জন বিএনপি সমর্থিত। এছাড়া কয়েকজন রয়েছে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন বাতিল হওয়া জামায়াত সমর্থিত। বাকিদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থিত। বিদ্রোহীদের অন্তত এক হাজার ৪০০ জনই আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী।

জানা গেছে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ‍শুরু থেকে বিদ্রোহী ঠেকাতে আওয়ামী লীগ কঠোর হলেও তা ফলপ্রসূ হয়নি। বরং ধাপে ধাপে বিদ্রোহী প্রার্থী বেড়েছে। বেড়েছে তাদের কর্মী-সমর্থক ও মদতদাতা। ধাপে ধাপে বেড়েছে বিদ্রোহীদের জয়ের হারও। মদতদাতাদের মধ্যে এমপি-মন্ত্রীরাও ছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, বিদ্রোহী ঠেকাতে কখনও কেন্দ্রের নির্দেশে আবার কখনও তৃণমূলের নিজস্ব সিদ্ধান্তে প্রার্থী ও তার সমর্থকদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায়  কমবেশি এ ধরনের বহিষ্কারের ঘটনা আছে। ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী  ও তাদের মদতদাতা এবং নৌকার বিপক্ষে কাজ করেছে, এমন বহিষ্কারের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কোনও কোনও  উপজেলায় বহিষ্কারের সংখ্যা শতক ছাড়িয়েছে। বহিষ্কারের মধ্যে যেমন রয়েছেন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা, তেমনই আছেন জেলা পর্যায়েরও নেতা। এছাড়া রয়েছেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, তৃনমূল থেকে বহিষ্কারের বিষয়টি সুপারিশ করে ইতোমধ্যে কেন্দ্রে তালিকা পাঠানো হয়েছে।  তবে কেন্দ্র থেকে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, দলের বিভিন্ন ফোরামে তারা আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে এসব বহিষ্কার ও অব্যাহতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দলের সভাপতিমণ্ডলীর সভায়ও বিষয়টি উঠে আসে। জানা গেছে, ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তার মদতদাতাদের বিষয়ে দলের তিনটি মত উঠে এসেছে। এর মধ্যে একটি মত হলো— সবাইকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় নিয়ে আসা। সামনে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দলকে আরও শক্তিশালী করতে এই মত এসেছে। ক্ষমা করে দেওয়া হলে কিছুদিন পরে তারা আস্থায় চলে আসবে বলে অভিমত এই অংশের।  দ্বিতীয় মতটি হলো— তৃণমূল থেকে যে বহিষ্কারের সুপারিশ এসেছে, এবং যাদেরকে শোকজ করা হয়েছে, সেগুলো যাচাই করে দেখে, দোষীদের স্থায়ী বহিষ্কারসহ অপরাধ ভেদে শাস্তির বিধান করা। এক্ষেত্রে কোনও সংসদ সদস্য যদি জড়িত থাকেন, তাহলে আগামী সংসদ নির্বাচনে তাকে মনোনয়ন না দেওয়ার কথাও ওঠে। আর সর্বশেষ মতটি হলো—  দলের বিপক্ষে অবস্থানকারীরা বর্তমানে যে পদে আছেন, সেখান থেকে পদাবনত করে রাখা। এক্ষেত্রে দলীয় পদচ্যুত করে প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে অন্তর্ভুক্ত করে রাখা।

তৃণমূলের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কেন্দ্রের পরামর্শে তারা দলের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থানকারীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করা হলেও  কেন্দ্র থেকে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ফলে তারা বেশ হতাশায় রয়েছেন। ২০১৯ সালের উপজেলা নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে তারা বলেন, অতীতের মতো সাধারণ ক্ষমার আওতায় আনা হলে ত্যাগীরা মনোকষ্টে নিষ্ক্রীয় হয়ে পড়বেন। পাশাপাশি ভবিষ্যতে বিদ্রোহীরা আরও উৎসাহি হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উত্তরাঞ্চলের একটি জেলার শীর্ষ পর্যায়ের নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের কাছে বিদ্রোহী প্রার্থী ও তাদের মদতদাতাদের কী হবে, তা জানতে চেয়েছি। আমরা বলেছি, এগুলো করে আমাদের বেকায়দায় ফেলেন কেন? তবে কোনও জবাব পাইনি। ওই নেতা আরও বলেন, তৃণমূলের প্রতিনিধি হিসেবে বিষয়টি নিয়ে তাদের বেকায়দায় পড়তে হয়। যারা বিপক্ষে অবস্থান করে তারাও আমাদের রাজনৈতিক সতীর্থ, একইসঙ্গে  রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে হয়। অ্যাকশন নেওয়ার পর তা কার্যকরী না হলে আমরা বিব্রত হই।

এই নেতা বলেন, উপজেলা নির্বাচনে এমনটি দেখেছিলাম।  পরে তা কার্যকরী থাকেনি। রাজনীতি করি, ফলে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। যখন যে সিদ্ধান্ত আসে তা মানতে হবে।

এদিকে গত বুধবার (১৬ জানুয়ারি) আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির কার্যালয়ে খুলনা বিভাগের সব জেলার সঙ্গে ভার্চুয়াল মতবিনিময়েও প্রসঙ্গটি উঠে আসে। ওই সভায় বলা হয়, দল থেকে যারা বহিষ্কার হয়েছে এবং যাদের শোকজ করা হয়েছে, তাদের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে নেতৃত্বে আনা যাবে না।

বিদ্রোহীদের বিষয়ে দলের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মহিউদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে ভোট করেছে এবং তাদের পক্ষে যারা কাজ করেছে, তাদের সাময়িক বহিষ্কার করে কেন্দ্রের কাছে সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের বিষয়ে কেন্দ্রের কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাইনি।’  যারা বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল এবং যারা তাদের মদতদাতা, কেন্দ্রের নির্দেশে তাদের তালিকা কেন্দ্রে পাঠিয়েছেন বলে জানান এই নেতা।

রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বরও একই তথ্য জানান। তিনি বলেন, ‘আমরা বিদ্রোহী ও তাদের সমর্থকদের দল থেকে অব্যাহতি দিয়ে কেন্দ্রকে অবহিত করেছি। এছাড়া কারা কারা তাদের মদত দিয়েছেন, সেই তালিকাও কেন্দ্রের কাছে পাঠিয়েছি।  তবে কেন্দ্র থেকে নতুন করে কোনও সিদ্ধান্ত পাইনি।’

দলের বিপক্ষে ভোট করে যারা জয়ী হয়েছেন, তাদের বিষয়েও কেন্দ্র থেকে নতুন কোনও নির্দেশনা নেই বলেও জানান এই নেতা।

অবশ্য লক্ষ্মীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু বলেন, ‘যারা দলের বিপক্ষে ভোট করেছে, তাদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হবে না। তবে যারা বিপক্ষে কাজ করেছে, তারা বহিষ্কার না হলেও দলের পদে থাকতে পারবে না। তারা প্রাথমিক সদস্য থাকতে পারবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংঠনিক এস এম কামাল হোসেন কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন তো শেষ হয়ে গেছে। এই বিষয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনও মন্তব্য করতে পারবো না। এই বিষয়ে দল সিদ্ধান্ত নেবে।’

দলের সভাপতিমণ্ডলীর  সদস্য আবদুর রহমান বলেন, ‘কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন ছাড়া তৃণমূলের কাউকে বহিষ্কারের সুযোগ নেই। বহিষ্কারের সুপারিশ করতে পারবে। এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে কেন্দ্র। আর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ এখনেও কারও বিষয়ে বহিষ্কার বা কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে এই বিষয়টি নিয়ে এখনই কথা বলার মতো যথেষ্ট উপযুক্ত সময় নয়। এজন্য আরও অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, যেকোনও সিদ্ধান্তই দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আলোচনা করে নেওয়া হয়। কোভিডের কারণে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক আপাতত অনুষ্ঠিত হচ্ছে না। ফলে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানতে সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’

দলের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, ‘যারা নৌকা মার্কার বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছে, তাদের অলরেডি পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত পার্টির সিদ্ধান্ত— তাদের দল থেকে চূড়ান্ত বহিষ্কার করা। সাংগঠনিক সম্পাদকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে— যারা নৌকা মার্কার বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তাদের তালিকা তৈরি করার।’

বিদ্রোহী ও মদতদাতাদের বিষয়ে দলের নেতাদের মধ্যে একাধিক মত রয়েছে উল্লেখ করে এই নেতা বলেন, ‘আমার মত হলো যারা মদত দিয়েছে দলে তাদের পদ অবনত করে দেওয়া। যে যে পদে আছে, সেখান থেকে প্রাথমিক সদস্য করে দেওয়া। এদেরকে ছাড় দেওয়ারও দরকার নেই। বহিষ্কার করার দরকার নেই। এটা হলে তাদের নিজেদের যেমন উপলব্ধি হবে, দলের ঐক্যও রাখা সম্ভব হবে।’

নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে যারা বিপক্ষে কাজ করেছে, ভবিষ্যতে মনোনয়ন দেওয়ার সময় এই বিষয়টি দেখা হবে বলেও উল্লেখ করেন এই নেতা।

 

 

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হলেন ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই ও ভাগনে
উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী হলেন ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই ও ভাগনে
ঈদের পরও চলছে রঙচটা বাস, আবার সময় দিলো বিআরটিএ
ঈদের পরও চলছে রঙচটা বাস, আবার সময় দিলো বিআরটিএ
উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করতে এমপি-মন্ত্রীদের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
উপজেলা নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার না করতে এমপি-মন্ত্রীদের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর
১০ বাংলাদেশিকে সীমান্ত এলাকা থেকে মিয়ানমারে অপহরণ
১০ বাংলাদেশিকে সীমান্ত এলাকা থেকে মিয়ানমারে অপহরণ
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা