নতুন সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছে আগামী ১১ জুলাই। এর মধ্যেই সাবেক ও বর্তমান বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির খবর সামনে আসছে। এখনও ক্ষমতাসীন দলের তেমন কারও নাম আসেনি কোনও দুর্নীতিতে। তবে সরকারি কর্মচারীদের এসব ঘটনা ক্ষমতাসীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের কপালেও ভাঁজ ফেলেছে। দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, মোটা দাগে দুর্নীতির যেসব খবর সামনে এসেছে, সেগুলো নিয়ে কঠোর অবস্থানে গিয়ে সরকার একটা বার্তা দিয়েছে এবং সেটি সরকারি দলের একটি অংশকে চিন্তিত করে তুলছে।
আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় বলেছেন, তাদের সরকার দীর্ঘদিন (টানা চতুর্থবার) রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকায় সরকারি কর্মকর্তা ও দলীয় নেতাদের একটি অংশ দুর্নীতিসহ নানা ধরনের অনিয়মে জড়িয়েছে। সম্প্রতি যে কয়টি দুর্নীতির ঘটনা সামনে এসেছে, সেগুলো সবাইকে নাড়িয়ে দিয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেওয়ায় সবাই নড়েচড়ে বসেছে।
দুর্নীতির খবর যখন একের পর এক সামনে আসছে, এর মধ্যেই আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার গত ১৫ বছরে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার খবরও সামনে এসেছে গণমাধ্যমে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগ নেতাদের হলফনামায় কয়েক বছরে সম্পদ বহুগুণে বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে আসে। এমনকি উপজেলা নির্বাচনের প্রার্থীদের সম্পদও কয়েক বছরে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার তথ্য সামনে আসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) বিশ্লেষণে।
গণমাধ্যম বা দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাগুলোর তৎপরতা অব্যাহত থাকলে দুর্নীতিতে জড়িত দলীয় ব্যক্তিদের থলের বেড়ালও বেরিয়ে আসতে পারে শঙ্কা অনেকের।
দলের নেতারাই বলছেন, নতুন সরকারের সামনে দুর্নীতি দমনের বিষয়টি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছে। এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে বারবার বলেছেন। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ইস্যুতে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানসহ অন্য কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও সরকারের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। অনিয়মে জড়িতদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না, সেটি পরিষ্কার হওয়ায় ‘অপরাধীরা’ স্বাভাবিকভাবেই চিন্তিত হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চলতি বছরের শুরুতে হওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে। তারপরও চ্যালেঞ্জিং এই নির্বাচন করে নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে সরকার গঠন করেছে আওয়ামী লীগ। এই সরকারের সময়ে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর মাধ্যমে দুর্নীতির বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সামনে এসেছে। ফলে দুর্নীতির ক্ষেত্রে কঠোর অবস্থানে যায় সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেকজন সদস্য বলেন, সম্প্রতি যেসব দুর্নীতির ঘটনা সামনে এসেছে, সেগুলোর বেলায় সরকারের কঠোর অবস্থানের বিষয়টি একেবারে পরিষ্কার। এর মাধ্যমে আগামীতেও দুর্নীতিসহ নানা অনিয়মের ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান অপরিবর্তিত থাকবে এবং দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আইনের মুখোমুখি হতে হবে, সেটিও এখন স্পষ্ট। সে কারণে আওয়ামী লীগের যারা অনিয়ম করেছেন, অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন, তারা তো চিন্তিত হবেই। তারাও ছাড় পাবে না, সেটিও পরিষ্কার।
একের পর এক সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির ঘটনা সামনে আসার বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, জানতে চাইলে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে দেই? এটা নিয়ে কোনও মন্তব্য করবো না। কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে সংসদে বক্তৃতা দিয়েছি, সেটিই আমার উত্তর। আর আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতির কোনও খবর আমার জানা নেই।
গত ২০ মে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটে একটি বিবৃতি দিয়ে এসব তথ্য জানানো হয়। এরপর পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের বিপুল অবৈধ সম্পদের খবর বের হয় গণমাধ্যমে। তার সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত, তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। কোরবানির ঈদে ‘ছাগলকাণ্ডে’ আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কর্মকর্তা মতিউর রহমানকে বর্তমান দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এনবিআরের প্রথম সচিব (ট্যাক্সেস লিগ্যাল অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) কাজী আবু মাহমুদ ফয়সাল, তার স্ত্রী ও স্বজনসহ ১৪ জনের ৮৭টি ব্যাংক হিসাবে থাকা ৬ কোটি ৯৬ লাখ টাকা অবরুদ্ধের (ফ্রিজ করে রাখার) নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়াও পুলিশসহ প্রশাসনের আরও কয়েকজন কর্মকর্তার অনিয়ম নিয়ে খবর বেরিয়েছে।
গত ২৭ জুন জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে কামরুল ইসলাম বলেন, ইদানীং যেসব ঘটনা ঘটে যাচ্ছে, আমি বিশ্বাস করি এগুলো একটা ষড়যন্ত্রের অংশ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে হঠাৎ করে কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রচার-প্রোপাগান্ডা হচ্ছে। দেশের মানুষের সন্দেহ হয়, আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছে। কিন্তু একথা স্বীকার করতে হবে, যাদের বিরুদ্ধে আজ অভিযোগ তারা কেন আইনকে ভয় পায়? আইনকে ভয় পেয়ে বিদেশে কেন চলে যায়? তাদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেগুলো সত্য।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অনেকবার বক্তব্য দিয়েছেন। এতে তিনি বলেছেন, আজিজ আহমেদ ও বেনজীর আহমেদ ইস্যুতে সরকার বিব্রত নয়। সরকারের বিচার করার সৎ সাহস আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই নীতি বাস্তবায়নে কঠোর পথ অবলম্বন করছে সরকার। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যক্রম শুরু হয়েছে, চলবে। এ ক্ষেত্রে কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না, এটা পরিষ্কার। আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নন, সে যে-ই হোক না কেন।
সবাই দুর্নীতির পথ পরিহার করুন, সরকার সেটি চায়—এ কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সরকারি কর্মকর্তা হোক আর আওয়ামী লীগের নেতা হোক—সবাইকে আমরা দুর্নীতির ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করতে চাই। এটা যেন ভয়াবহ রূপ লাভ করতে না পারে সেজন্য লাগাম টেনে ধরা দরকার। সেই পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। দুর্নীতিগ্রস্তদের আইনের আওতায় আনা দরকার, যাতে এই পথ থেকে সরে দাঁড়ায় সবাই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দুর্নীতি একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি। দীর্ঘদিন ধরে চলা সামরিক শাসনামলে রাষ্ট্রযন্ত্র দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করায় এই ব্যাধির শেকড় গভীর পর্যন্ত প্রোথিত হয়েছে। ফলে দুর্নীতির ব্যাধি থেকে সমাজের সব পেশার কিছু মানুষ চরমভাবে আক্রান্ত হয়েছে। এখন নতুন করে তারকা দুর্নীতি উন্মোচিত হওয়ায় বিষয়টি নিয়ে সমগ্র জাতির সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছেন। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গৃহীত হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে প্রত্যেকের সচেতন ও সোচ্চার হতে হবে এবং দুর্নীতি যেসব পদ্ধতিতে হয় সেসব রোধ করে দুর্নীতির উৎসমুখগুলো বন্ধ করতে হবে। যে শিক্ষা ব্যবস্থা, সামাজিক ও নৈতিকতার শিক্ষা আমরা লাভ করেছি তা দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর নয়। সুতরাং প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি যেন না হয় সেভাবে পদ্ধতির মানোন্নয়ন করতে হবে।