ক্রিকেটকে ভালোবেসে টানা তিন বছর দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়িয়েছেন মারুফ মৃধা। কখনও গুলিস্তান, কখনও মুন্সীগঞ্জ, কখনোবা গুলশান! কিন্তু কোথাও থিতু হতে পারেননি। আর্থিক টানাপোড়েন তাকে কোথাও স্থির হতে দেয়নি। এ কারণে বারবার ফিরতে হয়েছে গ্রামে।
কৃষক আকবর মৃধা ও মর্জিনা বেগম দম্পতির তিন পুত্রসন্তানের মধ্যে মারুফ সবার ছোট। বড় দুই ভাই ইসমাইল মৃধা ও ইউসুফ মৃধার হাত ধরে ছোটবেলায় অলিগলিতে ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন তিনি। টেপ টেনিস বলে ত্রাস ছড়ানো মারুফের বোলিং দেখে এলাকার অনেকেই বলতে শুরু করেন, ‘তুই পারবি, তোকে দিয়েই হবে।’ এসব প্রশংসা তার মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় কৃষকের সন্তান হিসেবে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নপূরণ করা কঠিন। তবুও স্বপ্ন দেখেছে ছোট্ট মারুফ। বাবা-মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে ২০১৫ সালে মুন্সীগঞ্জ থেকে গুলিস্তানে আসেন ক্রিকেটার হওয়ার চেষ্টায়। ১২-১৩ বছর বয়সী মারুফ গুলিস্তানের স্মার্ট কোচিং ক্লাবে মাসদুয়েক অনুশীলন করে পরীক্ষার কারণে বাড়ির পথ ধরেন। ফিরে অবশ্য বসে থাকেননি, মুন্সীগঞ্জের একটি অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন। কিন্তু মন ভরে না তার। কিছু টাকা-পয়সার বন্দোবস্ত করে ফের ঢাকার টিকিট কাটেন। একবছরের মধ্যে দু’বার ক্লাব পরিবর্তন করেন।
গুলশান ইয়ুথ ক্লাবে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে ক্রিকেটার হওয়ার মিশন শুরু হয় তার। কিন্তু টাকা ফুরিয়ে গেলে কয়েক মাসের ব্যবধানে ফের মুন্সীগঞ্জে ফিরে যেতে হয় তাকে। এরমধ্যে একবার বিকেএসপিতে পরীক্ষা দিয়ে ব্যর্থ হন। কিন্তু এসব ঘটনা মারুফের মনকে আরও শক্তিশালী করেছে। দুই বছরের কঠোর পরিশ্রম আর অধ্যবসায়ে ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বারের চেষ্টায় বিকেএসপিতে জায়গা করে নেন। সেই শুরু। আর থামতে হয়নি তাকে। ধাপে ধাপে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সিঁড়ি বেয়ে কৃষকের ছেলে মারুফ এখন যুব বিশ্বকাপের মঞ্চে।
অনূর্ধ্ব-১৯ যুব বিশ্বকাপে বাংলাদেশ স্কোয়াডকে নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের ধারাবাহিক আয়োজনে আজ থাকছে পেসার মারুফ মৃধার সাক্ষাৎকার।
বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেটের সঙ্গে আপনার পরিচয় হলো কীভাবে?
মারুফ মৃধা: আমার দুই ভাই টেপ টেনিসে খুব ভালো ক্রিকেট খেলতেন। তাদের দেখেই ক্রিকেট খেলার ব্যাপারে জেনেছি। তারাই আমাকে মাঠে নিয়ে যেতেন। মাঠে যেতে যেতে ক্রিকেটের প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়।
বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হওয়ার পরিকল্পনা করেছেন কখন?
মারুফ: ছোটবেলা থেকে অন্যদের কাছ থেকে ভালো বোলিংয়ের প্রশংসা পেতাম। আমার বলের গতি ছিল সবার চেয়ে বেশি। তারা বলতো, ‘তোকে দিয়ে কিছু হবে। তুই ক্লাবে ভর্তি হয়ে যা।’ এরপর আমরা তিন ভাই মিলে বলার পর বাবা-মা সহজেই রাজি হয়েছেন। তবে তাদের মধ্যে শঙ্কা ছিল এটা ভেবে যে, ক্রিকেটে তো অনেক খরচ। এত খরচ বহন করা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল মা-বাবার। তারপরও তারা যেভাবে যতটুকু পেরেছেন, আমাকে সহযোগিতা করেছেন।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার বাবা একজন কৃষক, তার কাছ থেকে পাওয়া সহায়তা কেমন ছিল?
মারুফ: শুধু আমার বাবা নন, পরিবারের সবাই আমার পক্ষে আছে ছোটবেলা থেকেই। বাইরের অনেক লোক ও আত্মীয়-স্বজন বলাবলি করেছে, ‘ক্রিকেট খেলে কী হবে?’ কিন্তু আমার বাবা-মা এবং ভাইয়েরা কখনও এমন কিছু বলেননি। আর্থিকভাবে কিছুটা দুর্বল হলেও তারা সবসময় আমাকে সহযোগিতা করেছেন।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তো একাধিক জায়গায় কোচিং করেছেন?
মারুফ: হ্যাঁ। ২০১৫ সালে গুলিস্তানে স্মার্ট কোচিং ক্লাবে ভর্তি হয়েছিলাম। সেখানে দুই মাস অনুশীলন করে পরীক্ষার কারণে বাড়ি চলে যেতে হয়। গ্রামে দুই মাস অনুশীলন করেছি। এরপর পরীক্ষা শেষে মুন্সীগঞ্জ ক্রিকেটে অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হই। সেখানে কিছুদিন অনুশীলনের পর ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশান ইয়ুথ ক্লাবে ভর্তি হই। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র।
বাংলা ট্রিবিউন: এতবার অ্যাকাডেমি পরিবর্তনের কারণ কী?
মারুফ: আমার বাসা থেকে অ্যাকাডেমির দূরত্ব ছিল অনেক। এ কারণে ভীষণ কষ্ট হতো। পাশাপাশি আর্থিক কিছু সীমাবদ্ধতাও ছিল। ঢাকায় একা থেকেই অনুশীলন করতাম। আমার মতো ছোট একটি ছেলে ঢাকা শহরে একা থাকা খুব কঠিন ছিল। সবকিছু মিলিয়ে বারবার অ্যাকাডেমি পরিবর্তন করতে হয়েছে। সবাই বলতো, ‘বিকেএসপিতে সুযোগ পেলে তোর জন্য ভালো হবে, ওখানে থেকেই অনুশীলন চালিয়ে যেতে পারবি।’ আমারও তাই চেষ্টা ছিল বিকেএসপিতে সুযোগ করে নেওয়ার।
বাংলা ট্রিবিউন: বিকেএসপিতে কীভাবে সুযোগ এলো?
মারুফ: আমার ভাবনায় ছিল বিকেএসপিতে সুযোগ পেতেই হবে। কিন্তু ২০১৭ সালে প্রথমবার ট্রায়াল দিয়ে বাদ পড়ে যাই। দুই বছর অনেক পরিশ্রম করেছি। এরপর ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পেয়ে যাই। এরপর আর সমস্যা হয়নি।
বাংলা ট্রিবিউন: আপনার এই পর্যায়ে আসার পেছনে আর কারও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
মারুফ: অনেকেই আছেন। আমার জেলা কোচ মাকসুদ স্যারের কথা বলতে পারি। তিনি আমাদের অনেক সহযোগিতা করেছেন। মেহরাব হোসেন জোশি ভাই অনেক সহায়তা করেছেন। এছাড়া বিকেএসপির কোচদের ভূমিকা অনেক। অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পাওয়ার পর জ্যাকি স্যার (মাহবুব আলী), নাজমুল স্যার (পেস বোলিং কোচ নাজমুল হোসেন) সহযোগিতা করেছেন।
বাংলা ট্রিবিউন: শুরু থেকেই কি পেস বোলার হতে চেয়েছিলেন?
মারুফ: টেপ টেনিস বলে অন্যদের চেয়ে জোরে বোলিং করতে পারতাম। টেনিস বলে আমার লাইন-লেন্থ অনেক ভালো ছিল। সবার প্রশংসা পেয়ে আমারও ইচ্ছে হতো আরও জোরে বোলিং করার। আমার বোলিং দেখে অনেক বড় ভাই আতঙ্কে থাকতেন! এজন্য আমার খুব মজা লাগতো।
বাংলা ট্রিবিউন: পেস বোলিংয়ে আপনার অনুপ্রেরণা কে?
মারুফ: মোহাম্মদ আমির। পাকিস্তানের এই পেসারকে আমার ছোটবেলা থেকেই ভালো লাগতো। আমিরের আগ্রাসী মনোভাব খুব ভালো লাগতো আমার। পাশাপাশি মোস্তাফিজ (মোস্তাফিজুর রহমান) ভাইয়ের বোলিং ভালো লাগে।
বাংলা ট্রিবিউন: বাংলাদেশের বাঁহাতি পেসারদের দেখে উজ্জীবিত হন?
মারুফ: শরিফুল ভাইয়ের বোলিং দেখি। তিনি অনেক ভালো করছেন। যারা যারা ভালো করছেন তাদের সবার বোলিং দেখি। তাদের বোলিংয়ের ফুটেজ দেখে শেখার চেষ্টা করি।
বাংলা ট্রিবিউন: এশিয়া কাপ আপনার ভালো কেটেছে, দক্ষিণ আফ্রিকার কন্ডিশনে বোলিং করতে কতটা রোমাঞ্চিত?
মারুফ: আমি নির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনার মধ্যে নিজেকে রেখেছি। দক্ষিণ আফ্রিকায় কীভাবে বোলিং করতে হবে আমার জানা আছে। এখানে এসে কয়েকদিন অনুশীলন করেছি। কন্ডিশন সম্পর্কে একটা ধারণা হয়ে গেছে। আশা করি, পরিকল্পনাগুলো ঠিকঠাক বাস্তবায়ন করতে পারবো।
বাংলা ট্রিবিউন: বিশ্বকাপে আপনার ব্যক্তিগত লক্ষ্য কী?
মারুফ: দেশের হয়ে ভালো একটা বিশ্বকাপ কাটাতে চাই। দারুণ কিছু স্পেল করতে চাই। অন্তত এক ম্যাচে হলেও পাঁচ উইকেট নিতে চাই।
বাংলা ট্রিবিউন: বিশ্বকাপ শুরু হতে আর কয়েক দিন বাকি, দলের প্রস্তুতি কেমন?
মারুফ: সবার প্রত্যাশা, আমরা ভালো কিছু করবো। নিঃসন্দেহ আমাদের সবার ফোকাস এখন বিশ্বকাপে কীভাবে ভালো করা যায়। আমরা দুই বছর ধরে যেভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি, সেটার পরীক্ষা শুরু হবে কয়দিন পর। আশা করি, খুব ভালো একটা বিশ্বকাপ কাটাতে পারবো।
একনজরে
পুরো নাম: মারুফ মৃধা
ডাক নাম: মারুফ
জন্ম: ১৫ মে, ২০০৬
জন্মস্থান: পাঁচগাঁও, টঙ্গীবাড়ী, মুন্সীগঞ্জ
বাবা: আকবর মৃধা
মা: মর্জিনা বেগম
উচ্চতা: ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি
পড়াশোনা: এইচএসসি প্রথম বর্ষ
প্রথম ক্লাব: স্মার্ট কোচিং ক্লাব, গুলিস্তান
বর্তমান ক্লাব: বিকেএসপি
ব্যাটিং স্টাইল: বাঁহাতি
যুব ওয়ানডেতে রান: ১১ ম্যাচে ১৮ রান
বোলিং স্টাইল: বাঁহাতি পেসার
প্রিয় ডেলিভারি: সুইং
যুব ওয়ানডেতে উইকেট: ১১ ম্যাচে ২১ উইকেট
প্রিয় মানুষ: বাবা-মা
প্রিয় ক্রিকেটার: মোহাম্মদ আমির
ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত: এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ৪ উইকেট